বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
সম্প্রতি জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনে উৎপাদন করা ব্যাটারিচালিত মোটর গাড়ির উপর ১০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে। বিষয়টা বাণিজ্য যুদ্ধের সমার্থক ও বিসদৃশ। এই ধরনের বাণিজ্য-যুদ্ধ অর্থাৎ নিজের দেশের শিল্পকে রক্ষা করার জন্য আমদানির উপর উচ্চহারে শুল্ক বসানো ব্যবস্থাকে সংরক্ষণ বা রুদ্ধদারবাদ বলে। রুদ্ধদারবাদ অবাধ বাণিজ্যের পরিপন্থী এবং সার্বিক অর্থনৈতিক প্রগতির বিরোধী। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ইতিহাসে দেখা যায় এই দুই পন্থা অর্থাৎ অবাধ বাণিজ্য ও রুদ্ধদারবাদ নীতির মধ্যে একটা বিরোধ সবসময়ই ছিল এবং এসব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আছে। অপরদিকে এই বিসদৃশতার বিষয়টা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাড়ি বা অটোমোবাইল শিল্পের আঁতুড় ঘর হেনরি ফোর্ডের দেশ। এখন গাড়ি শিল্প পুঁজিনিবিড়। কাজেই একটা পুঁজিনিবিড় দেশে অপর দেশের পুঁজিনিবিড় পণ্য (গাড়ি)প্রবেশ করেছে, এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের তত্ত্বে মেলে না। এই জন্যই এটা বিসদৃশ। এই নাতিদীর্ঘ আলোচনায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই দুটি বিষয় পর্যালোচনা করা হবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সিদ্ধান্তের ফলাফল আলোচনা করা হবে।
অবাধ বাণিজ্য ও রুদ্ধদারবাদ নীতির মধ্যেকার বিরোধের আদর্শ উদাহরণ হল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ব্রিটিশ অর্থনীতি। এই সময়টা ছিল প্রথম শিল্প বিপ্লবের যুগ। বাষ্পচালিত যন্ত্রসভ্যতার যুগ। এই সময় ব্রিটেনের উদীয়মান শিল্পপতিরা আমেরিকা থেকে সস্তায় গম আনার পক্ষে ছিলেন। শিল্পপতিদের যুক্তি ছিল, সস্তায় গম সরবরাহ করা হলে শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের মজুরি বেশি বাড়াতে হবে না। এর ফলে শিল্পপতিদের লাভের হার হ্রাস পাবে না। অপরদিকে ব্রিটেনের ভূস্বামীবর্গ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে শস্য (গম)আমদানির উপর নানারকম শর্ত আরোপের পক্ষপাতী ছিলেন। কারণ ভূস্বামীবর্গ বুঝেছিলেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবাধে গম আমদানি হলে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত গমের চাহিদা কমে যাবে। অর্থাৎ তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে। অবাধ বাণিজ্য ও রুদ্ধদারবাদ নীতির মধ্যে এই বিরোধের নিষ্পত্তি হয় ১৮৪৬ সালে। তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পীল অবাধ বাণিজ্যের স্বপক্ষে ১৮১৫ সালে প্রবর্তিত শস্য আইন রদ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটেনের ভূস্বামীবর্গ ও উদীয়মান শিল্পপতিদের মধ্যেকার এই সামাজিক অভিঘাতের পরিশীলিত রূপ দেখতে পাওয়া যায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডোর ‘তুলনামূলক সুবিধা’র তত্ত্বের মধ্যে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমণ্ডলে ১৮১৭ সালে সূত্রায়িত রিকার্ডোর ‘তুলনামূলক সুবিধা’–র তত্ত্বে একথা বলা হয়, যে দেশের যে পণ্য উৎপাদনে তুলনামূলক সুবিধা থাকবে, সেই দেশ সেই পণ্যটি উৎপাদন এবং রপ্তানি করবে। এই ভাবে বাণিজ্য সংগঠিত হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। সূত্রাকারে তত্ত্বটি হল, দুটি দেশের মধ্যে যদি তুলনামূলক ব্যয় পার্থক্য থাকে এবং দুটি দেশের বাণিজ্য হার (টার্মস অফ ট্রেড)যদি দেশ দুটির ব্যয়ের অনুপাতের মধ্যে থাকে তবে উভয় দেশই লাভবান হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রিকার্ডোর যুক্তি ছিল, ব্রিটেনে যদি শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে এবং আমেরিকা যদি গম উৎপাদন করে এবং পণ্য বিনিময় অবাধে হয়, তাহলে উভয় দেশই লাভবান হবে।
রিকার্ডের এই ‘তুলনামূলক সুবিধা’–র তত্ত্বটির প্রায় একশ বছর পরে ১৯১৩ সালে সুইডিশ অর্থনীতিবিদ হেকশ্চার ও তাঁর ছাত্র ওলিন বিষয়টি ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁরা লক্ষ্য করেন একটি প্রচুর পুঁজিসম্পন্ন দেশের রপ্তানি আসে পুঁজিনিবিড় শিল্প থেকে এবং প্রচুর শ্রমসম্পন্ন দেশগুলি এই ধরনের পণ্য আমদানি করে। বিনিময়ে এই দেশগুলো শ্রমনিবিড় পণ্য রপ্তানি করে। তাঁদের বক্তব্য হল, পুঁজির প্রাচুর্যপূর্ণ দেশ পুঁজিনিবিড় পণ্য রপ্তানি করবে, বিপরীতে শ্রমের প্রাচুর্যপূর্ণ দেশ শ্রমনিবিড় পণ্য রপ্তানি করবে। এর ফলে উভয় দেশই লাভবান হবে। তাঁদের এই তত্ত্ব সাধারণভাবে ‘ফ্যাক্টর এনডাউমেন্ট’তত্ত্ব নামে পরিচিত।
