বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
ভূমধ্যসাগরের তীরে মনোরম গাজ়া ভূখণ্ড আজ বধ্যভূমি। গাজ়া ভূখণ্ডে এই নিয়ে দ্বিতীয় বছর শীতে ভয়ঙ্কর ঠান্ডা আর বৃষ্টিতে হাইপোথারমিয়ায় মারা যাচ্ছে একের পর এক শিশু। গতবছর শীতেও একই বেদনাদায়ক পরিণতি হয়েছিল বহু শিশুর। এই শিশুদের উষ্ণতা দেবার মতো জ্বালানি নেই — শিশুদের বাঁচাবার জন্য ডাক্তার থাকলেও ওষুধ নেই। হাসপাতালগুলি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইজ়রায়েলি বাহিনীর অভিযোগ, হাসপাতালগুলি নাকি হামাসের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল।
উনিশ বছর বয়সী ফেরাস অস্থি মজ্জার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে পাঁচ বছর ধরে লড়াই করেছিলেন প্রাণোচ্ছলতা এবং বেঁচে থাকার অদ্যম্য ইচ্ছায় ভর করে। কিন্তু যুদ্ধ তার বেঁচে থাকার উদ্যমকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ১২ বছর বয়সে তার অসুস্থতা ধরা পড়েছিল। মনের জোরে চিকিৎসার সবচেয়ে কঠিন ধাপগুলি অতিক্রম করেছিল। তার ভাই ওসামার সঙ্গে তার অস্থি মজ্জার মিল হয়। অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপনের অপারেশনের সময় ঠিক হয়েছিল ২০২৩ এর অক্টোবরের কোনও এক দিন। কিন্তু হঠাৎ এক দিন ইজ়রায়েলি আক্রমণে ওসামা নিহত হয়। তার পরে ফেরাসের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে।
উম ফেরাস, ৪৩ বছর বয়সী প্যালেস্তিনি মা, অকল্পনীয় বেদনা সহ্য করেছেন। তিনি তার সন্তানদের ধ্বংসস্তূপের নিচে চিৎকার করতে দেখেছেন কিন্তু বাঁচাতে পারেননি। পরে হাসপাতালে তাদের টুকরো টুকরো লাশ দেখতে পান তিনি। তিনি তার বাচ্চাদের শেষবারের মতো কোলে করতে পারেননি।
গাজ়া ভূখণ্ডের অধিবাসী প্যালেস্তিনিরা আজ গৃহহীন আশ্রয়হারা। গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঘর-বাড়ি। ইজ়রায়েলি বাহিনী আর মৃত্যু তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পলিথিনের তাঁবুতে কোনও রকমে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। শীতের বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে তাঁবুগুলি। জলে কাদায় মাখামাখি। শিশু সন্তানদের এবং নিজেদের গরম রাখার কোনও উপায় নেই। ইজ়রায়েলি বাহিনী গাজ়ার সমস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ধ্বংস করে দিয়েছে। কার্যত কোনও জ্বালানি নেই, খাদ্য নেই, বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। ইজ়রায়েলি বাহিনী রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ পাঠানোর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। গাজ়ার প্যালেস্তিনিদের সামনে অপেক্ষা করছে শুধুই অনাহার, অপুষ্টি আর মৃত্যু।
এর মধ্যে প্যালেস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতায় এবং ইজ়রায়েলি নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে এই নিয়ে দ্বিতীয় বছর বেথলেহেমে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিনে বড়দিনের উৎসব স্থগিত রাখা হয়েছে। সেই দিন বেথলেহেমের ক্যাথিড্রালে খ্রিস্ট ধর্মের অনুগামী মানুষেরা সমবেত হয়ে ইজ়রায়েলি আগ্রাসনে মৃতদের উদ্দেশ্য এবং শান্তির জন্য প্রার্থণা করেন।
ইজ়রায়েলি বাহিনী আশ্রয় শিবিরগুলিতেও হিংস্র আক্রমণ চালাচ্ছে। গাজ়া ভূখণ্ডের ২৩ লক্ষ অধিবাসী। ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ ইজ়রায়েলি বাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার জন। হতাহতদের ৭০ শতাংশ শিশু ও নারী। ইজ়রায়েলি বাহিনীর আক্রমণে এমনকি গাজ়ায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের ত্রাণ শিবিরগুলিতে আশ্রয় নেওয়া ৭৪৫ জন প্যালেস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ২,২০২ জন আহত হয়েছেন। ইজ়রায়েলি বাহিনীর আক্রমণ থেকে পার পাননি রাষ্ট্রসঙ্ঘের ত্রাণকর্মীরাও — ২৬৩ জন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছেন।
