শ্রমজীবীদের কাছে মার্ক্সের প্রশ্নমালা
শ্রমজীবীদের কাছে মার্ক্সের প্রশ্নমালা
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে আদিপর্ব থেকেই ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেন’স অ্যাসোসিয়েশন বা ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’-এর অন্যতম কর্তব্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছিল দেশে দেশে শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে বিশদ অনুসন্ধানের কাজটি। সংগঠনের সাধারণ পরিষদ এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হিসেবে এই বিষয়ে যিনি প্রধান উদ্যোগী ছিলেন, তিনি কার্ল মার্ক্স। প্রথম থেকেই তাঁর বক্তব্য ছিল, অনুসন্ধান বা সমীক্ষার কাজটিতে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে শ্রমিকদেরই। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সে-কাজ শুরু হয় এবং অন্তত কিছু কিছু জায়গায় স্থানীয় স্তরে এগিয়েও যায়। অতঃপর ১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউনের রক্তস্নাত অবসানের পর থেকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ক্রমশ বিভাজিত এবং দুর্বল হতে থাকে। কমিউনের ‘ব্যর্থ’ পরিণতির পরে শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে চলবে তা নিয়ে দেখা দেয় নানা মত, বহু প্রশ্ন, বিস্তর সংশয়। মার্ক্সের চিন্তাতেও তখন প্রবল আলোড়ন। তিনি নতুন করে জোর দিলেন অনুসন্ধানের উপর। তাঁর বক্তব্য: শ্রমিকরা কী অবস্থায় আছেন তা বিশদ এবং গভীর ভাবে জানতে হবে, এবং সেই জানার কাজটিতে শ্রমিকদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৮৮০ সালের ২০ এপ্রিল ফ্রান্সের La Revue Socialiste পত্রিকায় প্রকাশিত হল চারটি বিভাগ বিন্যস্ত একটি প্রশ্নমালা। শ্রমিকদের জন্য মার্ক্সের তৈরি ১০০টি প্রশ্নের সঙ্কলন, তৎসহ ১০১ নম্বরে ‘সাধারণ বক্তব্য’ জানানোর আবেদন। প্রশ্নগুলি শ্রমিকদের কাজ এবং জীবনযাপন সম্পর্কে। কেবল গড়পড়তা তথ্য জানার জন্য কিছু পাইকারি প্রশ্ন করা নয়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাজের প্রকৃতি, পরিবেশ, পদ্ধতি, উপার্জন, সুযোগসুবিধা, সংগঠন ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে জেনে নেওয়ার তাগিদ ছিল সেই প্রশ্নমালায়, তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল শ্রমিক কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন, কী ভাবে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের দিন চলছে, সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য কী করতে পারছেন তিনি, সমস্ত বিষয়ে বিশদ সমীক্ষার প্রকরণ। কিন্তু এই সব কিছুর উপরে ছিল একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক লক্ষ্য। প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে গিয়ে, উত্তর ভাবতে গিয়ে, উত্তর খুঁজতে গিয়ে শ্রমিক নিজের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন, কী ভাবে তাঁর শ্রমশক্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে, কী ভাবে তাঁর এবং তাঁর স্বজনের জীবনীশক্তির বিনিময়ে পুঁজিমালিক নিজের মুনাফা বাড়িয়ে