বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২— দীর্ঘ দু’বছরের বেশি সময় ভাইরাসের প্রকোপে আমরা মানসিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রায় সব দিক থেকে ধ্বস্ত। আমরা এর থেকে পরিত্রাণ চাইছি। এরকম শূণ্যতার মাঝেই বিভিন্ন বুজরুকি, ওষুধের অপবিজ্ঞান, রাজনৈতিক জগতে অবিবেচকের মতো মন্তব্য চলতে থাকে। আমজনতা যাহোক কিছু একটা আঁকড়ে ধরে এর থেকে পরিত্রাণ চায়। আবার বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকের চিন্তা, ব্যবসায়ী বা রাজনীতির চিন্তা, রাষ্ট্র কিংবা আমজনতার ভাবনা একইরকম ধারায় চলে না। হামেশাই বিজ্ঞানীদের সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তার বিরোধ ঘটে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের রিপোর্ট (৬ ডিসেম্বর, ২০২১) জানাচ্ছে, “লার্নিং লসেস ফ্রম কোভিড-১৯ কুড কস্ট দিস জেনারেশন অফ স্টুডেন্টস ক্লোজ টু ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার ইন লাইফটাইম আর্নিংস”। ক্ষতির পরিমাণ অকল্পনীয়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে ১৬০ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীর পড়াশুনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ডেটাবেস (২০২১) অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনীদের হাতে বিশ্বের মোট সম্পদের ৩৮% রয়েছে। ভারতে অতিমারির কারণে ২৩ কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, মে ৬, ২০২১)। এজন্য তিক্তস্বরে বলা হয়েছে দারিদ্র্য হয়ে উঠেছে অতিমারি।
এরকম একটি প্রেক্ষিতে সার্স-কোভ-২-এর নতুন অবতার ওমিক্রন (বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা যাকে “ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন” বলেছে) নিয়ে কথা বলা যায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার “টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসরি গ্রুপ অন সার্স-কোভ-২ ভাইরাস এভোল্যুশন” গত ২৬ নভেম্বর সার্স-কোভ-২-এর যে নতুন প্রজাতি “ওমিক্রন” (গ্রিক অ্যালফাবেট অনুযায়ী নামকরণে ইংরেজির O) আফ্রিকায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে তাকে VOC (ভ্যারিয়েন্ট অফ কনসার্ন) বলে অভিহিত করেছে। পৃথিবীর সমস্ত সাধারণ মানুষ, ঘরপোড়া গরু। তাই সিঁদুরে মেঘে ডরায়। যতই “নিউ নর্ম্যাল”-এর মতো আদুরে নামে ডেকে একে স্বাভাবিক বানানোর চেষ্টা হোক না কেন, আমাদের এ জীবন পূর্ণত অ-স্বাভাবিক।
নতুন চেহারার মিউটেশনের বৈজ্ঞানিকদের কাছে পরিচিতি B.1.1.529 ভ্যারিয়েন্ট তথা ওমিক্রন নামে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হয় ২৪ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২৬ নভেম্বর, ২০২১-এ পৃথিবীর সমস্ত দেশের কাছে জেনোমিক সার্ভেলেন্স এবং “অ্যাসোসিয়েটেড মেটাডেটা” সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা পাঠিয়েছে। আমাদের মতো যেসব দেশে জেনোমিক স্টাডি এবং সেরো-সার্ভেলেন্স-এর ব্যবস্থা দুর্বল, পাবলিক হেলথ সিস্টেম ভঙ্গুর এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেহাল সেসব দেশে “অ্যাসোসিয়েটেড মেটাডেটা” বিশ্বাসযোগ্যভাবে সংগৃহীত হবে কিভাবে সেটা বাস্তবিকই চিন্তার বিষয়।
নতুন ভ্যারিয়েন্টে আরএনএ ভাইরাস হবার জন্য চরিত্রগতভাবে “এরর-প্রোন”। একটি ভাইরাস থেকে আরও অনেক ভাইরাসের জন্ম যখন হচ্ছে তখন এর আরএনএ-র অ্যামিনো অ্যাসিডের সজ্জা পরিবর্তিত হয়ে যায় যাকে মিউটেশন বলে। মিউটেশন যত বেশি হবে ভাইরাসের চরিত্রেরও তত বদল হবে। এর মধ্যে কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট বিপজ্জনক হয়, কিছু বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনা। আরেকটি বিষয় ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ – যাকে বলা হয় R0 (রিপ্রোডাক্টিভ নাম্বার)। করোনাভাইরাসের প্রথম যে জ্ঞাতির R0 কমবেশি ২-এর আশেপাশে ছিল। অর্থাৎ একজন মানুষ ২ জনকে সংক্রমিত করতে পারবে। তারা আবার ক্রমাগত জ্যামিতিক হারে সংক্রমণ ঘটাবে
