বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

হামাস বনাম ইজরায়েল: বহু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না

হামাস বনাম ইজরায়েল: বহু প্রশ্নের উত্তর মিলছে না

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

গাজায় হামাস ও ইজরায়েলের যুদ্ধের অনেকগুলি বিষয় এখনও যথেষ্ট অস্পষ্ট।
এত ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে কেন ঠিক এই সময়েই হামাস ইজরায়েলের ওপর আক্রমণ চালাল, এই আক্রমণের রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্য কি, সেবিষয়ে হামাসের সুস্পষ্ট কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনটা নয় যে হামাসের কোনও বক্তব্যই নেই। আসলে এই যুদ্ধে গোটা বিশ্বের মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম ইজরায়েল, আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির বক্তব্যই প্রকাশ করে চলেছে। সমস্ত সংবাদই পরিবেশন করা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে শুধু হামাসের বিরুদ্ধেই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে ইজরায়েলের গাজা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে জমনত ও সমাবেশ সংগঠিত হচ্ছে তার খবরও খুব একটা সামনে আনা হচ্ছে না। এমনকী আরব দেশগুলি এবং আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশগুলির বক্তব্যও স্পষ্ট করে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবেশিত সমস্ত সংবাদেই গাজায় গণহত্যা, নির্বিচারে বাড়িঘর ধ্বংস, নারী ও শিশুহত্যা, এমনকী হাসপাতালের ওপর ইজরায়েলির হামলার পক্ষে যুক্তি সাজানো হচ্ছে।

গাজায় বাড়িঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মস্থান ও হাসপাতালের ওপর হামলা চলছে। ইজরায়েল যুক্তি দিয়েছে, সাধারণ মানুষজনকে ঢাল করছে হামাস জঙ্গিরা। তাই তাদের হঠাতে গিয়ে সব জায়গায় হামলা চালাতে হচ্ছে। এভাবেই যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করে তার সাফাই দিচ্ছে ইজরায়েল। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিকাংশ দেশই ইজরায়েলের একতরফা সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে, তবুও সেকথায় কান দিতে নারাজ ইজরায়েল ও তার মূল খুঁটি আমেরিকা। তাদের যুক্তি, হামাস সন্ত্রাসবাদী, তাই ওদের রেয়াত করা হবে না। ফলে প্রশ্ন ওঠে, পরমাণু বোমা না থাকা সত্ত্বেও ইরাকে মার্কিন হামলা, লিবিয়ায় গদ্দাফিকে হত্যা, ইরানকে একঘরে করে রেখে শায়েস্তা করা, রাষ্ট্রপতি বাসার আল আসাদকে উচ্ছেদ করতে সিরিয়াকে তছনছ করা, আফগানিস্তানকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা— গত তিন দশকে এগুলি নিখাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ছাড়া আর কি? হামাসের হামলার আগে ইজরায়েল গাজায়, প্যালেস্টাইনে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে দীর্ঘদিন ধরে যে নির্মম অত্যাচার চালিয়ে আসছে, তা সন্ত্রাসবাদের চেয়ে কম কিসে? ট্র্যাজেডি এটাই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের ভারসাম্য এখন বদলে গেছে। ফলে যারা সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী, গণতন্ত্রের পোশাক পরে তারাই হামাসকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গাজায় নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

গাজায় ইজরায়েলের অভিযান চলছে ৭ অক্টোবর থেকে। নভেম্বরের শেষে এসেও তা শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইজরায়েলের সেনার যা শক্তি, এবং যে ঢালাও সামরিক সাহায্য ও সমর্থন আমেরিকা দিয়ে চলেছে, তাতে ওইটুকু ভূখণ্ডকে কব্জা করতে এতদিন সময় লাগার তো কথা নয়। তাহলে এত সময় লাগছে কেন? তাহলে কি বড়সড় প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে ইজরায়েলি বাহিনীকে?

হামাসের হেফাজতে থাকা ২০০ ইজরায়েলি পণবন্দিরা বা কোথায়? শোনা যায়, তাদের মাটির তলার সুড়ঙ্গের জালের ভেতর লুকিয়ে ফেলেছে হামাস। তাই যদি হয়, তাহলে সুড়ঙ্গজাল ধ্বংস করে তাদের উদ্ধার করতে কতদিন লাগবে? এর আরও একটা মানে হল, ইজরায়েলি বাহিনী যতই দাবি করুক তারা হামাসের যোদ্ধাদের হত্যা করে হীনবল করে ফেলেছে, আসল ঘটনা তা নয়। তাই যদি হতো তাহলে পণবন্দিদের নিয়ে এতটা কঠোর অবস্থানে থাকত না হামাস।
পণবন্দি বিনিময় নিয়ে আলোচনা চলছে বলে মাঝে মাঝে কিছু খবর শোনা যায়। কাতারের উদ্যোগে সেই আলোচনায় থাকছে হামাস ও ইজরায়েলের প্রতিনিধিরা, এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশের প্রতিনিধি। কিন্তু সেই কূটনৈতিক উদ্যোগেরই বা কী হল? কী নিয়ে কথা হচ্ছে সেখানে? আলোচনা কি এগোল? এনিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব সব মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম।

