বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

গাজা ভূখণ্ডে আবার ইজরায়েলের হামলা

গাজা ভূখণ্ডে আবার ইজরায়েলের হামলা

কবিতা রায় চৌধুরী

photo

গত কয়েক দশক ধরে বারবার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে বিবাদ মাঝে মধ্যেই বিস্ফোরণের আকার নিচ্ছে। আমেরিকার মদতপুষ্ট এবং অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্রে বলীয়ান ইজরায়েলের বারংবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। বিধ্বংসী রকেট নিক্ষেপ, বৃহৎ অট্টালিকাগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, নিরীহ সাধারণ অসামরিক মানুষের ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ, নারী এবং শিশুদের ভীত আর্তনাদে গাজা ভূখণ্ড এবং ওয়েস্ট ব্যাংকের স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ১০ মে সারা পৃথিবী যখন অতিমারির মোকাবিলায় দিশেহারা, বিশ্বের ছোট-বড় সমস্ত দেশগুলোই করোনা ভাইরাস থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছে সেই সময়ে ইজরায়েল বর্বর আক্রমণ নামিয়ে আনে প্যালেস্তাইনের উপর। প্যালেস্তানিয়রা তাঁদের জিনিসপত্র এবং শিশুদের নিয়ে গাজা ভূখণ্ডের বাইরে পালাতে থাকলেন, ইজরায়েল সীমান্ত বরাবর ৯০০০ জনের সেনাবাহিনী মোতায়েন করে ‘হামাস’-এর মোকাবিলায়। ২০০৬-০৭ সাল থেকে ‘হামাস’ কার্যত গাজা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। হামাস রকেট হামলা চালালে (রকেটের সংখ্যা ১৮০০) ইজরায়েল প্রত্যুত্তরে গাজার উপরে ৬০০ বোমারু বিমানের তীব্র আক্রমণ শানায়, যার ফলে অজস্র অসামরিক বৃহৎ অট্টালিকা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বোমারু বিমান এবং ড্রোন ব্যবহার করে গাজার একটি বৃহৎ চৌহদ্দিতে নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ করা হতে থাকে। এই আক্রমণের সমর্থনে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে “আমাদের যারা আক্রমণ করবে, তাদের ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে”।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্ররোচনামূলক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং সমগ্র পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ পুনরায় যুদ্ধবিরতির জন্য প্রার্থনা শুরু করেন। আরব, কাতার এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিনিধিরা যুদ্ধবিরতি আলোচনার জন্য ইজরায়েলে ছুটে যান কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনও সুরাহা হয় না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ‘সংযত’ হতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তার সঙ্গে এই মত প্রকাশ করেন যে ইজরায়েলের নিজেদের রক্ষা করার অধিকার আছে। অর্থাৎ প্রকারান্তরে তিনি ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন আক্রমণকে সমর্থনই করেন।
২০১৪-এর যুদ্ধবিরতির পরে আবার এই যুদ্ধের সূত্রপাত হল কেন? সংঘর্ষের মূলে আছে জেরুসালেম শহরের অধিকার নিয়ে ইহুদি এবং মুসলমানদের মধ্যেকার প্রাচীন বিবাদ। জেরুসালেম ইসলামীদের তৃতীয় সর্ব্বোচ্চ পবিত্র তীর্থ। মক্কা এবং মদিনার পরেই জেরুসালেমকে মুসলমানরা পুণ্যতীর্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। সেই কারণেই ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল জেরুসালেম অধিকার করার পর সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছিল। তারপরে একটা যৌথ দেখাশোনার ব্যবস্থা করা হয়। জেরুসালেমে অবস্থিত তথাকথিত পবিত্র আল-আকসা মসজিদ এবং তার চৌহদ্দির দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি ওয়াকফ বোর্ডের হাতে এবং এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব বর্তায় ইজরায়েলের ওপর। ওই একই জায়গা, যাকে ইহুদিরা বলে ‘টেম্পল মাউন্ট’, ইহুদিদের কাছেও পবিত্রতম তীর্থক্ষেত্র। ইজরায়েলের পুলিশ এবং সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে যখন তখন মসজিদে ঢুকে পড়ে কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণকে তাদের এই পুণ্যস্থানে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে বলপ্রয়োগ করতে দ্বিধা করে না। সমগ্র জেরুসালেমকে ইজরায়েল তার রাজধানী মনে করে এবং শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে অসামরিক প্যালেস্তানিয়দের উৎখাৎ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্যালেস্তানিয় জনগোষ্ঠী তাদের অধিকারে রাখতে চায় পূর্ব জেরুসালেমকে যে স্থান ইহুদি, খৃস্টান এবং মুসলমান সকলের কাছেই পুণ্যভূমি। পবিত্র রমজান মাসে পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারা অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকটি প্যালেস্তানিয় পরিবারকে উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয় ইজরায়েলী পুলিশ এবং তার সঙ্গে অভিযান চালায় আল-আকসা মসজিদেও। সংঘর্ষ বাধাবার জন্য এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষেপূর্ণ পরিস্থিতিই যথেষ্ট সংবেদনশীল নয় কি? অবশ্য ইজরায়েলী পুলিশের দাবি, প্যালেস্তানিয়রা বহুদিন ধরে মসজিদ চত্বরে পাথর জমা করছিল, তারাই প্রথম পাথর ছুঁড়ে পুলিশকে আক্রমণ করে, সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। আর প্যালেস্তানিয়দের দাবি, ইজরায়েলের পুলিশই গুলি চালায়।