চলেছেন সে-কথা উপলব্ধি করবেন। প্রচলিত তাত্ত্বিক শিক্ষা নয়, নিজের বাস্তব অবস্থাকে প্রশ্ন করে করে বুঝে নেওয়ার মধ্য দিয়েই শ্রমিক বৈপ্লবিক চেতনায় দীক্ষিত হবেন— এটাই ছিল এই প্রশ্নমালার নিহিত লক্ষ্য। কোনও ‘নিরপেক্ষ বা বিশুদ্ধ অ্যাকাডেমিক’ সমীক্ষা করতে চাননি মার্ক্স, কারণ তেমন কিছু হয় বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন না, তাঁর কাছে সমীক্ষা একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এই প্রশ্নমালা তার হাতিয়ার।
কেবল ফ্রান্সে নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এই প্রশ্নগুলির উত্তর জানার নানা উদ্যোগ হয়েছিল, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও অন্য সংস্থা বা গোষ্ঠী এই প্রশ্নমালার ভিত্তিতে নিজের নিজের মতো করে প্রশ্নাবলি তৈরি করে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন। বস্তুত, দুনিয়ার শ্রমিক রাজনীতি এবং আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রশ্নমালা একটি আকর হিসেবে কাজ করেছে। এই বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ সালে। ক্লার্ক ম্যাকঅ্যালিস্টার প্রণীত বইটির নাম কার্ল মার্ক্স’স ওয়ার্কার্স’ ইনকোয়ারি (নোটস ফ্রম বিলো)। সেই বইটি নিয়ে ভবিষ্যতে বিশদ আলোচনার ইচ্ছা থাকল। আপাতত প্রশ্নমালাটির বাংলা তর্জমা পেশ করা যেতে পারে, মার্ক্সের নিজস্ব ভূমিকা সহ। নিছক ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণ নয়, প্রশ্নগুলি আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের কথা তাঁদের মুখ থেকে শোনা যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয়, তবে কী ধরনের প্রশ্ন নিয়ে তাঁদের কাছে যেতে হবে এবং তাঁদের ভাবনার সঙ্গী করে তুলতে হবে, এই একশোটি প্রশ্ন সেই বিষয়ে আমাদের অনেক চিন্তার খোরাক দিতে পারে।
মার্ক্সের ভূমিকা
রাজতন্ত্র হোক আর বুর্জোয়া সাধারণতন্ত্র হোক, আজ পর্যন্ত কোনও সরকারই ফরাসি শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা নিয়ে বিশদ অনুসন্ধানে উদ্যোগী হয়নি। অথচ নানা ক্ষেত্রে— কৃষিতে, বিত্তব্যবস্থায়, শিল্পে, বাণিজ্যে, রাজনীতিতে— নানা ধরনের সঙ্কট সম্পর্কে কত সমীক্ষাই না করা হয়েছে।
ইংল্যান্ডে সরকারি সমীক্ষা পুঁজিবাদী শোষণের তঞ্চকতার নানা দিক উন্মোচন করেছে এবং তার পরিণামে সরকার কিছু কিছু আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়েছে (যেমন, দৈনিক কাজের সময় ১০ ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া, নারী এবং শিশু শ্রমিক সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, ইত্যাদি)। এর ফলে, (ফ্রান্সের শ্রমিকদের হাল নিয়ে) নিরপেক্ষ এবং যথাযথ অনুসন্ধান করা হলে যে ছবি বেরিয়ে আসবে তা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সে-কথা চিন্তা করে ফরাসি বুর্জোয়ারা এখন আরও বেশি আতঙ্কিত।
