বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

বাজার অর্থনীতি বনাম পরিকল্পিত অর্থনীতি

বাজার অর্থনীতি বনাম পরিকল্পিত অর্থনীতি

নির্মলেন্দু নাথ

photo

যে কোনও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের লক্ষ্য হল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের উন্নতি। তত্ত্বগতভাবে একথা বলা হয়, একমাত্র বাজার অর্থনীতিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের উন্নতি সম্ভব। এই ধারণার ভিত্তি ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অভাবনীয় অগ্রগতি। বাস্তবের সঙ্গে বাজার অর্থনীতির এই সাযুজ্য ধাক্কা খায় দুটো ঘটনায়। প্রথমটা ১৯১৭ সালে সোভিয়েতের আত্মপ্রকাশ। দ্বিতীয়টা হল ১৯৩০-এর দশকে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মহামন্দা। বাজার অর্থনীতির ভারসাম্য যে আসলে ‘নাইফ এজ স্টেবিলিটি’র মতো, তখনই এই ধারণার সূত্রপাত হয়। বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠে পরিকল্পিত অর্থনীতির তত্ত্ব ও তার বাস্তবায়ন। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে অবশ্য পরিকল্পিত অর্থনীতির সার্বিক সমস্যা সামনে আসে। পরিকল্পিত অর্থনীতি মানে জ্যানোস করনাই বর্ণিত ঘাটতি অর্থনীতি, এইরকম একটা ধারণা তৈরি হয়। এই ধারণা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য বাজার অর্থনীতির সঙ্গে পরিকল্পিত অর্থনীতির মেলবন্ধন ঘটানোর লক্ষ্যে নতুন ধারণার অন্বেষণ করা হয়। এই অন্বেষণের বিভিন্ন ধারার আলোচনা করাই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
অর্থনীতির প্রধান দুটি বিষয় হল পণ্য উৎপাদন ও তার বণ্টন। উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন চারটি — কী পণ্য উৎপাদিত হবে? কীভাবে পণ্য উৎপাদিত হবে? কতটা পণ্য উৎপাদিত হবে? এবং উৎপাদন কীভাবে সংগঠিত করা হবে? বণ্টনের দিক থেকে প্রশ্ন হচ্ছে — এর দায়িত্ব কি বাজারের হাতে থাকবে না রাষ্ট্রের হাতে থাকবে বা সমবায়ের হাতে থাকবে কিংবা এসবের মধ্যবর্তী কোনও ব্যবস্থার হাতে থাকবে যেখানে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হয়। উৎপাদন ও বণ্টন সম্পর্কিত এই প্রাথমিক ধারণার অনুষঙ্গ হিসেবে আসে বাজার ব্যবস্থা ও পরিকল্পিত ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়া।
সাধারণভাবে যে অর্থনীতিতে চাহিদা ও সরবরাহের মাধ্যমে পণ্যের দাম এবং উৎপাদনের মাত্রা নির্ধারণ করে তাকে বাজার অর্থনীতি বলে। এই ব্যবস্থার প্রধান উপাদানগুলো হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানা, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ ও ন্যূনতম সরকারি হস্তক্ষেপ। এ কথা বলা হয় যে বাজার অর্থনীতি স্বাধীনতা, উদ্ভাবন এবং ভোক্তাদের পছন্দের সুযোগ করে দেয়। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হল গিগ অর্থনীতি। এখানে বণ্টন ব্যবস্থাকে উৎপাদনের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এবং গিগ শ্রমিকদের সাহায্যে ক্রেতাদের পছন্দকে মান্যতা দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, এই অর্থনীতির মূল ভিত্তি হল একটা অ্যাপ এবং অ্যাপ কোম্পানি খাজনার মতো একটা অংশ নিয়ে থাকে। এই অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি করে।
এর বিপরীতে পরিকল্পিত অর্থনীতিতে সরকারি পরিকল্পনার মাধ্যমে মূল্য উৎপাদন ও বণ্টন এবং বিনিয়োগের মতো অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয়। এর বৈশিষ্ট্যগুলো হল, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি হস্তক্ষেপ। তবে একথা বলা হয়, আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন ঘটলেও ভোক্তাদের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয় এবং ঘাটতি অর্থনীতি তৈরি করে। এই ধারণার প্রবক্তা হলেন অধ্যাপক জ্যানোস করনাই। তিনি দেখিয়েছিলেন, ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশক জুড়ে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে যে পণ্যের ঘাটতি তা সাধারণ জোগানের থেকে চাহিদার আধিক্যজনিত নয়, এটা একটা নির্দিষ্ট দামে (সরকার আরোপিত দামে) জোগানের চেয়ে চাহিদার আধিক্যের প্রতিফলন। বাজার অর্থনীতি ও পরিকল্পিত অর্থনীতির এই সনাতন বৈশিষ্ট্যসমূহ অবশ্য সময়ের সঙ্গে ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে।
ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে পাঁচ ধরনের বাজার অর্থনীতি দেখা যায়। এগুলি হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর মুক্তবাজার অর্থনীতি, ফ্রান্সের পরিকল্পিত বাজার অর্থনীতি, জার্মানির সামাজিক বাজার অর্থনীতি, সুইডেনের জনকল্যাণমূলক জাতীয় বাজার অর্থনীতি এবং জাপানের সরকারকেন্দ্রিক বাজার অর্থনীতি। সামগ্রিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন এবং জাপান — এই দেশগুলির প্রত্যেকেরই উচ্চমাত্রায় উন্নয়ন সূচক রয়েছে, যা উন্নত জীবনযাত্রার মান নির্দেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সূচকের মান উন্নত হলেও এখানে আয় বৈষম্য তীব্র। অবাক করার মতো বিষয় হল, ২১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান শিক্ষিত নয়। একই ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করলেও এর ফলাফল উন্নত দেশের তুলনায় খারাপ। কোভিড-১৯ হল এর উদাহরণ। ল্যানসেট-এর এক হিসেবে দেখা যায়, পৃথিবীর ২৫টি দেশের মধ্যে কোভিড-১৯ এ প্রত্যাশিত মৃত্যুর চেয়ে অতিরিক্ত মৃত্যুর মাপকাঠি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থান ছিল চতুর্থ। আর ভারতের স্থান ছিল সবার ওপরে। দুটি দেশই হচ্ছে মুক্ত-বাজারের পূজারি। মুক্ত-বাজার অর্থনীতির দর্শন অর্থনীতিতে গতি আনলেও জনসাধারণের দুর্গতি বাড়িয়ে তোলে।
ওপরের পাঁচ ধরনের বাজার অর্থনীতি ছাড়া আরও এক বাজার অর্থনীতি পৃথিবীতে দৃশ্যমান। এটা হল সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। যে দেশগুলোতে এই অর্থনীতি বিদ্যমান তার প্রতিটিতেই বিপ্লবের মাধ্যমে বড় বুর্জোয়া ও বড় ভূস্বামীদের শাসন উৎখাত করা হয়েছে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে পরিকল্পিত অর্থনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এটাই হল প্রাথমিক ভিন্নতা। এই হিসেবে সবার আগে আসে সোভিয়েত রাশিয়া, তারপর চীন। এরপর আসে উত্তর কোরিয়া, কিউবা ও ইন্দোচীনের এর তিনটি দেশ লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম পরিকল্পিত অর্থনৈতিক মডেল গড়ে ওঠে। গ্রিগ্ররি ফেল্ডম্যান ছিলেন এর পথিকৃৎ। চীনেও কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের আদলে পরিকল্পিত অর্থনীতির পথে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু কঠোর পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি যে মন্থর হতে পারে তা প্রতীয়মান হতে থাকে। অর্থনীতিতে প্রতিটি জিনিসের জোগান হ্রাস পেতে থাকে। এবং এই অর্থনীতি ঘাটতি অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়। একেই করনাই ঘাটতি অর্থনীতি বলেছেন। এখান থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৮৪ সালে চীন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির ধারণা নিয়ে আসে। এর মর্মবস্তু হল, রাষ্ট্র বাজারের পথপ্রদর্শক আর বাজার শিল্প প্রতিষ্ঠানের পথপ্রদর্শক।
রাষ্ট্রকে চালকের আসনে বসিয়ে রেখে বাজারমুখী সংস্কার ঘটিয়েছে চীন। লক্ষ্য ছিল, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের মধ্যে দিয়ে যৌথ স্বাচ্ছন্দ্যের বিকাশ ঘটানো। সঙ্গে ছিল একটা মজবুত কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীনা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন গণলাইন। রাষ্ট্র পরিচালিত বাজারমুখী সংস্কার এনেছে ভূমি সংস্কার, মজবুত জনস্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা এবং মানবসম্পদকে কাজে লাগানোর উপায়। একটা উৎপাদন কুশল ব্যবস্থা হিসেব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা থেকে বাজার অর্থনীতি এভাবেই চীনে রূপান্তরিত হয়েছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে। চীনা অর্থনীতির এই মডেল কিউবা ও ভিয়েতনামে দেখা যায়। এই দুটি দেশের বৈশিষ্ট্য হল, এরা ‘জ্বলে পুড়ে ছারখার মাথা নত নাহি তার’। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের মতো কিউবা বিপদে পড়ে। তবে তার থেকে মুক্তির জন্য কিউবা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ে এখানে বলা হবে। এইরকম ভাবে ভিয়েতনামে ১৯৮৬ সালে যে দোই মোই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, বলা হবে তার কথা।
