বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন প্রয়াত হয়েছিলেন ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের পর লেনিন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ে কালজয়ী আলোচনা করেছিলেন নানা প্রবন্ধ ও পুস্তকে। এক শতাব্দী পরেও পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সেই সব আলোচনা সমাজ গবেষকদের আলোচ্য বিষয়। আজ ১০০ বছর পরেও মানবসভ্যতার প্রধান শত্রু সাম্রাজ্যবাদ। মার্কস-এঙ্গেলস পুঁজিবাদের এই বিভৎস রূপ দেখে যান নি। লেনিন, স্তালিন, মাও দেখেছেন; এই সভ্যতা-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগ্রামের এযাবৎ কালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, রাশিয়ার সোভিয়েত বিপ্লবের প্রধান রূপকার লেনিন। তিনি নির্বাসিত অবস্থায়, ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তাঁর কালজয়ী রচনাটি লিখেছিলেন।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্ক লেনিনের তত্ত্বকে বিকৃত করার চেষ্টা তাঁর জীবদ্দশাতেই শুরু হয়েছিল। আজ, মূলত লেনিন-প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুতির ফলেই সাম্রাজ্যবাদ বেঁচেবর্তে থাকছে এবং শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এসময়ে কয়েকটা কথা স্পষ্টভাবেই বলা দরকার।
লেনিন জীবনে কোথাও, কখনও, একবারের জন্যেও বলেননি যে, সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের ‘সর্বোচ্চ স্তর’ (Highest Stage)। মার্কসের মৃত্যু হয় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে; এঙ্গেলসের ১৮৯৫-তে। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ লেখায় লেনিন পুঁজিবাদ নিয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। ১৯১৩ পর্যন্ত তিনি অন্তত নয়টি এরকম আন্তর্জাতিক তাৎপর্যপূর্ণ লেখা তৈরি করেছিলেন। এরপর জুরিখে (সুইজারল্যান্ড) নির্বাসিত অবস্থায় ১৯১৬ সালে (জানুয়ারি-জুন) তিনি রচনা করেন পুঁজিবাদ সম্পর্কে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনাটি।
বইটি প্রকাশকের কাছে পৌঁছানোর পর, পরিচালকমণ্ডলীর মধ্যেকার মেনশেভিকরা সেইসব অংশগুলো বাদ দিয়ে দেন - যেখানে যেখানে কাউটস্কি আর মার্তভকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছিলেন লেনিন। মূল লেখাটির এমন সংশোধন তাঁরা করেন, যা শুধু লেনিনের লেখনশৈলীকে বদলায় নি, তাঁর মূল বক্তব্যকেও বিকৃত করেছিল। পুঁজিবাদ ‘বেড়ে উঠেছে’ সাম্রাজ্যবাদে, লেনিনের এই বক্তব্যকে পাল্টে দিয়ে করা হয়েছিল ‘পরিবর্তিত’ হয়েছে সাম্রাজ্যবাদে। অতি-সাম্রাজ্যবাদ (ultra-imperialism)-এর ‘প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র’কে পাল্টে করা হয়েছিল ‘পশ্চাদপদ বৈশিষ্ট্য’; ইত্যাদি।
শেষপর্যন্ত ২৬ এপ্রিল ১৯১৭, লেনিনের ভূমিকা সহ যে বইটি প্রকাশিত হয় তার শিরোনাম ছিল, ‘সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সাম্প্রতিক স্তর (একটি জনপ্রিয় রূপরেখা)।’ ‘Imperialism, the Latest Stage of Capitalism (A Popular Outline)’। এই হল অপ্রচলিত ইতিহাস! (লেনিন, সংগৃহীত রচনাবলী, ভল্যুম ২২, প্রগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো, ১৯৬৪, পৃ: ৩৭৬-৩৭৮ দেখুন।)
লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে কখনও বলেছেন, পুঁজিবাদের এক ‘বিশেষ স্তর’ (Special Stage)। কখনও হয়তো বলেছেন, ‘খুব উঁচু স্তর’ (Very High Stage)। কখনও বা ‘একচেটিয়া স্তর’ (Monopoly Stage)। কিন্তু কখনোই ‘সর্বোচ্চ স্তর’ (Highest Stage) বলেননি। কারণ তিনি মনে করতেন, ‘একচেটিয়া হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে উচ্চপর্যায়ে যাবার এক মধ্যবর্তী সিস্টেম।’ সেইজন্যেই তিনি লিখেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের সংক্ষিপ্ততম সম্ভাব্য (possible) সংজ্ঞা হচ্ছে’ – ‘সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর।’ তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী গণৎকার ছিলেন না, যে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো নিদান দেবেন, ইহাই ‘সর্বোচ্চ’ অথবা ‘শেষ’। পুঁজিবাদকে তিনি এক চলমান বাস্তবতা হিসাবেই দেখেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন। একজন যথার্থ সমাজবিজ্ঞানী হিসাবেই তিনি বলেছেন, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার পথে যে একচেটিয়াগুলো গড়ে উঠেছে, তারা মুক্ত প্রতিযোগিতাকে বরবাদ করে দেয়নি। বরং তার পাশাপাশিই থাকে। এবং এইভাবে অজস্র তীব্র ও গভীর বৈরিতা, টক্কর এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।’ (সংগৃহীত রচনাবলী, ভল্যুম ২২, পৃঃ ২৬৬ দেখুন।) বোঝা যায়, কেন সাম্রাজ্যবাদ আজও টিঁকে থাকতে পারে – পুঁজিবাদের অজস্র তীব্র ও গাঢ় বৈরিতা, টক্কর ও সংঘর্ষ সত্বেও। ‘ঐতিহাসিকভাবে’ মৃত্যুপথযাত্রী হলেও, সাম্রাজ্যবাদ ‘অর্থনৈতিকভাবে’ আজও নানারকম কৌশলে দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াতে পারে। তারা বিবর্তনের শেষ ধাপে এখনও পৌঁছায়নি।
পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ এখন আর বলিষ্ঠ কমিউনিস্ট প্রত্যাঘাতের-প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় না! এটাই কঠোর বাস্তব। পুঁজিবাদী দুনিয়া নিজেদের মধ্যেকার বৈরিতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংঘর্ষের পরিণতিতে যখন নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হয়, শ্রমজীবী দুনিয়া তখন আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু আমাদের এখানে লেনিনের অভাব না, লেনিনের বক্তব্যকে নিজেদের মনমতো গড়েপিটে নেওয়াই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে! পুঁজিবাদের দাপট বৃদ্ধির পাশাপাশি, সমাজবাদী শক্তির ক্রমশই দেয়ালে পিঠ ঠেকার মতো অবস্থা হয়েছে! আর ‘দুনিয়ার ভয়ঙ্কর নেতিবাচক পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখিয়ে, আমরা নিজেদের মুখরক্ষার চেষ্টা করছি!
ক্রিস্টোফার কলম্বাস তাঁর বাহিনী নিয়ে ইউরোপ থেকে সমুদ্রপথে পাড়ি দিয়েছিল ‘নতুন আবিস্কার’-এর জন্য যার আসল উদ্যেশ্য ছিল দখলদারি ও লুটপাট। পাঁচশো আঠারো বছর আগে দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের যে প্রচেষ্টা শুরু তা আজও জারি আছে। পুঁজিবাদ তার শোষক চরিত্র বদলায়নি। সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্যবাদী লক্ষ্য বর্জন করে নি। কৌশলের অদলবদল ঘটিয়েছে শুধু।
ভারত মহাসাগরে প্রথম ‘ঘাঁটি’ গড়ে তোলার জন্য, বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখলের যে চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা, তাও পাঁচশো বছরের আধিপত্যবাদী চরিত্রেরই ধারাবাহিকতা। ‘বাংলাদেশ’ যেভাবে নব-পাকিস্তান হবার পথেই হাঁটছে, সেই বিষয়টিও যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনার ফসল, তাও ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেশে-দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাত সংঘর্ষের যে ভয়াবহ ও সর্বনাশা ঘটনাবলী পৃথিবীকে অস্তিত্বের সঙ্কটে জেরবার করে তুলছে, তার পিছনেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা।
শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শক্তিই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখেনি। অকল্পনীয় সামরিক শক্তি তার বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত। ২০২৪-এ আমেরিকার মিলিটারি বাজেট হল ৯১৬ বিলিয়ান ডলার। যেখানে রাশিয়ার মিলিটারি বাজেট আমেরিকার মিলিটারি মাত্র ৯% (৮৬.৪ বিলিয়ান ডলার)। আর চীনের ৪০৮ বিলিয়ন, যা আমেরিকার ৪৫%। পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের সংখ্যা: আমেরিকার ৭,২০০; রাশিয়ার ৫,৯৭৭; চীনের ২৬০। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আজও বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আগ্রাসী শক্তি।
‘মারিচ সংবাদ’ নাটকের কথা মনে আছে? সেখানে গানের কথা ছিল, ‘সোনা চাই দানা চাই… মোগলাই খানা চাই… সবচেয়ে বেশি করে চাই, বশ্যতা মানা চাই, গোটা দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় আনা চাই।’ এটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্য। কলম্বাস থেকে বাইডেন, একই পুঁজিবাদী আধিপত্যের উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে। ১৭৬৫-১৯৩৮ ভারত থেকে ব্রিটিশদের লুন্ঠনের সম্পদ মূল্য ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা। এটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ। রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৭ অক্টোবর, ২০২৪এর এক রিপোর্টে বলছে, পৃথিবীর ১১০ কোটি মানুষ ‘চরম দারিদ্রের মধ্যে’ বেঁচে আছে। ‘প্রযুক্তিগত উন্নতি’ কখনোই জনগণের স্বার্থে নয়, পুঁজিবাদীদের স্বার্থে।
কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই মাতব্বরির বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক স্তরেও দেশে দেশে আওয়াজ উঠছে: বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার; বর্ণবৈষম্যের বিপক্ষে; ‘জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’-এর সপক্ষে; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জটিল নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে; বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী গণহত্যার বিরুদ্ধে।
লেনিন তাই আজও একই রকম প্রাসঙ্গিক। লেনিনের ‘ভুল’ ‘সীমাবদ্ধতা’ নিয়ে পণ্ডিতদের ‘তত্ত্ব’ পুঁজিবাদকে এতটুকুও ঘায়েল বা দুর্বল করতে পারেনি। লেনিনের বিপ্লবী তত্ত্ব দুনিয়ার সামনে পুঁজিবাদকে চিনিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড রাশিয়ার বুকে পুঁজিবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে সমাজতন্ত্রের দিকে প্রথম বিজয়। সেই পথের ধারাবাহিকতায় সমাজতান্ত্রিক অভিমুখী আন্দোলন পৃথিবী জুড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের রাস্তা গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। পরবর্তীকালে ব্যর্থতার দায় অনিবার্যভাবে উত্তরসূরিদের; কখনোই লেনিনের না।
লেনিন লিখেছিলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই একেবারেই ফাঁকি এবং ভনিতা, যদি না তা সুবিধাবাদ-বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়।’ বর্তমানের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সেই সুবিধাবাদই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রবণতা! ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, অথবা তাইওয়ান-চীন, কিম্বা ইউক্রেন-রাশিয়া, প্রতিটি সংকটের মধ্যমনি হিসাবে আজও থাকতে পারছে আমেরিকা। নতুন যে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে মানবসভ্যতা আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তার পিছনেও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ মূল কারণ। বিশ্বে অনেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি থাকলেও, যুগযুগ ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই সবচেয়ে আধিপত্যবাদী, আগ্রাসী, হত্যাকারী ভূমিকা পালন করে চলেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজও পুঁজিবাদী দুনিয়ার পাণ্ডা।
লেনিনের মৃত্যু-শতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার শ্রেষ্ঠ উপায়, তাঁর দেখানো পথে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিরোধ করার বাস্তব পথ অনুসরণ। ১৯২২ সালের এপ্রিল ও জুন মাসে, আন্তর্জাতিক স্তরে লেনিনের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিনিধি ‘সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ’-এর জন্য লড়াই শুরু করেন। ১৯২৫ (ডিসেম্বর), ১৯২৭ (নভেম্বর), ১৯২৮ (মার্চ), – এমনকি ‘সকল দেশের সমরাস্ত্র কমানোর’ সোভিয়েত-প্রস্তাবও আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান ইত্যাদি যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সুচতুর শয়তানির ফলে ব্যর্থ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক স্তরে যুদ্ধহীন ও অস্ত্রহীন পৃথিবীর জন্য লড়াইয়ের পথিকৃৎও লেনিন।