আমাদের আশা, ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্রে সরকার যা করেছে, (ফরাসি) সাধারণতন্ত্রে সরকারকে তার অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে, যাতে পুঁজিতন্ত্রের শোষণ সম্পর্কিত তথ্য ও অপরাধ সম্পর্কে সুদূরপ্রসারী অনুসন্ধানের আয়োজন হয়। এই আশার ভিত্তিতেই আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে এই ধরনের একটি সমীক্ষার চেষ্টা করতে পারি। গ্রামে এবং শহরে শ্রমিকরা (অনেকেই) বোঝেন যে কেবল তাঁরাই নিজেদের দুর্দশা এবং যন্ত্রণার কথা পুরোপুরি জানেন, আর তাই, তাঁরা সমাজের যে সব ব্যাধির শিকার, একমাত্র তাঁরাই প্রবল উৎসাহে সেগুলির নিরাময়ের ওষুধ প্রয়োগ পারেন, ঈশ্বরপ্রেরিত কোনও পরিত্রাতা সে-কাজ করে দিতে পারে না। সমস্ত ধরনের সমাজতন্ত্রীদের উপরেও আমরা নির্ভর করি; তাঁরা যদি সমাজকে বদলাতে চান তা হলে ভবিষ্যৎটা যাঁদের, সেই শ্রমজীবী শ্রেণী কোন অবস্থায় কাজ করেন এবং কেমন করে তাঁদের জীবন চলে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট এবং বাস্তব তথ্য ও ধারণা জানার তাগিদ না থাকলে চলবে না।
সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রস্তুতি হিসাবে সমাজতন্ত্রী গণতন্ত্রের প্রথম কর্তব্য হল শ্রমিকের ক্ষোভ তথা দাবিদাওয়ার এই সমস্ত বয়ান নির্মাণ।
নীচের একশোটি প্রশ্ন (এই সমীক্ষার কাজে) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর দেওয়ার সময় প্রশ্নের ক্রমিক সংখ্যাটি উল্লেখ করা দরকার। প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে এমন কোনও বাধ্যতা নেই, তবে আমরা বলব, উত্তরগুলো যেন যথাসম্ভব বিশদ এবং সম্পূর্ণ হয়। যে শ্রমিক পুরুষ বা নারী উত্তর দিচ্ছেন, তাঁরা স্পষ্টভাবে অনুমোদন না করলে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হবে না, কিন্তু নাম এবং ঠিকানাগুলো নেওয়া দরকার, যাতে প্রয়োজন হলে আমরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।...
উত্তরগুলো যথানিয়মে সাজিয়ে নেওয়া হবে এবং সেগুলি বিশেষ পর্যালোচনার উপকরণ হিসাবে কাজে লাগবে। পর্যালোচনাগুলি Revue-তে (La Revue Socialiste) প্রকাশিত হবে এবং পরে গ্রন্থাকারে পুনর্মুদ্রণ করা হবে।
একশোটি প্রশ্ন
বিভাগ ১
১) আপনি কী কাজ করেন?
২) আপনি যেখানে কাজ করেন, তা কি একজন পুঁজিমালিকের, না একটি যৌথ মূলধনী সংস্থার? মালিকের অথবা কোম্পানির অধিকর্তাদের নাম?
৩) আপনি যেখানে কাজ করেন, কর্মী-সংখ্যা কত?
৪) তাঁদের প্রত্যেকের বয়স এবং লিঙ্গপরিচয় জানাবেন।
৫) শিশুদের (ছেলে বা মেয়ে) কোন বয়স থেকে নিয়োগ করা হয়?
৬) সাধারণ শ্রমিকের বাইরে, তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ওভারসিয়ার) এবং অন্যান্য কর্মীর সংখ্যা কত?
৭) শিক্ষানবিশ আছেন? ক’জন?
৮) সারা বছর যাঁরা নিয়মিত কাজ করেন, তাঁদের বাইরে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু দিন কাজ করতে আসেন এমন কর্মী আছেন?
৯) আপনাদের সংস্থা কি প্রধানত স্থানীয় ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য উৎপাদন করে, না কি দেশের বাজারে পণ্য বিক্রয় করে, না বিদেশে রফতানি হয়?
১০) কাজের জায়গাটি কি শহরে না গ্রামে? জায়গার নাম?
১১) কাজের জায়গা গ্রামে হলে সেখানে কি যথেষ্ট কাজ পান, না কি পাশাপাশি কৃষিমজুর হিসাবেও কাজ করতে হয়?
১২) হাত দিয়ে কাজ করেন না যন্ত্র ব্যবহার করে?
১৩) আপনাদের কারখানায় শ্রমবিভাজনের চেহারাটা কেমন?
১৪) বাষ্পচালিত (স্টিম) যন্ত্র ব্যবহার করা হয়?