কিউবা
কিউবা ছোট দেশ। আয়তন ১,১০,৮৬১ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে একটু বড়। যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় তার অবস্থান। বিপ্লব-পরবর্তী কিউবার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ইতিহাসের পর্বগুলো হল ১৯৫৬ থেকে ১৯৯১: রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পর্ব। ১৯৯১ থেকে ২০১০, দ্বিতীয় পর্বটি হল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মডেলে বাজার ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্তির পর্ব যা লোস লোগরোস নামে পরিচিত। আর ২০১০ থেকে ২০২৫, তৃতীয় পর্বটি হল এই মডেলের আধুনিকীকরণ, পুঁজিহীন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যা ‘লিনিয়ামেন্তস’ নামে পরিচিত। আমেরিকার কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিউবা কীভাবে এগোলো?
১৯৫৬ থেকে ১৯৯১ সালের পরিসরে কিউবা কাউন্সিল ফর মিউচুয়াল ইকনমিক অ্যাসিস্ট্যান্স (কমেকন)-এর অন্যতম সদস্য ছিল। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য কিউবা ব্যাপক মাত্রায় সোভিয়েতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দরিদ্র দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেলের সুবাদে কিউবার স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা গোটা পৃথিবীর কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯০ সালে কিউবায় শিশুমত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে মাত্র ১১ জন। আর গড় আয়ু হয়ে দাঁড়ায় ৭৮ বছর। ১৯৯১ থেকে ২০১০-এর যে পরিসর, তার প্রথমার্ধে কিউবাকে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করতে হয়েছে। সোভিয়েতের সাহায্য বন্ধ হয়ে যায়। দেশটি গভীর মন্দার কবলে পড়ে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য মার্কিন অর্থপুষ্ট ধ্যানধারণার মূল কথা ছিল, কিউবার শক থেরাপি দরকার — অর্থনীতিতে বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজির অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করা দরকার। দরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, মজুরি ও মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত আইন শিথিল করা ও সামাজিক ব্যয় কমানো। এক কথায় বললে, পরিকল্পিত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে মুক্ত বাজারের পুঁজিবাদকে আবাহন করা। আর মার্কিন মদতপুষ্ট এই বাজার অর্থনীতির বিপরীতে হাভানা কিউবার স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য সমেত বাজার অর্থনীতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই কার্যক্রমে ব্যতিক্রমহীন ভাবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বলা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক ক্ষমতা ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের সফলতা ধরে রাখার কথা বলা হয়। এই নীতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় এবং জাঁকজমক অগ্রাহ্য করে। এক কথায় এই নীতিকে লোস লোগরোস বলা হয়। এই নীতিকে সামনে রেখে ২০০৪ সালে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। এই চুক্তির বিশেষত্ব হল দিনে ৫৩ হাজার ব্যারেল তেলের বিনিময়ে কিউবা ভেনেজুয়েলাকে নানান পেশাদার, যেমন স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষক দিয়ে সহায়তা করবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই ধরনের চুক্তি বিরল। ২০০৬ সালে কিউবা এই ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি বলিভিয়া, নিকারাগুয়া এবং ইকুয়েডর-এর সঙ্গেও সম্পাদন করে। এসবের ফলে বার্ষিক রপ্তানি বৃদ্ধির গড় হার দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ আর কিউবার জিডিপি বৃদ্ধি বাড়ে ১০ শতাংশ।