১৯৫৪ সালে রুশ–আমেরিকান অর্থনীতিবিদ লিয়নতিয়েভ এই ‘ফ্যাক্টর এনডাউমেন্ট’তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করেন। পরীক্ষার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯২টি শিল্পকে নির্বাচন করেন। পরীক্ষায় দেখা যায়, গত শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত পণ্যগুলি তাদের রপ্তানিকৃত পণ্যগুলির তুলনায় অনেক বেশি পুঁজিনিবিড় ছিল। লিয়নতিয়েভ হিসেব করে দেখিয়েছেন, এই সময়ে আমেরিকায় আমদানিকৃত পণ্যগুলির পুঁজি নিবিড়তার হার রপ্তানিকৃত পণ্যগুলির তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি ছিল। এর অর্থ হল হেকশ্চার-ওলিন তত্ত্ব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় পুঁজি বেশি। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলধন নিবিড় পণ্য রপ্তানি করবে এবং শ্রমনিবিড় পণ্য আমদানি করবে। লিয়নতিয়েভের পরীক্ষায় দেখা যায় বাস্তবে এর বিপরীতটাই ঘটছে। এটাই হল ‘লিয়েনতিয়েভ প্যারাডক্স’, যা এখনও বর্তমান। এটাই হল বিসদৃশতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি অনুধাবনে সাহায্য করবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘লিয়েনতিয়েভ প্যারাডক্স’–এর বাস্তবতার ব্যাখ্যা নিহিত আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে। যুদ্ধোত্তর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে চারটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। এগুলি হল গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর ‘আউটসোর্সিং’উৎপাদন পদ্ধতি, ষাট ও সত্তরের দশক জুড়ে ভারী শিল্পের পতন তথা ‘অবশিল্পায়ন’, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সম্প্রসারণ ও ২০১০ সালের গোড়া থেকে ‘গ্রিন টেকনোলজি’ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ওপর জোর। ১৯৫০ এর দশকে দেখা যায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি অধিকতর মুনাফার জন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে স্বল্প মজুরির দেশে স্থানান্তরিত করার উপর জোর দিয়েছে। ফলত দেখা যায় ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির তিন ভাগের একভাগ আসে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বিদেশি শাখাগুলি থেকে। এই বিষয়টা কলেবরে বেড়েছে যা ‘আউটসোর্সিং’নামে পরিচিত। ‘আউটসোর্সিং’এর হাত ধরে আসে ভারী শিল্পে মন্দা এবং আশির দশকের গোড়ায় ইস্পাত শিল্প ও গাড়ি শিল্প বড় ধাক্কা খায়। অনেক ইস্পাত উৎপাদন সংস্থা ও গাড়ি উৎপাদক সংস্থা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। এদের মধ্যে জেনারেল মোটরস ও ক্রাইসলার অন্যতম। কম তেলে চলা, ছিমছাম জাপানি গাড়ি টয়োটা ও হোন্ডা মার্কিন গাড়ির বাজার দখল করে নেয়। কারণ একটাই। জাপানি শ্রমের খরচ আমেরিকার থেকে কম। ভারী শিল্পের পতনজনিত ‘অবশিল্পায়ন’এর ধাক্কায় সাবেকি ‘ইস্পাত বেল্ট’তার জৌলুস হারিয়ে ‘মরচে বেল্ট’–এ পরিণত হয় এবং বহু মানুষ কর্মহীন হন। নব্বইয়ের দশকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে বিপ্লব আসে। ‘কম্পিউটার প্রযুক্তি’এই ‘অবশিল্পায়ন’–এর অন্ধকার অনেকটা প্রশমিত করে। তবে আমেরিকার জাতীয় আয়বৃদ্ধিতে এই অবশিল্পায়নের প্রভাব দেখা যায়নি। তবে অর্থনীতিবিদ ক্রেয়ানক্রস ও লেভার দেখিয়েছেন, এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোতে ভরকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটেছে। ভরকেন্দ্র ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে সেবাক্ষেত্রে সরে গেছে। ২০১০ সালের শুরু থেকে মার্কিন অর্থনীতিতে ‘গ্রিন টেকনোলজি’ও ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’প্রসূত শিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র প্রয়োগ গাড়ি শিল্পে ঘটছে। ইলন মাস্ক চালকহীন রোবট গাড়ি তৈরি করেছেন। একইভাবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটারিচালিত চীনা গাড়ি আমেরিকার গাড়ি বাজারে উপস্থিত হয়েছে। কারণ একটাই। চীনা নির্মাতারা আমেরিকান নির্মাতাদের তুলনায় ব্যাটারি চালিত গাড়ি সস্তায় উৎপাদন করেন ও অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রয় করেন। সব মিলিয়ে মার্কিন গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো এক অদ্ভূত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। একে রক্ষা করার জন্যই বিদেশি (চীনা) গাড়ির উপর ‘প্রতিশোধমূলক শুল্ক’–এর আয়োজন। নয়া উদারবাদের যুগের মূলমন্ত্র হল অবাধ প্রতিযোগিতা, অবাধ বাণিজ্য ইত্যাদি। অথচ বাস্তবে ঘটছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। অবাধ বাণিজ্য এবং সংরক্ষণ মধ্যে বিরোধ বিশ্বের অর্থনীতিকে আরও তীব্র সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।