এর আগে ডেল্টা-প্লাস ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে যে মৃত্যুমিছিল দেখেছি সেটার R0 ৬ থেকে ৮-এর মধ্যে ছিল। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে অনুমান করা যায় কি বিপুল পরিমাণ মানুষ অল্পসময়ের মধ্যে আক্রান্ত হবে। একদিকে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা, অন্যদিকে সংক্রমণের ক্ষমতা ওমিক্রনের ক্ষেত্রে দুটিই বিপুল। নেচার পত্রিকায় ২৭ নভেম্বর, ২০২১-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন জানাচ্ছে “হেভিলি মিউটেটেড ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট পুটস সায়েন্টিস্টস অন অ্যালার্ট”। এ প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, যে স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করে ভ্যাক্সিন তৈরি হচ্ছে সে স্পাইক প্রোটিনের যদি ৩০টির বেশি পরিবর্তন ঘটে তাহলে ভ্যাক্সিন কোন স্পাইক প্রোটিনকে রিসেপ্টরের সঙ্গে জোড় বাঁধাকে আটকাবে?

একাধিক বিপত্তি সম্ভব – (১) মানুষের দেহ বহিরাগত ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফাংগাস বা অন্য যে কিছু দিয়ে আক্রান্ত হলে শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম একটি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে শরীরের রক্তে প্রবাহিত নিট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির সাহায্যে। যদি ভাইরাসটি একটি প্রোটিনের চাদর তৈরি করে চোরের মতো এর হাত থেকে পালিয়ে যেতে পারে (evade) তাহলে প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর কার্যকরী হবেনা, এবং (২) যদি ইমিউন সিস্টেম ঠিকমতো উদ্দীপিত না হয় তাহলে মেমরি সেল কাজ করবেনা। পরিণতিতে আমাদের ইমিউনিটি আমাদের দেহকে ভাইরাসমুক্ত করতে পারবেনা।
এ ধারণা নেচার-এ প্রকাশিত “বিয়ন্ড ওমিক্রন: হোয়াট ইজ নেক্সট ফর সার্স-কোভ-২ এভোল্যুশন”-এ (৯ ডিসেম্বর, ২০২১) প্রাঞ্জল্ভাবে বলা হয়েছে – “আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ওমিক্রনে অনেকগুণ বেশি মিউটেশন থাকছে, বিশেষ করে স্পাইক প্রোটিন অঞ্চলে যে অঞ্চল দেহকোষকে চিনতে পারে। ব্লুমের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এই মিউটেশনগুলোর ফলে স্পাইকের কিছু অংশকে শরীরের অ্যান্টবডি আর চিনে উঠতে পারে না, যে অ্যান্টিবডি ভ্যাক্সিন নেবার ফলে কিংবা আগের কোন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের দরুণ তৈরি। কিন্তু এসমস্ত মিউটেশনগুলোকে ভালোভাবে বোঝার জন্য ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং এপিডেমিওলজিকাল স্টাডির বিশেষ প্রয়োজন পড়বে।”
এখানেই বিজ্ঞান ও তার পরবর্তনশীল ধারণার বৈশিষ্ট্য, এর সবল ভিত্তি। এসময় অব্দি যতটুকু জানা যাচ্ছে সেটুকু সবার কাছে প্রকাশ করা হবে। আবার নতুন তথ্যের ভিত্তিতে যখন নতুন তত্ত্বায়ন হবে তখন বিজ্ঞানের পুরনো ধারণা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এখানে কোন গুরুঠাকুরের মতো বলে দেওয়া নেই – “দ্যাখো, আমি আগেই বলেছিলুম না!” না, এতটা প্রজ্ঞার অধিকারী সৎ বিজ্ঞানচর্চা নয়। সে ক্রমাগত এবং ধীরে ধীরে জ্ঞান সংগ্রহ করে চলে সম্ভাব্য সমস্ত অঞ্চল থেকে, উৎস থেকে। এবং ভুল প্রমাণিত হলে পরিত্যক্ত হয়। যদিও এখানে স্পষ্টভাষায় বলে রাখা ভালো বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞানচর্চা এবং এর ফলাফল বহুক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক দানবীয় কর্পোরেট পুঁজির কঠোর ও শক্তিশালী প্রভাবে কর্পোরেট মুনাফার জন্য “ম্যানুফ্যাকচার” করা হয়। শুধু গবেষণাপত্র নয়, এমনকি টেক্সটবুক এবং আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল গাইডলাইনকেও কর্পোরেটরা প্রভাবিত। মেডিসিন, ইন্ডাস্ট্রি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।