গাজ়ায় ১৫ মাস ধরে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে ইজ়রায়েলি বাহিনী। বোমার আঘাতে ভেঙে পড়া বাড়ি-ঘর বুলডোজ়ার দিয়ে গুড়িয়ে দিচ্ছে। গাজ়ায় প্যালেস্তিনিদের চিহ্ন মুছে ফেলা হচ্ছে। এ হল নেতানিয়াহুর বহু বছরের নয়া উপনিবেশিক দখলদারির পরিকল্পনা— জর্ডান নদীর পশ্চিমে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়া দখল করে বৃহত্তর ইজ়রায়েল গঠন করার আশু লক্ষ্য। প্যালেস্তিনি মুক্ত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়ায় ইজ়রায়েলের দখলদার উপনিবেশ করার কথা কোনও রকম রাখঢাক রাখেননি নেতানিয়াহু।
লেবাননে ইজ়রায়েলি বাহিনীর বিমান আক্রমণ ও স্থল অভিযানে নিহত হয়েছেন ৪,০৪৭ জন লেবানিজ় এবং আহত হয়েছেন ১৬,৬৩৮ জন। হতাহতদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। ১০ লক্ষেরও বেশি লেবানিজ় ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়হারা হন। এই সময় লেবাননের মানুষদের ঐক্য ও সম্প্রীতির কথা ফুটে উঠেছে আল জাজিরায়। লেবানিজ় মহিলা সাংবাদিক স্যালি আবু আলজৌদ বর্ণনা করেছেন ইজ়রায়েলি আক্রমণের মুখে সেখানকার মানুষের নানা অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার কাহিনী।
লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে ইজ়রায়েলের স্থল অভিযানে উচ্ছেদ হওয়া হাজার হাজার ভয়ার্ত মানুষ নিরাপদ জায়গার খোঁজে অনিশ্চিত ভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, সন্তান সন্ততি পরিবার সহ। কেউ গাড়িতে, কেউ বা স্রেফ পায়ে হেঁটে। আমরা যারা রাজধানী বেইরুটের দক্ষিণে থাকি, তারা ভেবেছিলাম, আমরা নিরাপদ। কিন্তু হিজবুল্লাহের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে বেইরুটের দক্ষিণে বিমান আক্রমণে হত্যা করা হল। আমরা বুঝলাম, আমরা আর নিরাপদ নেই। যে আতঙ্কে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই আতঙ্ক আমাদের পেয়ে বসল।
কিন্তু তার মধ্যেই স্বজনদের জন্য সহমর্মিতা, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কেউ ইতস্তত করেনি। কেউ নিজেদের ঘর খুলে দিয়েছেন, নিজেদের যা আছে ভাগ করে নিয়েছেন অতিথিদের সঙ্গে। এই ঘটনা বেশি দেখা গেছে বেইরুটের দক্ষিণ শহরতলীতে। ওখানে উচ্ছেদ হওয়া প্যালেস্তিনিদের বাস। এক সময় লেবানিজরা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। এখন তারা উচ্ছেদ হওয়া ভয়ার্ত লেবানিজদের আশ্রয় দিয়েছেন। খুলে দিয়েছেন বিয়ের অনুষ্ঠান করার হল, মসজিদ। তার আগে পেজার বিস্ফোরণে আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হিজবুল্লাহের সমর্থক, বিরোধী সকলেই। সংকটের মুখে আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আমাদের সাহস দিয়েছে।
১৫ নভেম্বর, ২০২৪ লিখেছিলাম লেবাননের মহিলা সাংবাদিক ঘাদি ফ্রান্সিসের কথা। তিনি বলেছিলেন, “ইজ়রায়েল ও আমেরিকার ওয়ার-মেশিনের বিরুদ্ধে ... সকলের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে আমরা ২০০৬ সালে ইজ়রায়েলকে পরাজিত করেছি। আবার আমরা জিতব।”
আরও এক বার জয়ী হয়েছে লেবাননের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরাধ। পিছু হটেছে ইজ়রায়েল। ইজ়রায়েল হিজবুল্লাহের সঙ্গে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করেছে। কেন ইজ়রায়েল যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হল? লেবাননের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কারণেই হোক, অথবা হিজবুল্লাহের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন বলে হোক, কিম্বা আমেরিকার পরামর্শে আরও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কারণেই হোক।
