বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
জ্যোতি বসুর ১১১তম জন্মদিনে ঘুম থেকে উঠেই ছুটে ছিলাম তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করতে। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে দৃষ্টি দিয়েই অনুভব করলাম, আজকের সকালের সৌন্দর্য। চলার পথে পথচারীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারাও কেমন আবাক হয়ে দেখছে। মনে হল ওরাও বোধহয় পেরেছেন ফ্রান্স থেকে বিশ্বের জনগণকে জানানো “সুপ্রভাত” বার্তা। কেন জানি মনে হচ্ছিল, ফ্রান্স - বিপ্লবের মাতৃভূমি থেকে দেলাক্রোয়ার বিখ্যাত ছবিটি আবার যেন ডাকছে সবাইকে। ওই দেশেরই প্যারি কমিউন জন্ম দিয়েছিল ‘লা ইন্টারন্যাশনাল’ এর। কমিউনার্ড ইউজিন পটিয়ের লিখেছিলেন “ইন্টারন্যাশনাল”। আজ আবার ফ্রান্সের জনতার ঠোঁটে ‘লা ইন্টারন্যাশনাল’।
‘নিউ পপুলার ফ্রন্ট’ এর নেতারা স্তালিনগ্রাদ স্কোয়ারে উল্লসিত জনতার মাঝে, আর চারদিকে শুধুই ‘লা ইন্টারন্যশনাল’!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচন। গোটা দুনিয়া তাকিয়ে ছিল ফ্রান্সের দিকে। উগ্র দক্ষিণপন্থী মারিয়েন লা পেন এর (আরএন) ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ জিতলে ইউরোপ জুড়ে সংহত হতো নয়া ফ্যাসিবাদ, উগ্র দক্ষিণপন্থা। নয়া ফ্যাসিবাদকে রুখে দিল বামজোট ও ফ্রান্সের জনগণ।
ফ্রান্সে সবার আগে কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, গ্রিন ও অন্যান্য বামদলগুলির জোট ‘নিউ পপুলার ফ্রন্ট’। নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিকল্প কর্মসূচি হাজির করে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছে নিউ পপুলার ফ্রন্ট।
লা পেনের ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ তিন নম্বরে। নয়া উদারনীতির ভ্রূণে জন্ম নয়া ফ্যাসিবাদের। নয়া উদারনীতির বিকল্প হাজির করলে তবেই রোখা সম্ভব উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে।
রাজনৈতিক বিষেশ্লক, সমীক্ষক ও ভোট পণ্ডিতদের গবেষণা বাতিল করে অপ্রত্যাশিত হলেও বিপুল জয় পেয়েছে বামপন্থীরা। জা লুক মেলাশোর র্যাডিকাল লেফট পার্টি ‘ফ্রান্স আনবোড’ সব থেকে বেশি আসনে জয়ী।
নয়া ফ্যাসিবাদের একমাত্র আইডেন্টিটি নয়া উদারনীতিকে রুখে দিয়ে বাম বিকল্প কর্মসূচিকে সামনে রেখে জনগণের মধ্যে যাওয়া আজকের দিনে বামপন্থীদের কর্তব্য। এটাই ফ্রান্সের শিক্ষা।
বর্ধমান ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী দল “টুগেদার অ্যালায়েন্স” হয়েছে দ্বিতীয় শক্তি। যদিও ফ্রান্সে নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় ছিল ২০২৭। কিন্ত গত ৯ই জুন ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থী মারিয়েন লা পেন’র ন্যাশনাল ফ্রন্টের বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল। ম্যাক্রোঁর ক্ষমতাসীন দলের শোচনীয় ফল হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁর সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সেই ভোট হয় ৩০ শে জুন প্রথম পর্বের ওই ভোটে দেখা যায়, লা পেন’এর দল পেয়েছে ৩৩ শতাংশ ভোট। আর, বামপন্থী দলগুলোর মোট মিলিতভাবে ভোট পেয়েছে ২৮ শতাংশ এবং ম্যাক্রোঁর দল ২১ শতাংশ ভোট পায়। ফ্রান্সের সংবিধান অনুযায়ী কোনও দল প্রথম পর্বে ৫০ শতাংশ আসনে জয় না পাওয়ায় তাদের দ্বিতীয় পর্বে “রান-অফ” ভোটের লড়তে হয়। এই ভোটে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রথম দফার ভোটে নূন্যতম ১২ শতাংশ ভোট পেতে হয়। ভোটের প্রাক মুহুর্তে গড়ে উঠেছিল বামপন্থীদের “নিউ পপুলার ফ্রন্ট” নামের জোট। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরকালে নয়া ফ্যাসিবাদ পরমাণু শক্তিধর ইউরোপীয় দেশ ফ্রান্সে ক্ষমতা দখল করলে শুধুমাত্র ইউরোপে নয় বিশ্বে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম দেবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের শ্রমজীবীদের স্বার্থ। এই দলের উত্থানের সুদুরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে বাধ্য। সংবাদ মাধ্যম থেকে আমরা জানলাম, গত চল্লিশ বছরের মধ্যে এই নির্বাচনেই সর্বোচ্চ ভোটদান হয়েছে, ৫৭.৭২ শতাংশ। এবার নির্বাচনে ভোট প্রচারে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ জন প্রার্থী। ত্রিশ হাজার নিরাপত্তা রক্ষী নিযুক্ত হয়েছে সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্যে।
বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে অনেক ধরনের মতভেদ ও দ্বন্দ্ব থাকলেও শেষ মুহুর্তে ন্যূনতম তিনটি কর্মসূচির ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে এই নির্বাচনী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। তিনটি বিষয়ের মধ্যে ছিল, (এক) শ্রমজীবীদের নূন্যতম মজুরি বৃদ্ধি; (দুই) নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া এবং (তিন) প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রায় দু’শোটি প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে বিভিন্ন দল। অবশ্য বামেদের এই পদক্ষেপ জনমত প্রভাবিত করতে পারে ধরে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর দলও কিছু প্রার্থীর নাম প্রত্যাহার করে।