ইজরায়েলের অভিযানের লক্ষ্য স্পষ্ট। হামলায় হামলায় প্রথম উত্তর গাজাকে ধ্বংস করে দাও। ওখন থেকে উচ্ছেদ করে দাও প্যালেস্তিনীয়দের। সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে যাও দক্ষিণ গাজায়। এবার একই ছকে হামলা চলবে দক্ষিণ গাজাতেও। এভাবে হামাসকে খতম করার নামে গোটা গাজাকে প্যালেস্তিনি মুক্ত করে দাও। তাতে যদি হাজার হাজার নারী-শিশু মারা যায়, ক্ষতি নেই। তাহলে যুদ্ধ শেষে গোটা গাজাকে দখলে এনে পৃথক প্যালেস্তিনিয় রাষ্ট্র গড়ার প্রশ্নটিকেই মুছে ফেলা যাবে। আসলে শুধু হামাস নয়, প্যালেস্তিনি রাষ্ট্রের দাবি ও অস্তিত্বকেই পুরোপুরি মুছে দিতে চায় আমেরিকা ও ইজরায়েল। তাদের লক্ষ্য, প্রবল শক্তিতে উপনিবেশবাদকে পুনরুজ্জীবিত করা। এছাড়া, জাতীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা নেতানিয়াহু। সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করে সব ক্ষমতা পেতে চান তিনি। ইজরায়েলে তার বিরোধিতা প্রবল। এমনকি সোচ্চার হয়েছে ইজরায়েলের সেনা বাহিনীর একাংশও। ফলে বিরোধী মতকে চাপা দিতে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষী যুদ্ধকেই হাতিয়ার করেছেন নেতানিয়াহু।
কিন্তু হামাস? তার লক্ষ্য কি? ইজরায়েলিদের পণবন্দি করার মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ দীর্ঘায়ত করতে চায়। সেটা করার সামরিক প্রস্তুতিও সম্ভবত তাদের আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মস্কো ও স্তালিনগ্রাডের যুদ্ধ থেকে আরবান ওয়ারফেয়ারের একটা নতুন ছক উঠে আসে। যদি জনগণকে সমাবেশিত করা যায়, তাহলে অসম শত্রুর বিরুদ্ধেও দীর্ঘকাল শহুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে শত্রুকে দুর্বল করে ফেলা যায়, তাকে পরাস্তও করা যায়, যেটা শহরের বাইরের খোলা ময়দানের যুদ্ধে পারা যায় না। মস্কো ও স্তালিনগ্রাডে লাল ফৌজের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাসিস্তদের ব্লিৎসক্রিগের গতি শ্লথ করে দিয়ে তাদের শক্তিকে ছড়িয়ে দেওয়া। এই অবসরে লালফৌজ সাইবেরিয়ায় তৈরি করে রিজার্ভ বাহিনী। পরে এই বাহিনীই পূর্ণশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফ্যাসিস্তদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

এই কৌশল হামাসের নেতারা জানেন না এমনটা নয়। ফলে গ্রাউন্ড অপারেশনে যতটা দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে ইজরায়েলি বাহিনী, ততটা কি কব্জা করতে পারছে হামাসের প্রতিরোধ জালকে? যদি না পারে তাহলে গাজা শহরের যুদ্ধও দীর্ঘস্থায়ী হবে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত যখন পণবন্দিদের উদ্ধারে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি ইজরায়েলি সেনা। ফলে এখানেও আরবান রেজিস্টান্সের আতঙ্কে ভুগতে হচ্ছে ইজরায়েলি সেনাদের।

আর যে প্রশ্ন পড়ে থাকে তা হল হামাসের রাজনৈতিক লক্ষ্য। এই হামলার ফলে হামাস যেভাবে কোণঠাসা হল তাতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে। একটা কথা শোনা যাচ্ছে, চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বোঝাপড়া ও দুই দেশের ব্রিকসে যোগ দেওয়ায় প্রমাদ গুনেছে আমেরিকা। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব খর্ব হওয়ার ভয়ে আমেরিকা চাইছিল প্যালেস্তাইন প্রশ্নকে উহ্য রেখে সৌদি ও ইজরায়েলের মধ্যে সখ্য তৈরি করতে। কিন্তু হামাসের হামলা আপাতত সেই সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দিল। এভাবে প্যালেস্তাইন প্রশ্নকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে এবং মার্কিন নেতৃত্ব সৌদি-ইজরায়েল বোঝাপড়া আপাতত ঠেকাতেই কি হামাসের এই হামলা? তাহলে কি এর পিছনে কারোর প্রচ্ছন্ন মদত রয়েছে? দেখা যাচ্ছে, ইরান তো বটেই, এমনকি সৌদির যুবরাজও বলে চলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে দুই পৃথক রাষ্ট্রই আসল সমাধান। অর্থাৎ পৃথক প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবি থেকে সৌদি সরে আসেনি। এটা আমেরিকা ইজরায়েলের এগোনোর পথে বড় কাঁটা।

সব মিলিয়ে, হামাস-ইজরায়েলযুদ্ধকে ঘিরে বহু রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনেতিক প্রশ্ন সামনে এসে পড়েছে যার উত্তর এখনও স্পষ্ট হচ্ছে না। এবং পশ্চিম ঘেঁষা মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম এই বিষয়গুলিকে ক্রমাগত আড়ালে রেখে যুদ্ধের একতরফা একটা ন্যারেটিভের জাল বুনে চলেছে। এই ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে আসল সত্যকে উদ্ধার করা দরকার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.