কিউবার অর্থনীতিতে তৃতীয় পর্যায় হল ২০১০ থেকে ২০২৫। এই পর্বের মূল নীতি হল, কিউবার স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বাজার অর্থনীতির আধুনিকীকরণ করা। এই পর্বে তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রথমত বেসরকারি খামারগুলোতে জমি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ও তাদের অধিক হারে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি, ইনপুট বাড়ানো ও অর্থ সরবরাহ ঠিক রাখার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত হাভানা থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ব্রাজিলের সহায়তায় মারিয়েল বন্দরের উন্নয়ন ও বন্দর সংলগ্ন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্মুক্ত করা। লক্ষ্য হচ্ছে এই বন্দরকে চীন, ব্রাজিল ও ইউরোপের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের কাজে লাগানো। শেষত নীতি নির্ধারণে কিউবা ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মতামত গ্রহণ করে। সংক্ষেপে বললে, বৈপরীত্য ও সমস্যা থাকলেও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন মডেলের মধ্যেও বাজার ব্যবস্থাপনা যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিউবা তার উদাহরণ।
ভিয়েতনাম
ভিয়েতনাম মাঝারি মাপের দেশ। আয়তন ৩,৩১,২১২ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের ৪ গুণ বড়। সমাজতান্ত্রিক দেশ চীনের পাদদেশে তার অবস্থান। ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ২০২৫ পর্যন্ত ভিয়েতনামের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ইতিহাস দুটি পর্বে বিভক্ত — ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৬ থেকে ২০২৫। প্রথমেই বলা দরকার, ভিয়েতনাম যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনাম সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। প্রথমে উপনিবেশ মুক্ত করার যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজিত করে। তারপর ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার সবচেয়ে নৃশংস সংঘাতগুলোর মধ্যে মার্কিনিদের পরাজিত করে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ছিল অপরিসীম। দেশের পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায় এবং এজেন্ট অরেঞ্জ-এর মতো বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ফলে সবুজ ভূখণ্ডের কিছু অংশও ধ্বংস হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ছিল সমাজের বিভাজন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের কিছু মানুষ পুনর্মিলন ও মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে সকলেই বিজয়ের অনুভূতি ভাগ করে নেয়নি। এখানে জনসমষ্টির ধরন ছিল তিন প্রকার। অনেকে মানিয়ে নিয়েছিল, কেউ কেউ প্রতিরোধের নিরপেক্ষ উপায় খুঁজে পেয়েছিল এবং কেউ কেউ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তাদের একমাত্র আশা হল অন্য কোথাও নতুন জীবন গড়ার জন্য চলে যাওয়া। জনসমষ্টির মধ্যে এই বিভাজন শহর এবং গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই ছিল। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার পর ভিয়েতনাম সরকার যখন দক্ষিণে একটি সমাজতান্ত্রিক, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পরিকল্পিত অর্থনীতি চালু করে তখন এই সমস্যা আরও প্রকট হয়। এই ব্যবস্থায় সরকার মালিকদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং দক্ষিণে অনেক ব্যবস্থা জাতীয়করণ করে। ভিয়েতনামে এই ব্যবস্থার ফলে শহরাঞ্চলে হোয়া নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (জাতিতে চীনা) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় কৃষি সমষ্টিকরণ এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ উৎপাদনের জন্য প্রণোদনা হারিয়ে যাচ্ছে। আরও উৎপাদন করার পরিবর্তে কৃষকরা বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু জমি চাষ করা দরকার ততটুকু করতেন এবং নির্দিষ্ট মূল্যে সরকারের কাছে কোনও উদ্বৃত্ত হস্তান্তর করতে চাইতেন না। এই প্রবণতা শুধু দক্ষিণের কৃষকদের মধ্যে ছিল না। এই মনোভাব উত্তরের কৃষকদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় দেখা