সেল-এর মতো মান্য জার্নালে গত ২৪ ডিসেমবর, ২০২১ গবেষণার গুরুত্ব বিচার করে ১৫ জন গবেষকের গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে একটি প্রি-প্রিন্ট গবেষণপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে – (১) যারা ইতিমধ্যেই কোভিড-আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠেছে তাদের দেহে তৈরি নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ওমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের ক্ষেত্রে ৩০টির বেশি মিউটেশন ঘটার ফলে এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করবেনা, (২) পুনঃসংক্রমণ ঘটাতে পারে, এবং (৩) বিভিন্ন ধরনের ভ্যাক্সিনকে পরিমিতভাবে এড়িয়ে যেতে পারে ওমিক্রন (“ভ্যাক্সিন এসকেপ”)। “ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদ” এবং “ভ্যাক্সিন অসাম্য” ভাইরাসের নতুন নতুন স্ট্রেইন তৈরি হবার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। টিকাকরণ যত কম হবে তত বেশি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে। আবার যত বেশি সংক্রমণ হবে ভাইরাসের রেপ্লিকেশন তত বেশি হবে। রেপ্লিকেশন বেশি হওয়া মানেই মিউটেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে অন্তত ১০% জনসংখ্যাকে ভ্যাক্সিন দেবার কথা বলেছিল। ৫০টির বেশি দেশ এই টার্গেট মিস করেছে। তার মধ্যে বেশিরভাগই আফ্রিকা মহাদেশে।
নেচার-এ একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে “কোভিড-১৯: এনডেমিক ডাজ নট মিন হার্মলেস” শিরোনামে (২৭ জানুয়ারি, ২০২২)। এখানে জোর দিয়ে বলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে আমাদের মনোযোগ প্রয়োজন – (ক) একটি ইনফেকশন এনডেমিক, এপিডেমিক এবং প্যানডেমিক সব চরিত্রের হতে পারে। ২০২০ সালে পৃথিবীতে ৬০০,০০০-র বেশি মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে। অথচ ম্যালেরিয়াকে আমরা এনডেমিক বলি। একই বছরে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছে ১০,০০০,০০০ মানুষ, মারা গেছে ১৫ লক্ষ। (খ) হেলথ পলিসি এবং ব্যক্তি মানুষের আচরণ নির্ধারণ করবে বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্যে কোন ধরনটি “এনডেমিক ওমিক্রন” নেবে। (গ) সর্বব্যাপী একটি কুহকী ধারণা রয়েছে যে বিবর্তনের ফলে ভাইরাস ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের দ্বিতীয়বারের ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি এ ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। (গ) এজন্য আমরা (রাষ্ট্রনেতারা এবং আমজনতা) অলস আশাবাদকে দূরে সরিয়ে রাখবো। (ঘ) কি পরিমাণ মৃত্যু ঘটতে পারে এ ব্যাপারে আমাদের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী দরকার এবং সে অনুযায়ী পাবলিক হেলথ পলিসি তৈরি হবে। (ঙ) আমাদের ভাঁড়ারের সমস্ত হাতিয়ারের (সার্বজনীন টিকাকরণ, মাস্কের ব্যবহার, দূরত্ব রক্ষা করা, কার্যকরী অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, বেশি সংখ্যক টেস্ট এবং ঘরে যথেষ্ট পরিমাণে আলো-বাতাস খেলা) উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে। (চ) ভ্যাক্সিন সাম্য চাই। (ছ) এনডেমিক হলে ভাইরাস দুর্বল হবে এ ভ্রান্ত ধারণার অবসান হতে হবে।
ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় (নভেম্বর ৩০, ২০২১) প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল “দ্য ইনসাইড স্টোরি অফ দ্য ফাইজার ভ্যাক্সিন: এ ওয়ান্স-ইন-অ্যান-এপোক উইন্ডফল”। সংবাদে জানানো হল – “অ্যালবার্ট বোরলা (Albert Bourla) বিশ্বের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন চিফ এক্সিকিউটিভ হয়েছেন। যেহেতু টিকার ফলে বেশ কিছু দেশ এই গ্রীষ্মে তাদের অর্থনীতির দরজা আবার খুলে দিতে পেরেছে এজন্য ফাইজারের ‘বস’ কর্নওয়ালে জি-৭ সম্মেলনে জুন মাসে যোগ দিয়েছেন, তাঁর প্রাইভেট প্লেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের প্লেনের পাশেই পার্ক করা ছিল। কয়েক সপ্তাহ পরে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক্সে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিডে তাঁকে স্বাগত জানান। সরকারি আধিকারিকেরা স্মরণীয়কালের মধ্যে স্মরণ করতে পারছেননা যে কোন কর্পোরেট লিডারকে রাজকীয় আকাসাকা প্যালেস গেস্ট হাউসে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ৫৯ বছর বয়সী গ্রিস-জাত “অ্যালবার্ট”কে তার “ভালো বন্ধু” বলে অভিহিত করেছেন।” আরও জানানো হল – “প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ ইমেল, টেক্সট কিংবা ফোনে তাদের চাহিদামতো ভ্যাক্সিনের জন্য বোরলার সঙ্গে ক্রমাগত যোগাযোগ করে গিয়েছেন, কিছুক্ষেত্রে নিজেদের রাজনৈতিক কেরিয়ার বাঁচাতৈ পারবে এই উদ্দেশ্যে। যদিও ইজরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানায়াহু নির্বাচনে হেরে গেছেন কিন্তু এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে একদম প্রথম নামটি ছিল তাঁর। তিনি ৩০বার বোরলার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন।” বিপরীত চিত্র হচ্ছে, আফ্রিকান ইউনিয়ন ভ্যাক্সিন টিমের কোওর্ডিনেটর হাজারবার বলেও ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করতে পারেননি – “আমরা পরিত্যক্ত। অতিমারির প্লাবনে আমরা ডুবে গেছি।”
এ থেকে বোঝা যায়, কর্পোরেট জগতের সঙ্গে রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতা ও নীতিনির্ধারকেরা, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের শেকড় কত দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে। এমনিতেই ফরচুন-৫০০ থেকে প্রকাশিত লিস্ট অনুযায়ী ফার্মা কোম্পানিগুলোর মুনাফার পরিমাণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে সর্বোচ্চ। এই অতিমারি এবং একে মোকাবিলার জন্য ভ্যাক্সিনের ব্যবসা একে অভাবনীয় মুনাফার সুযোগ দিয়েছে।
২০২১ সালে ফাইজার কোম্পানির ভ্যাক্সিন থেকে মুনাফার পরিমাণ ৩৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে মোট মুনাফা হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। মডার্না কোম্পানি অতিমারিকালে ভ্যাক্সিন তৈরির আগে একটিও ফার্মাসিউটিকাল প্রোডাক্ট তৈরি করেনি। এদের প্রথম প্রোডাক্ট শুধুমাত্র কোভিড ভ্যাক্সিন থেকে মুনাফার পরিমাণ ২০২০ সালে ১৫-১৮ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত (৩১ জনুয়ারি, ২০২২) “ডোন্ট ওয়রি অ্যাবাউট ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রফিটস হোয়েন কনসিডারিং এ ওয়েভার অন ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস” প্রবন্ধে পরিষ্কার ভাষায় বল হয়েছে – “ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুর ভরকেন্দ্রে রয়েছে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর প্রশ্ন। ভ্যাক্সিনকে করমুক্ত করা হবে কিনা? ভ্যাক্সিন তৈরির প্রযুক্তির হস্তান্তর করা হবে কিনা? কিংবা দরিদ্র দেশেগুলোড় জন্য অন্য সংস্কার করা হবে কিনা?” যাদের বিনামূল্যে বিভিন্ন গরীব ও মধ্য-আয়ের দেশে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করার কথা সেই কোভ্যাক্স সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন চায়না। এর নেতৃত্বে রয়েছে বিল গেটসের সংগঠন।
PLoS-এ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “নিউক্লিয়ার ওয়েপনস অ্যান্ড নেগলেক্টেড ডিজিজেজ: দ্য টেন-থাউজ্যান্ড-টু-ওয়ান গ্যাপ”-এ বলা হয়েছিল – “১১টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের পারমাণবিক অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা খরচ হয় তার ১/১০,০০০ ভাগেরও কম খরচে অবহেলিত রোগগুলোকে নির্মূল করা ও বিশ্বের উত্তেজনা কমিয়ে শান্তি রক্ষা করা সম্ভব।”
বিচারের ভার আমাদের ওপরে।
— লেখক চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যকর্মী।