১৫) উৎপাদনের বিভিন্ন বিভাগগুলো আলাদা আলাদা ভাবে চালানোর জন্য কতগুলো ঘর আছে? আপনি কোন ধরনের কাজ করেন, তার বিবরণ দেবেন। শুধু প্রযুক্তির বিবরণ নয়, পেশী এবং স্নায়ুর ব্যবহার কতটা এবং কী রকম, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উপর তার কী প্রভাব পড়ে, সেটাও বলবেন।
১৬) কাজের জায়গায় স্বাস্থ্য-পরিবেশ কেমন? ঘরগুলোর মাপ, প্রত্যেক কর্মীর জন্য বরাদ্দ জায়গা, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা, তাপমাত্রা, প্লাস্টারের হাল, শৌচাগার, সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতা, যন্ত্রের আওয়াজ, বাতাসে ধাতব পদার্থের গুঁড়ো কী মাত্রায় ভাসে, পরিবেশ কতটা স্যাঁতসেঁতে, ইত্যাদি সব কিছুর বিবরণ দেবেন।
১৭) পুর কর্তৃপক্ষ বা সরকারের তরফে কি কারখানার স্বাস্থ্য-পরিবেশ তদারকির কোনও বন্দোবস্ত করা হয়েছে?
১৮) আপনাদের কারখানা থেকে কি এমন কোনও বিশেষ বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশিত হয়, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর এবং যা থেকে কর্মীদের বিশেষ ধরনের রোগ হয়?
১৯) কাজের জায়গা কি খুব বেশি যন্ত্রে ঠাসা?
২০) দুর্ঘটনা নিবারণের জন্য ইঞ্জিন, ট্রান্সমিশন এবং যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয় কি?
২১) যে সব দুর্ঘটনার কথা আপনি জানেন, সেগুলির বিষয়ে জানাবেন।
২২) আপনি খনিতে কাজ করলে জানাবেন, বাতাস চলাচল ঠিকঠাক রাখার জন্য এবং বিস্ফোরণ বা অন্য ধরনের দুর্ঘটনা নিবারণের জন্য মালিকরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন।
২৩) রাসায়নিক পদার্থ, ইস্পাত বা অন্য ধাতব পদার্থ সংক্রান্ত কিংবা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক কোনও বস্তু উৎপাদনের কারখানায় কাজ করলে জানাবেন, মালিকরা নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা রেখেছেন।
২৪) আপনার কাজের জায়গায় কিসের আলো জ্বলে (গ্যাস, তেল, ইত্যাদি)?
২৫) অগ্নিকাণ্ড নিবারণের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক বন্দোবস্ত আছে?
২৬) দুর্ঘটনা ঘটলে নিয়োগকর্তা বা মালিক যাতে কর্মী বা তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকেন, সে রকম কোনও আইন আছে কি?
২৭) যদি আইন না-ও থাকে, তাঁর সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে মালিক কি কখনও ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন?
২৮) আপনাদের কর্মস্থলে প্রাথমিক চিকিৎসার বন্দোবস্ত আছে?
২৯) আপনি যদি বাড়িতে থেকে কাজ করেন, তা হলে আপনার কাজের জায়গাটির বর্ণনা দেবেন। আপনি কি শুধু হাত দিয়ে কাজ করার প্রকরণ (হাতুড়ি, বাটালি, ইত্যাদি) ব্যবহার করেন, না ছোটখাটো যন্ত্রও আছে? আপনি কি আপনার কাজে সন্তানদের বা অন্য কারও (প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা শিশু, পুরুষ বা নারী) সাহায্য নেন? আপনি কি (নিজের মতো করে) লোকের বায়না মাফিক কাজ করেন না কি কোনও মালিকের দেওয়া বরাত মেটান? নিজে সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, না কোনও মধ্যস্থ মারফত?
বিভাগ ২
৩০) দিনে কত ঘণ্টা কাজ করেন, এবং সপ্তাহে কত দিন?
৩১) সারা বছরে কত দিন ছুটি পান?
৩২) দিনে কাজের মধ্যে কত বার অবকাশ পান?
৩৩) নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাবার খান, না কি খাওয়াদাওয়া অনিয়মিত? কাজের জায়গাতেই খাওয়া সারেন না বাইরে?
