বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
মানবসমাজ কী সত্যিই ‘সভ্য’ হয়েছে!
প্রশ্নটা দিনদিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এড়িয়ে গিয়ে লাভ নেই।
সাম্প্রতিককালে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধ প্রতিদিন, সরাসরি এই প্রশ্ন করছে আমাদের। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আস্কারায় আগ্রাসন চালিয়ে, পুরো প্যালেস্তাইনের জমিই প্রায় দখল করে নিয়েছে ইজরায়েল। সাম্প্রতিককালে তারা বীভৎস গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্তাইনের গাজা ভূখণ্ডে। আঘাত হানতে শুরু করেছে অন্যান্য দেশেও। বাকি ‘সভ্য’ পৃথিবী কী করছে সেখানে? এ ওকে অস্ত্র পাঠাচ্ছে; ওই দেশ কঠোর সাবধানবাণী শুনিয়েছে; ওরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে; এতোগুলো দেশ তীব্র নিন্দা করেছে এই আগ্রাসনের; একের পর এক সম্মেলন চলছে যুদ্ধের নিন্দা করে! পাশাপাশি, অসভ্য বর্বরতাও ধ্বংস করে চলেছে সভ্যতার অস্তিত্বকে। লক্ষ লক্ষ ফুলের কুঁড়ির মতো শিশু মুছে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে! স্কুল, হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র, ওষুধ-জল-বিদ্যুৎ, উপাসনালয় কিছুই রেহাই পাচ্ছে না পুঁজিবাদী দানবদের হিংসা থেকে। খাদ্য সরবরাহ আটকে দিচ্ছে তারা। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার সময়েও জামাকাপড় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না গাজায়। আবার, গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞ বর্বরতার সঙ্গে চলছে নর-দানবদের তরফ থেকে অসহ্য হুমকিও।
সভ্য দুনিয়া যেন কার্যত মেরুদণ্ডহীনতার পথেই হাঁটতে চাইছে! ‘কূটনীতি’, ‘অর্থনীতি’, ‘রাজনীতি’ ইত্যাদি কত কিছুই না ভাবতে হবে! বর্বরদের বিরূদ্ধেও ‘সভ্য’ পথেই যেন হাঁটতে চাইছে ‘সভ্য’ দুনিয়া। শতাধিক বছর ধরে নানা দেশের হাতে এতো মারনাস্ত্র জমা হয়েছে, তা দিয়ে নাকি পুরো পৃথিবীটাকেই অন্ততপক্ষে সাতবার গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। এটাই ওয়াকিবহাল বিজ্ঞানীদের মত। সেগুলো অপেক্ষা করছে কার জন্য? নিশ্চয়ই ইজরায়েল বা আমেরিকার মতো সভ্যতা ধ্বংসকারী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য না। বরং যাঁরা ধ্বংসকারীদের ধ্বংস করে বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। সেইজন্যই নানা দেশে প্রতিমুহূর্তে তৈরি হচ্ছে আধুনিকতম মারণাস্ত্রের বিপুল ভাণ্ডার। প্রধানত বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি মারফত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুনাফার লোভে। যত যুদ্ধ, যত হানাহানি, ততই অস্ত্রশস্ত্রের বাজার ফুলেফেঁপে ওঠা। অস্ত্রশস্ত্র রপ্তানিকারীদের ততোই মুনাফার সুযোগ। এটাই হল যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। এ তো আর ধূপকাঠি তৈরির কারবার না। যুদ্ধজাহাজ অথবা যুদ্ধবিমান কিংবা আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল বিক্রির মতো কারবার। এইসব লেনদেনের মূল্য দিয়ে হয়তো পৃথিবীর বুক থেকে মানুষের অপুষ্টি পুরোপুরি দূর করা যেত। কিন্তু পুঁজিবাদী দুনিয়ায় ‘অর্থনৈতিক মুনাফা’ আর ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’-র লোভ এমনই ভয়ঙ্কর যে, কোটি কোটি আবালবৃদ্ধবনিতার জীবন তাদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ। তাই, যুদ্ধ অনেক বেশি জরুরি!
প্যালেস্টাইনের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে, ইজরায়েল বা আমেরিকার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সাবধানবাণী কেন ঘোষণা করতে পারছে না ‘সভ্য’ শক্তিগুলো! বাধা কিসের? ‘কূটনীতি’ অথবা ‘গণতন্ত্র’ কিংবা ‘সভ্যতা’, কিসের বাধা? আগ্রাসন, আধিপত্য, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার মূল পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা নেওয়াই এই মুহূর্তে প্রকৃত মানবতার দাবি। ইরান যখন আজ পাল্টা মারের ঝড় তুলেছে আগ্রাসী ইজরায়েলের বিরুদ্ধে, মার খেতেখেতে নুয়ে পড়া মানবসমাজ তখন উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
১৫ জুন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরানের আধিকারিক রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘কাতার এবং ওমানের মধ্যস্থতাকারীদের ইরানিরা জানিয়ে দিয়েছেন, ইজ়রায়েলের হামলার প্রত্যাঘাত সম্পূর্ণ হওয়ার পরে আলোচনায় কথা ভাবা হবে। তার আগে নয়।’’
আদর্শ, নীতি, ধর্ম, সবকিছুই পরে বিচার্য। আগে মানুষের জীবন ও আত্মমর্যাদাবোধ। এটাই ইজরায়েল ও আমেরিকার আগ্রাসী নীতির বিরোধী শক্তিগুলোর এই মুহূর্তের অবস্থান হওয়া উচিত। ‘সভ্যতা’র গান শুনিয়ে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের কোনও শিক্ষাই দেওয়া সম্ভব না। ‘যেমন বুনো ওল, তেমন বাঘা তেঁতুল।’
লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া একশো বছর আগে যে অস্ত্রবিরোধী মহত্তম লড়াই শুরু করেছিল, আমেরিকা ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি ইত্যাদি যুদ্ধবাজ পুঁজিবাদী দেশগুলো সেই চেষ্টা ভেস্তে দেয়। ইজরায়েল বা আমেরিকার মতো দানবীয় শক্তিগুলো সেই জন্যেই আজও দাপিয়ে বেড়াতে পারছে।
বিশ্বজুড়ে সকল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশের আজ গণদাবি ওঠা দরকার: “ইজরায়েল ও আমেরিকাকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলো: এইমুহুর্তে সমস্ত অমানুষতা থামাও। নাহলে নিজেদের শেষ মুহূর্তের জন্যে তৈরি থাকো।”
শুধুমাত্র ‘প্রতিবাদ’-এর সময় এটা নয়।