৫৭৭ জন সাংসদকে নির্বাচিত করেছে ফরাসী নাগরিকরা। যার শীর্ষে আছে বামপন্থীদের জোট। দ্বিতীয় স্থানে ম্যাক্রোঁর দল “এনসেম্বল”, তৃতীয় স্থানে লা পেন’র ন্যাশনাল রালি। ফরাসি পার্লামেন্টে বাম দলগুলির জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট পেয়েছে ১৮২টি আসন। ম্যাক্রোঁর মধ্যপন্থী জোট পেয়েছে ১৬৮টি আসন। আর অতি দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি পেতে চলেছে মাত্র ১৪৩টি আসন। অর্থাৎ সরকার গঠনের জন্য ‘ম্যাজিক ফিগার’ ২৮৯। কোনও দল বা জোটেরই নেই। ত্রিশঙ্কু ফরাসি পার্লামেন্ট।
ক্ষমতাসীন দলের মুখ রক্ষা হলেও তাদের স্বস্তির কারণ নেই বরং চাপে পড়েছে। তাদের দলের প্রধানমন্ত্রী গ্যারিয়াল আটাল ইস্তফা দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। যদিও প্রথা মাফিক রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁর নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তাকেই কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। ওদের পার্লামেন্ট হাতেই আছে আইন তৈরির অধিকার। রাষ্ট্রপতির হাতে আছে বৈদেশিক দপ্তর ও পররাষ্ট্র দপ্তর। পার্লামেন্ট থেকে নির্বাচিত সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজজীবনের সব কিছু। তবে এটাও ঠিক বামেরা ম্যাজিক ফিগার ২৮৯ আসন পায় নি।
বামপন্থীরা নির্বাচনের ফল প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই দাবি করেছেন, “অবিলম্বে প্যালেস্তাইনের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃত দাও”।
পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, ২০২৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকছেন ম্যাক্রোঁই। ফ্রান্সে বর্তমানে আধা প্রেসিডেন্ট শাসিত শাসন ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে বিদেশনীতি রূপায়ণ কিংবা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন প্রধানমন্ত্রী। অতি দক্ষিণপন্থীরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মতান্তরের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ফ্রান্সে এ পর্যন্ত বার তিন বার আলাদা দলের হাতে পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্নকক্ষে রাশ। সর্বশেষটি ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সালের মাঝের সময়পর্বে। নিম্নকক্ষ বিরোধী দলের দখল থাকলে প্রেসিডেন্টের পদটি দুর্বল হয়ে যায়। আইন প্রণয়নের ব্যাপারে নিম্নকক্ষই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের উত্থাপিত ইস্যুগুলো গরিষ্ঠ অংশের মানুষের সমর্থন পেলেও, ফ্যাসিবাদের বিপদ থেকে যাচ্ছে। আজকে দুনিয়া জুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, প্রতি মুহুর্তে বেড়ে চলা কর্মহীনতা এবং বিশ্বের জ্ঞানের ভান্ডার খুলে যাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন জাতি, ভাষা, বর্ণের মানুষ এক জায়গায় চলে আসায় এক তাৎক্ষণিক ভয়-ভীতি ও সংশয়ের সৃষ্টি করছে। যা ফ্যাসিবাদের প্রসারে ব্যবহৃত হয়। ফ্যাসিবাদের জনমত নির্মাণে এটা মূল্যবান মুদ্রা। কারণ ভয় ভীতি ও উৎপীড়নকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদীরা। তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘৃণা এবং মানুষের মধ্যে বিভাজন তীব্র করে শোষণের রথ চালায়। ফ্রান্সেও ওরাই উত্থাপন করেছিল, অভিবাসন বন্ধের দাবি ও ইউরোপ ইউনিয়নের যুক্ত হওয়ার বিরোধিতা। যার ফলে তৈরি হচ্ছিল, অন্য ভাষার বা দেশের মানুষের সঙ্গে ঘৃণা ও বিভেদ সম্পর্ক। ফরাসি জনগণ আপাতত রুখে দিয়েছেন নয়া ফ্যাসিবাদের অগ্রগতি। আশি বছর আগের সেই দানবকে রুখে দেওয়ায় তাই উদ্বেলিত না হয়ে পারি! জানি প্রশ্ন আছে, কে হবেন প্রধানমন্ত্রী, কি করে পাশ হবে বাজেট ইত্যাদি।
আগামী ১৮ জুলাই ফ্রান্সে বসবে পার্লামেন্টের অধিবেশন। ওই দেশের ইতিহাসে এরকম নজির নেই। তবে আশার সঞ্চার করলো ৯ জুলাই ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কক্ষে বামপন্থী জোট ও মধ্যপন্থী জোটের নেতাদের ব্যক্তিগত মত বিনিময়ে মিলিত হওয়ায়। এদিনের ঘরোয়া আলোচনায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওলান্দে মধ্যস্থাতাকারীর ভূমিকায় ছিলেন। এই সভাকে জনগণের রায়কে মর্যাদা দিয়ে গ্রহণযোগ্য বা সাম্ভব্য বোঝাপড়ার সূত্র ঠিক করার তৎপরতা বলেই মনে করা যায়। ফ্রান্সে আপাতত নয়াউদারবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদ ধাক্কা খেয়েছে। যদিও আমরা ভারতে এখনও ওই পর্যায় থেকে দূরে আছি। তবে আমরাও পারবো।