৩৪) আহারের জন্য নির্ধারিত সময়েও কি কাজ চলতে থাকে?
৩৫) বাষ্পীয় শক্তি ব্যবহার করা হলে, কখন তা চালু হয়, কখন বন্ধ হয়?
৩৬) রাত্রেও কাজ চলে?
৩৭) শিশু এবং ১৬ বছরের কম বয়সিরা কত ঘণ্টা কাজ করে?
৩৮) শিশু এবং কিশোরদের কি কর্মদিবসের মধ্যে পালা করে পরস্পরের জায়গায় কাজ করতে হয়?
৩৯) সরকার বা পুর কর্তৃপক্ষ কি আপনার সংস্থার ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বিষয়ক আইন প্রয়োগ করেছে? মালিক কি সেই আইন মানেন?
৪০) আপনার কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত শিশু ও কিশোরদের জন্য স্কুল আছে? যদি থাকে, কখন পড়াশোনা হয়? স্কুল চালায় কে? কী পড়ানো হয়?
৪১) দিনে এবং রাতে কাজ হলে শিফ্টগুলো কীভাবে ভাঙা হয়?
৪২) বাজারের চাহিদা বেশি থাকলে কাজের ঘণ্টা কতটা বাড়ানো হয়ে থাকে?
৪৩) যন্ত্রগুলো পরিষ্কার করার জন্য কি আলাদা করে কর্মী আনা হয়, না কারখানার কর্মীরাই নিজেদের ফাঁকা সময়ে বা ছুটির দিনে সে-কাজ করেন?
৪৪) দেরি করে কাজে এলে তার জন্য কী নিয়ম আছে? কর্মদিবস শুরু হয় কখন? খাবারের জন্য নির্ধারিত এক ঘণ্টা অবকাশের পরে কাজ শুরু হয় কখন?
৪৫) কাজের জায়গায় পৌঁছতে এবং ঘরে ফিরতে কতক্ষণ সময় লাগে?
বিভাগ ৩
৪৬) মালিকের সঙ্গে আপনার চুক্তি কী ধরনের? দিনের হিসেবে কাজ করেন, না সপ্তাহের, না মাসের, না অন্য কোনও হিসেবে?
৪৭) কাজ থেকে ছাঁটাইয়ের বা কাজ ছেড়ে দেওয়ার শর্তগুলি কী রকম?
৪৮) মালিক চুক্তি ভাঙলে কী ধরনের শাস্তির নিয়ম আছে?
৪৯) কর্মী চুক্তি ভাঙলে কী ধরনের শাস্তির নিয়ম আছে?
৫০) শিক্ষানবিশদের চুক্তির শর্তাবলি কী?
৫১) স্থায়ী না ঠিকা, কোন ভিত্তিতে কাজ করেন আপনি?
৫২) আপনাদের সংস্থার কাজ কি সারা বছরই মোটামুটি সমান ভাবে চলে, না বছরের কোনও কোনও সময়? যদি সময়-ভিত্তিক কাজ হয়, তা হলে বছরের বাকি সময়টা কী ভাবে চালান?
৫৩) সময়-বাঁধা মজুরি (টাইম রেট) পান, না উৎপাদনের ভিত্তিতে (পিস রেট)?
৫৪) মজুরি সময়-বাঁধা হলে, ঘণ্টার হিসেবে টাকা পান না দিনের হিসেবে?
৫৫) ওভারটাইম, অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের থেকে বেশিক্ষণ কাজ করলে বাড়তি টাকা পান? তার হিসেব কী?
৫৬) উৎপাদনের ভিত্তিতে মজুরি পেলে কী ভাবে তা ঠিক হয়? পণ্যের সংখ্যা বা ওজন অনুসারে মজুরি ঠিক করা হলে (যেমন খনিতে হয়ে থাকে), মালিক বা তাঁর প্রতিনিধিরা আপনাদের ঠকিয়ে নেওয়ার কোনও চেষ্টা করেন কি?
৫৭) মজুরি উৎপাদন-ভিত্তিক হলে, পণ্যের গুণমান ভাল হয়নি, এই অজুহাতে মজুরি থেকে টাকা কেটে নেওয়ার চেষ্টা চলে না?
৫৮) মজুরির হিসেব যে ভাবেই ঠিক হোক, কখন তা মেটানো হয়? মানে, কাজ করার কত দিন পরে সেই কাজের মজুরি পান? এক সপ্তাহ, এক মাস...? মালিকের কাছে আপনার পাওনা কত দিন বকেয়া থাকে?
৫৯) এমনটা কি ঘটে যে, মজুরি পেতে সময় লাগছে বলে প্রায়শই আপনাকে জিনিসপত্র বন্ধক রাখতে হচ্ছে, তার জন্য চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে এবং তার ফলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না? কিংবা দোকানির কাছে ধার করতে হচ্ছে এবং তার জন্য সমস্যায় পড়ছেন? মালিকের ব্যবসা লাটে উঠেছে বা তিনি দেউলিয়া হয়েছেন বলে কর্মীরা কাজ হারিয়েছেন, এমন কোনও ঘটনার কথা জানেন কি?
৬০) মজুরি কি মালিক সরাসরি আপনাকে দেন, না তাঁর প্রতিনিধি— ঠিকাদার বা অন্য কেউ?
৬১) আপনার মজুরি যদি ঠিকাদার বা অন্য কোনও মধ্যস্থের হাত থেকে পান, সে ক্ষেত্রে চুক্তির শর্ত কেমন?
৬২) দৈনিক এবং সাপ্তাহিক হিসেবে আপনি কত মজুরি পান?
৬৩) আপনার কাজের জায়গায় মহিলা এবং শিশুরা কাজ করলে তাঁরা কী হারে মজুরি পান?
৬৪) আপনার কাজের জায়গায় গত মাসে সবচেয়ে বেশি দৈনিক মজুরি কত দেওয়া হয়েছে?
৬৫) সবচেয়ে বেশি উৎপাদন-ভিত্তিক মজুরি কত দেওয়া হয়েছে?
৬৬) ওই একই সময়ে আপনি কত পেয়েছেন? আপনার পরিবার থাকলে, স্ত্রী এবং শিশুরা কত পেয়েছেন?
৬৭) মজুরির সবটাই কি টাকায় দেওয়া হয়, না অন্য কোনও আকারে?
৬৮) আপনি যদি মালিকের কাছে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন, তা হলে তার শর্তাবলি কী? তিনি কি আপনার মজুরি থেকে ভাড়ার অঙ্ক কেটে রাখেন না?
৬৯) রোজকার দরকারি জিনিসপত্রের দাম (ও আনুষঙ্গিক বিষয়) কী রকম? যেমন:
ক) আপনার বাড়িভাড়া, ভাড়ার শর্তাবলি, ঘরের সংখ্যা, কত জন বসবাস করেন, মেরামতি, বিমা, আসবাবপত্র কেনা ও মেরামতি, ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা, আলো, জল, ইত্যাদি।
খ) খাবার: রুটি, মাংস, আনাজপাতি, আলু ইত্যাদি, ডিম, মাছ, মাখন, তেল, চর্বি, চিনি, নুন, মুদির দোকানের সামগ্রী, কফি, চিকরি (কফির সঙ্গে ব্যবহার করার জন্য), বিয়ার, ওয়াইন ইত্যাদি, তামাক।
গ) মা-বাবা এবং শিশুদের পোশাক, জামাকাপড় কাচা, ঘরদোর সাফাই, স্নান, সাবান ইত্যাদি।
ঘ) বিবিধ প্রয়োজনে খরচ, যেমন চিঠিপত্র, ধারদেনা, বন্ধকি কারবারিকে টাকা মেটানো, শিশুদের পড়াশোনা ও বৃত্তিশিক্ষা, সংবাদপত্র, বইপত্র ইত্যাদি, নানা সংস্থার অনুদান, ধর্মঘট, ইউনিয়ন, প্রতিরোধ সংগঠন ইত্যাদি।
ঙ) কাজের আনুষঙ্গিক কোনও খরচ।
চ) কর (রাজস্ব)।
৭০) আপনার নিজের এবং পরিবারের আয়ব্যয়ের সাপ্তাহিক ও বার্ষিক হিসাব তৈরির একটা চেষ্টা করবেন।
বিভাগ ৪
৭১) আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আপনি কি দেখেছেন যে মজুরির তুলনায় ঘরভাড়া, খাবার ইত্যাদির খরচ বেশি বেড়েছে?
৭২) মজুরির কী পরিবর্তন হয়েছে বলে আপনার জানা আছে?
৭৩) বাজার খারাপ থাকলে বা ব্যবসাবাণিজ্যের সঙ্কটের সময় মজুরি কী ভাবে কতটা কমে যায়?
৭৪) যখন বাজার ভাল থাকে বলে শোনা যায়, তখন মজুরি কী ভাবে কতটা বাড়ে?
৭৫) বাজারের রুচিপছন্দের পরিবর্তনের ফলে এবং আংশিক বা সম্পূর্ণ ধর্মঘটের কারণে কাজ বন্ধ থাকার বিবরণ দেবেন। বাধ্য হয়ে বসে থাকতে হয়েছে, এমন অভিজ্ঞতার বিবরণ দেবেন।
৭৬) আপনি যে পণ্য উৎপাদন করেন বা যে পরিষেবা দেন, তার দামের সঙ্গে আপনার মজুরি তুলনা করবেন।
৭৭) যন্ত্র ব্যবহারের ফলে বা অন্য কোনও উন্নতির কারণে কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়েছে, এমন কোনও ঘটনার কথা জানা থাকলে তার বিবরণ দেবেন।
৭৮) যন্ত্র ব্যবহার এবং শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাজের সময় এবং চাপ বেড়েছে না কমেছে?
৭৯) উৎপাদনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মজুরি বাড়ার কোনও উদাহরণ কি আপনার জানা আছে?
৮০) কোনও সাধারণ কর্মী ৫০ বছর বয়সে অবসর নিয়ে কর্মজীবনের উপার্জন থেকে সঞ্চিত অর্থে জীবনযাপন করছেন, এমন দৃষ্টান্ত আপনার জানা আছে কি?
৮১) আপনি যে কাজ করেন সেখানে গড়পড়তা স্বাস্থ্যের এক জন কর্মী কত বয়স পর্যন্ত কাজ করতে পারেন?
৮২) আপনার কর্মক্ষেত্রে (শোষণ বা নিপীড়নের বিরুদ্ধে) কোনও প্রতিরোধী সংগঠন আছে কি, থাকলে সেগুলি কী ভাবে পরিচালিত হয়? তাদের নিয়মকানুনের বিবরণ পাঠাবেন।
৮৩) আপনার কর্মক্ষেত্রে কতগুলি ধর্মঘট হয়েছে বলে আপনার জানা আছে?
৮৪) ধর্মঘটগুলি কত দিন চলেছে?
৮৫) সেগুলি কি সাধারণ ধর্মঘট ছিল, না আংশিক?
৮৬) ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল কী কারণে? মজুরি বাড়ানোর দাবিতে, না মজুরি কমানোর উদ্যোগ আটকাতে, না কর্মদিবসের মেয়াদ বাড়ানোর বিরুদ্ধে, না কি অন্য কোনও উদ্দেশ্যে?
৮৭) ধর্মঘটের ফল কী হয়েছিল?
৮৮) সালিশি আদালতের কাজকর্ম কেমন?
৮৯) আপনার কর্মক্ষেত্রে ধর্মঘট হলে তার সমর্থনে অন্য কোনও ক্ষেত্রের কর্মীরা কখনও ধর্মঘট করেছেন?