যায় অনেকেই সমষ্টিগত চাষ থেকে সরে আসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা। প্রথম ধাপে দেশত্যাগের ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালে সায়গনের পতনের সময়। এই সময় ১ লক্ষ ৪০ হাজার দক্ষিণ ভিয়েতনামবাসী দেশত্যাগ করে। তারপর এই প্রক্রিয়া স্তিমিত হলেও তা চলেছিল। ১৯৭৯ সালে বিষয়টা বোট পিপল নামে একটা মানবিক সঙ্কটে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় এটা বোঝা যায় যে কমিউনিজম দেশের দ্রুত আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য কোনও অলৌকিক প্রতিকারের পথ দেখাবে না। এ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার গোসার মন্তব্য স্মরণযোগ্য। কৃষকের ক্ষুধা ১৯৪৫ সালের আগস্টে ভিয়েতমিনকে ক্ষমতায় এনেছিল। এবং এই বিষয়টি পঞ্চাশ বছর পরে কমিউনিস্টদেরও পতন ঘটাতে পারে। ১৯৮৬ সালের গৃহীত হয় দোই মোই নামে একগুচ্ছ বাজার সংস্কার নীতি। দোই মোই কর্মসূচিতে তিনটি বিষয় রয়েছে। এই ব্যবস্থায় কালেক্টিভ ফার্মিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জমির উপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হয়েছে।কৃষিক্ষেত্রে জমির ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে দেখা গেছে ০.২ হেক্টর জমির মালিকদের সংখ্যা ২০০৬ থেকে ২০২০-র পরিসরে ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। এতে যে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে তা নয়। দেখা গেছে ১৯৮৮ থেকে ২০২১-এর পরিসরে কৃষিজ পণ্যের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৭ শতাংশ। চালের মোট উৎপাদন ২.৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একর কিছু উৎপাদন ২.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কফি, রাবার, তামাক, চা, প্রাণিজ সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবের ফলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গ্রামাঞ্চলে ২০২১ সালে দারিদ্রের মাত্রা ১৯৯০ সালের ৬০ শতাংশ থেকে মাত্র ৪.৪ শতাংশ নেমে আসে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, এসবের জন্য শুধু বাজার অর্থনীতি নয়, ভিয়েতনামের গ্রাম সমবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই সমবায়গুলির মাধ্যমে রাষ্ট্র যেমন উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ করে, তেমন উৎপাদিত পণ্যের বণ্টন করে বাজারকে ভারসাম্য অবস্থায় রাখে।
শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পে ভিয়েতনামের স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। তুলনামূলক কম বেতনে শ্রমশক্তির সুবিধা থাকার জন্য নাইকি, অ্যাডিডাস-এর মতো কোম্পানিগুলি এখানে ব্যবসা বাড়ায়। ইদানীংকালে ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র। এর জন্য দরকার প্রচুর বিনিয়োগ ও দক্ষ শ্রমশক্তি। এদেশে সেই দক্ষ শ্রমশক্তি আছে। দি ইকনমিস্ট পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে দেশটির পণ্য রপ্তানির ৩৮ শতাংশই ছিল ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী। দুই দশক আগে এটা ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ।
ভিয়েতনামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উৎপাদনের সব ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন করার চেষ্টা। এসবের ফলে ২০২২ সালে মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্বব্যাপী মানদণ্ডে ভিয়েতনামের অবস্থান ১০৭ নম্বরে। ভারতের অবস্থান ১৩০ নম্বরে। ১৯৮৬ সালে দোই মোই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবার ৩৮ বছর পর অর্থনৈতিক উন্নয়নের তাত্ত্বিকরা ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোশালিস্ট ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকনমি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে পুঁজিবাদের সংকট নিয়ে যত না প্রশ্ন, তার চেয়ে অনেক বড় প্রশ্ন সমাজতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে। ওপরের আলোচনাটি বোধহয় এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.