ইতিমধ্যে সিরিয়ায় বাশার-আল-আসাদের দীর্ঘ শাসনের পতন ঘটেছে। তিনি সপরিবারে মস্কোয় আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত রাশিয়ার সমর্থনে আসাদ সরকার টিকে ছিল। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে পারেনি। আসাদ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্র ছাড়া বৈদেশিক সাহায্যে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা যায় না — বাংলাদেশের পর সিরিয়া তার উদাহরণ হয়ে থাকল।
রাজধানী দামাস্কাস সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির ক্ষমতা দখল করেছে এইচটিএস। আসাদের পতনে পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যমে উল্লাস চলছে, সিরিয়ায় গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। বাস্তবে আসাদের পতনের পর সিরিয়াকে যেন ছুরি দিয়ে ‘স্লাইজ়’ করে কাটা হচ্ছে। সিরিয়ার উত্তর-পূর্বে গোলান মালভূমির অসামরিক বাফার এলাকা সহ বিস্তির্ণ এলাকা ইজ়রায়েল দখল করে নিয়েছে — ভয়াবহ বিমান আক্রমণে ধ্বংস করে দিয়েছে ৮০ শতাংশ সিরিয়ার সামরিক পরিকাঠামো। কুর্দ বিদ্রোহীরা পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) সিরিয়ার এক বিস্তৃত এলাকা কব্জা করে নিয়েছে — তাদেরকে বহু দিন ধরে মদত করে আসছে আমেরিকা। তুরস্কের সঙ্গে পিকেকে-র বিরোধের সম্পর্ক। পিকেকে যাতে তুরস্ক সংলগ্ন সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা দখল করতে না পারে, সিরিয়ার সীমান্তের বরাবর এক সরু কিন্তু দীর্ঘ অংশ তুরস্ক দখল করেছে।
এইচটিএস বা ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ হল উত্তর সিরিয়া-ভিত্তিক সুন্নি ইসলাম বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির একটি জোট। সিরিয়ায় আল-কায়েদার প্রাক্তন শাখা ‘জাভাত আল-নুসরাহ’ বা ‘নুসরাহ ফ্রন্ট’ থেকে তৈরি হয়েছে।
এইচটিএস রাষ্ট্রসঙ্ঘ, আমেরিকা, ব্রিটেন সহ বিভিন্ন দেশের কাছে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিসেবে নথিভূক্ত ছিল। যদিও আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলি গোপনে আসাদ সরকারকে উচ্ছেদ করতে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে মদত ও অস্ত্র সাহায্য করে গেছে। এখন এইচটিএস-এর পূর্ব ইতিহাসকে চুনকাম করতে পশ্চিমী সংবাদ মাধ্যম প্রচার শুরু করেছে।
প্রায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নেতানিয়াহুর গেম প্ল্যান, যে সমস্ত দেশের সরকার স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের দাবিকে সমর্থন করে তাদেরকে উৎখাত করা। ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহু একটা বই লিখেছিলেন ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’। ৯/১১ এর পর আমেরিকার ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আর নেতানিয়াহুর বৃহত্তর ইজ়রায়েল গড়ার লক্ষ্য একাকার হয়ে গেল।
সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, ইরান, সোমালিয়া, সুদান এবং লেবাননে পোষ-না-মানা সরকারগুলি উচ্ছেদে আমেরিকার ভূ-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক স্বার্থ আর নেতানিয়াহুর বৃহত্তর সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উন্মত্ততা মিলে মিশে গেল।
২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা একের পর এক যুদ্ধে গেছে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে। লিবিয়া-ইরাকে প্রকাশ্যে, সিরিয়ায় গোপনে। এর জন্য যুদ্ধবাজ আমেরিকার ওয়ার-মেশিন ব্যয় করেছে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। সাদ্দাম হোসেনকে উচ্ছেদে নেতানিয়াহু ছিলেন আমেরিকার প্রধান চিয়ার লিডার।
পশ্চিম এশিয়ায় শান্তির জন্য প্রধান সোপান স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন। যার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইজ়রায়েল। বিশ্ব জনমত ও পৃথিবীর বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে।