বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি বিগত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যার প্রতিকার ও প্রতিরোধ কোনও একক বা স্থানীয় প্রচেষ্টায় হবার নয়। পৃথিবী নামক গ্রহটিকে ক্রমবর্ধমান পরিবেশদূষণ থেকে বাঁচাতে হলে সঙ্ঘবদ্ধভাবে পৃথিবীর সব জাতি ও রাষ্ট্রকে কোমর বেঁধে নামতে হবে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল দেশগুলি, উত্তরের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বিগত দিনের ক্রমাগত লুণ্ঠনের অভ্যাসের কারণে, এবং নিজেদের মধ্যে কায়েমি স্বার্থের সংঘাতের কারণে, এবিষয়ে সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
দীর্ঘদিন উপনিবেশে থাকার জন্য তৃতীয় বিশ্ব বা দক্ষিণের দেশগুলি কমবেশি এই কষ্ট ভোগ করেছে এবং করে চলেছে। মার্কস-এর ভাষায়, এই ঔপনিবেশিক অবস্থা হল ‘অনকনসাস টুল অব হিস্ট্রি’। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্ম বর্ণনাতীত দুর্দশার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে। দক্ষিণের এই দেশগুলি উপনিবেশ থাকাকালীন সাম্রাজ্যবাদীরা এখান থেকে প্রত্যক্ষভাবে অবাধে লুণ্ঠন করে গেছে। আর এখন পরোক্ষভাবে করছে। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে (উৎসা পট্টনায়েক ২০২০), ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত থেকে ২৫০ বছরে ৪৫ লক্ষ কোটি পাউন্ড লুঠ করেছে এবং তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১৬.৫ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই দুর্বল দেশগুলি থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা সমস্ত ধরনের প্রাকৃতিক ও সামাজিক সম্পদ করায়ত্ত করে নিজের দেশে জমা করেছে। এখানকার প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশকে তারা তছনছ করে দিয়েছে। এরা যখন আমাদের দেশ ছেড়ে গেছে তখন সমস্ত দিক থেকে আমরা বিধ্বস্ত। এই বিধ্বস্ত অবস্থাকে মেনে নিয়ে, এরই উপর ভিত্তি করে ওই সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি থেকেই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এই দেশগুলিকে যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়েছে। অনাহার, দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, দাঙ্গা, হানাহানি সর্বদা আমাদের সঙ্গী থেকেছে। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কথা, পরিবেশ যে তছনছ হয়ে গেছে, একে ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি যেমন ব্রিটিশ, ফরাসি, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ডাচ প্রভৃতিরা এই দেশগুলিকে কাঁচামালের অবাধ ভান্ডার হিসাবে ব্যবহার করেছে। এরা বাণিজ্যিক ফসল (কফি, কোকো, তামাক) তৈরি করার জন্য বনজ সম্পদ ছারখার করে দিয়েছে। রবার, চিনি, তুলো, পাম অয়েল তৈরি করার জন্য দেশগুলির পরিবেশের ভারসাম্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্রিটিশরা রেললাইন পাতা এবং চা-শিল্প গড়ে তোলার জন্য এদেশের বিপুল পরিমাণ বনজ সম্পদ ধ্বংস করায় স্থানীয় মানুষরা অশেষ দুর্গতির শিকার হয়েছে। ফরাসিরা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হাইতিতে চিনি উৎপাদনের জন্য আখের ক্ষেত তৈরি করে সেখানকার প্রকৃতিকে শেষ করে দিয়েছে। বেলজিয়াম আফ্রিকার কঙ্গোতে রবার চাষ করার জন্য বনজ সম্পদ ধ্বংস করা ছাড়াও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। যারা এর প্রতিবাদ করেছে তাদের হাত কেটে নিয়েছে। এরপরও ছিল ভূমি খনন করে নির্বিচারে খনিজ সম্পদ তুলে নেওয়া। সাম্প্রতিককালে উদাহরণ হল, সমগ্র আফ্রিকা থেকে নির্বিচারে খনিজ সম্পদের লুণ্ঠন এবং এর ফলে মর্মান্তিক পরিবেশ দূষণ।
সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রাখার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কল-কারখানা ও অন্যান্য শিল্পজাত পণ্য তৈরির দূষণের ভার চাপিয়ে দিয়েছে (কার্বন এমিশন)। উন্নয়নশীল দেশগুলি উত্তরের ‘সভ্য উন্নত’ দেশগুলির সমস্ত ধরনের উন্নয়নের বিষ-বোঝা নিজেদের কাঁধে নিয়ে ভয়ঙ্কর পরিবেশ দূষণকে সঙ্গী করেছে। গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশক থেকে আফ্রিকার ঘানা ও নাইজেরিয়ায় পশ্চিমের দেশগুলি তাদের দেশের যাবতীয় ইলেকট্রনিক বর্জ্য জাহাজে করে এনে জমা করেছে। ফরাসিরা তাদের যাবতীয় পরমাণু বোমার পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছে আলজিরিয়া ও পলিনেসিয়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করেছে মার্শাল দ্বীপে। যাবতীয় নিষিদ্ধ কীটনাশক ওষুধ, ডিডিটি ইত্যাদি দান করা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে পোকা নির্মূল করার জন্য (পড়ুন সাইলেন্ট স্প্রিং)।
আইএমএফ-এর ঋণ, কৃষিজাত পণ্যের বিনিময়ে শোধ করার জন্য ঋণভারে জর্জরিত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলির প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে কৃষকদের রপ্তানিজাত পণ্য উৎপাদনে বাধ্য করা হয়েছে। আবার বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিপুল জমি অধিগ্রহণ করে, এখানকার সস্তা কাঁচামাল, সস্তা শ্রম দিয়ে কারখানা তৈরি করেছে (ইউনিয়ন কার্বাইড), যে কারখানা ও পণ্য কখনো স্থানীয় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক দূষণের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এটা যেন বর্তমান সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলির নিয়তি, দাতা-গ্রহীতার পীড়নমূলক সম্পর্ক। ধনী দেশগুলির অর্থ আছে (যার অনেকটাই আমাদের দেশগুলি থেকে লুন্ঠিত), কারিগরি বিদ্যার অগ্রগতি রয়েছে, প্রভুত্ব করার ব্যবস্থাদি (সামরিক ক্ষমতা) রয়েছে। আমাদের এই দুর্দশাপীড়িত অবস্থায় বাধ্য অনুগতের মতো চেয়ে দেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর ছিল না। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাবে ন্যূনতম জীবনধারণের মান বজায় রাখার জন্য আমরা নির্বোধের মতো নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছি।
চোখের সামনে আমরা কিউবাকে দেখছি, যারা অনেক বলিদান দিয়ে সফল রাষ্ট্র বিপ্লব করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন না থাকায় বিগত সাত দশকে নিজেদের দেশটাকে স্বপ্নের মত গড়ে তুলতে পারেনি। অসংখ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে তাদের পর্যুদস্ত করা হয়েছে। তাদের বিচ্ছিন্নতা অসহায়তা ভয়ানক গভীরে প্রোথিত। এই মুহূর্তে সেই অবস্থা চলছে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের ফরাসি উপনিবেশ থেকে সদ্যমুক্ত হওয়া দেশগুলির— বারকিনা ফাসো, নাইজার, মালি ও চাদ।
মার্কস যে বিচ্ছিন্নতার কথা বলেছেন তার মোদ্দা বিষয়টা হল, শ্রমিক যখন তার উৎপন্ন শ্রমজাত ফসল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন সে প্রকৃতি থেকে, সমাজ থেকে, নিজের প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটা যদি আমরা পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত করে দেখি তাহলে দাঁড়ায় যে প্রকৃতি যেন একটি নির্বিচারে শোষণ করার উৎসস্থল, আর জীবন্ত মানবীয় শ্রমও এই প্রকৃতির অংশ। এই প্রকৃতির সমস্ত অংশকে পণ্যজাত করা হয়েছে কারণ পুঁজি যাই স্পর্শ করে তাই-ই সোনা হয়ে যায় (রাজা মিদাসের গল্প)। উপনিবেশকালে পরাভূত দেশের সমস্ত কিছু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি যথেচ্ছ, অবাধ ব্যবহার, শোষণ, লুণ্ঠনের অধিকার অর্জন করেছিল।
প্রতিটি মানুষ তার জন্মগ্রহণের পর থেকে জীবনযাপনের প্রতিটি দশায় চারপাশের পরিবেশকে আপন করে নেয়, পরিবেশে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। আলো, জল, বাতাস, মাটি প্রকৃতির এই অপূর্ব দান আমাদের লালন-পালন কারে। প্রকৃতি ও পরিবেশ এমনই যে পৃথকভাবে আমাদের সজ্ঞান চেতনায় আসার প্রয়োজন হয় না। চেতনায় তখনই আসে যখন এসবের থেকে পাওয়া উপাদানগুলির অস্তিত্ব–সংকট তৈরি হয় এবং চেতন স্তরে প্রকৃতির ‘রোষ’ ধীরে ধীরে এক বিপন্নতা গড়ে তোলে। আমরা জীবনের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যাকে ভালবাসি, যাকে জড়িয়ে থাকি,তার অভাব বা সমস্যা আমাদের সর্বক্ষণের উদ্বেগের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। কখনও কখনও বুঝতে পারি এমন কঠিন, জটিল সমস্যার সমাধান সাধ্যের বাইরে (যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার) তখন অসহায় হয়ে হাল ছেড়ে দিই; মনের মধ্যে কষ্টটা থেকেই যায় — একটা সর্বোপরি ব্যর্থতা, মন খারাপের ভাব, এলিয়েনেশনের।
ক্রমাগত শিল্পায়ন, নগরায়নের ফলে আত্মপরিচয় হারিয়ে, ভিটেমাটিসহ চেনা জীবন ছেড়ে অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে বেরিয়ে পড়া অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। নতুন করে বসতি স্থাপন এবং তাই নিয়ে পরিবেশ-ব্যবস্থার অভূতপূর্ব টানাপোড়েন, প্রকৃতির সঙ্গে মননগত ফাটল (সাইকোলজিক্যাল রিফট) তৈরি হয়। তাহলে কেমন করে এই ফাটল ভরাট করা যাবে? এর প্রথম শর্ত উৎপাদনের স্বার্থে যথেচ্ছভাবে প্রকৃতিকে ব্যবহার করা চলবে না। এর জন্য পুঁজির লোভের ডানাকে, হিংসার হাতকে বেঁধে দিতে হবে যাতে তা প্রকৃতি এবং মানুষকে ধ্বংস করে পুঁজির পাহাড় না বানাতে পারে। বিখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকা ২০২১ সালে যুবক–যুবতীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করে জানতে পারে যে, ৭৫ শতাংশের দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের ভবিষ্যৎ দিনগুলি ভয়াবহ। কিন্তু কীভাবে আমরা এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে পারি? তা জানা নেই।
পরিবেশ-প্রকৃতির ধ্বংসের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বনাঞ্চলে লাগাতার দাবানল, সামুদ্রিক হারিকেন, বন্যা, দূষিত জল চারপাশে ছড়িয়ে পড়া, ক্রমাগত একের পর এক প্রজাতির নিধন। পরিবেশ-প্রকৃতির দুর্বিষহ অবস্থা আমাদের মনে উদ্বেগ, বিষন্নতা, আঘাত–পরবর্তী পীড়নজনিত বিশৃঙ্খলা (পিটিএসডি) ইত্যাদি বাড়িয়ে তুলছে, পরিবারগুলিকে অসহায় করে তুলছে, সমাজকে আরো নির্বান্ধব করে তুলছে। এখন দেখা এসবের নাম দেয়া হয়েছে ‘পরিবেশজনিত উদ্বিগ্ন দশা’ (ইকো-অ্যাংজাইটি), পরিবেশজনিত মানসিক পীড়ন (ক্লাইমেট গ্রিফ), সোলাস্টালজিয়া ইত্যাদি। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যখন কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তাদের আত্মহত্যার হার অনেক বেড়ে যায়। এর থেকে উপলব্ধি করা যায় পরিবেশ আর শুধু বাইরের বিষয় নয়, তা আমাদের অন্তরের বিষয়, যা আমাদের মনসিজ ক্রিয়াকলাপকে প্রভূত প্রভাবিত করে থাকে।