এই ঘটনাকে অজুহাত করে ইজরায়েল বোমারু বিমান, সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক নিয়ে গাজা ভূখণ্ডের উপর বিধ্বংসী হামলা চালায়। আক্রমণ চালায় ওয়েস্ট ব্যাংকে, যেখানে হামাস নয় নিয়ন্ত্রণ করে প্যালেস্তাইন লিবারেশন সংগঠনের ফতে গোষ্ঠী। এমনকি লেবানন থেকে প্যালেস্তানিয়দের সাহায্য করা হচ্ছে এই অজুহাতে ইজরায়েল লেবাননের অনেক জায়গায় বোমাবর্ষণ করে। দশদিন ধরে চলা এই সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত এখনও তার সম্পূর্ণ হিসেব করা যায় নি। অতিমারির এই পরিস্থিতিতে বোমাবর্ষণে অসংখ্য সাধারণ মানুষ, নারী এবং শিশুর মৃত্যু এক কলঙ্কময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে যাবে। গাজাতে সতেরোটি হাসপাতাল সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোভিড পরীক্ষার একটি ল্যাবরেটারিও আর অবশিষ্ট নেই। করোনাকালে স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থা ভীত সন্ত্রস্ত অর্ধমৃত নাগরকিদের যে আরও গভীর হতাশা ও অসহায়তার মধ্যে নিক্ষেপ করছে এ বিষয়ে কোনও সন্দহে নেই। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার।
গত দশ বছরেরও অধিক সময় ধরে ইজরায়েলে একটি দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। আগ্রাসনের অভিপ্রায়ে উপকূলবর্তী ছোট একটি জায়গায় কুড়ি লক্ষ মানুষের উপরে নির্মম বোমাবর্ষণ অমার্জনীয় অপরাধ। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের এই সংঘর্ষে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা হয়েছে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর একথা বুঝতে বিশেষ কাঠখড় পোড়াতে হয় না। গত দু-বছরে চার-চারটি নির্বাচন হয়ে গেলেও ইজরায়েলে একটি স্থিতিশীল সরকার বা কোনও স্থায়ী সরকারি বাজেট তৈরী করতে পারেন নি নেতানিয়াহু। বিরোধীপক্ষের নেতারা একজোট হয়ে নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত করে তাঁর ১২ বছরের অপশাসনের অবসান ঘটাবার একটি পরিকল্পনা করছিলেন। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের এই যুদ্ধ সেই প্রচেষ্টাকে থমকে দিল। প্যালেস্তাইনের ‘হামাস’-কে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী একটি দল ভাবাও যুক্তিযুক্ত নয় কারণ, গাজা ভূখণ্ডে স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন জনকল্যাণকর কাজে তারা বিশেষভাবে সক্রিয়। অবশেষে মিশরের দেওয়া নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নিয়ে নিজেদের আপাতত সংবরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং হামাসের কর্তাব্যক্তিরা, যদিও তপ্ত বাক্যবিনিময় এখনও চলছে। আমেরিকা সহ বৃহৎ দেশগুলি ইজরায়েলের পক্ষ নিয়েছে তাদের আধিপত্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঋণপ্রকল্পগুলি এবং সর্বোপরি অস্ত্র-ব্যবসা কায়েম রাখার জন্য।
সংঘর্ষ শুরু হওয়ার প্রাথমিক পর্বে এ বিষয়ে ভারতের কূটনেতিক অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। ঘটনাটিকে হিংসাত্মক বলে বর্ণনা করে তিনি ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, বিবদমান দুই পক্ষের কাছেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আশু সমাধানের আর্জি জানানো হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাবের উপর ভোটে ভারত অনুপস্থিত থাকে। প্রস্তাবটি ছিল প্যালেস্তাইনের পক্ষে এবং সেখানে ইজরায়েলের হামলায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। ভারত বরাবর প্যালেস্তাইনের পক্ষে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সমস্ত প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে এবং ইজরায়েলের বেপরোয়া লঙ্ঘন ও প্যালেস্তাইনের জমির বেআইনি দখলদারির বিরোধিতা করে এসেছে। কিন্তু এখন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন ভারতের আভ্যন্তরীণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। আমরা চাই, ভারত স্বাধীন প্যালেস্তাইনের দাবির প্রতি সমর্থন বজায় রাখুক, প্যালেস্তানিয়দের সংগ্রামের প্রতি সহমত থাকুক এবং ইজরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের তদন্তে গঠিত নিরপেক্ষ কমিশনের সঙ্গে সহযোগিতা করুক। সর্বশেষ সংবাদ, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.