৯০) আপনার মালিক তাঁর কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কী ধরনের নিয়ম বা জরিমানার রীতি জারি করেছেন তার বিবরণ দেবেন।
৯১) মজুরি কমানো, কর্মদিবসের মেয়াদ বাড়ানো, ধর্মঘট প্রতিরোধ বা সাধারণ ভাবে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মালিকরা কখনও সংগঠন তৈরি করেছেন কি?
৯২) এমন কোনও দৃষ্টান্ত কি আপনার জানা আছে, যেখানে সরকার মজুরি-কর্মীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীকে অন্যায়ভাবে মালিকদের সাহায্য করতে বলেছে?
৯৩) মালিক এবং তাঁদের বেআইনি সংগঠনের নিপীড়ন থেকে কর্মীদের রক্ষা করতে সরকার হস্তক্ষেপ করেছে, এমন কোনও দৃষ্টান্ত কি আপনি জানেন?
৯৪) যে সব শিল্প সংক্রান্ত আইন (ফ্যাক্টরি ল) জারি আছে, মালিকদের স্বার্থবিরোধী (হলেও) সেই আইনগুলি কার্যকর করতে সরকার কি তৎপর থাকে? সরকারি পরিদর্শকরা কি তাঁদের কর্তব্য পালন করেন?
৯৫) আপনার কাজের জায়গায় বা কর্মক্ষেত্রে কি এমন কোনও সংস্থা কাজ করে যারা দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, মৃত্যু, সাময়িক অক্ষমতা, বার্ধক্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর্মীদের সাহায্য করে? তেমন সংস্থার নিয়মকানুন আমাদের পাঠিয়ে দেবেন।
৯৬) এই সব সংস্থার সদস্যপদ স্বেচ্ছাধীন না আবশ্যিক? তাদের তহবিল কি পুরোপুরি কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে?
৯৭) যদি এই সব সংস্থার চাঁদা আবশ্যিক হয় এবং তা মালিকের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ক্ষেত্রে কি সেই চাঁদার টাকা মজুরি থেকে কেটে রাখা হয়? মালিকরা কি সেই কেটে নেওয়া টাকার উপর সুদ দেন? কর্মী কাজ ছেড়ে দিলে বা তাঁকে ছাড়িয়ে দেওয়া হলে কেটে নেওয়া টাকা কি তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়? মালিকরা যে তথাকথিত পেনশন তহবিল চালান, যার প্রাথমিক পুঁজি তৈরি হয়েছিল কর্মীদের মজুরি থেকে কেটে নেওয়া টাকা দিয়ে, কোনও কর্মী কখনও সেই তহবিল থেকে সাহায্য পেয়েছেন, এমন কোনও ঘটনার কথা আপনি জানেন কি?
৯৮) আপনার কর্মক্ষেত্রে কি সমবায়-ভিত্তিক গিল্ড আছে? সেগুলি কী ভাবে পরিচালিত হয়? তারা কি পুঁজিমালিকদের পদ্ধতিতেই মজুরির ভিত্তিতে কর্মীদের নিয়োগ করে? তাদের নিয়মকানুন আমাদের পাঠিয়ে দেবেন।
৯৯) আপনার কর্মক্ষেত্রে এমন কোনও কারখানা কি আছে যেখানে কর্মীদের প্রাপ্য কিছুটা মজুরি হিসেবে দেওয়া হয় আর কিছুটা তথাকথিত লভ্যাংশ হিসেবে? যে কর্মীরা এমন লভ্যাংশ পান না, তাঁদের প্রাপ্যের সঙ্গে এই কর্মীদের প্রাপ্য তুলনা করুন। এই পদ্ধতিতে যে কর্মীরা কাজ করেন তাঁদের কী কী বাধ্যবাধকতা থাকে, জানাবেন। যেমন তাঁরা কি ধর্মঘটে যোগ দিতে পারেন? না কি তাঁদের মালিকের অনুগত কর্মচারী হয়েই থাকতে হয়?
১০০) সাধারণ ভাবে আপনার কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত পুরুষ ও নারী কর্মীদের জীবনের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক অবস্থা কেমন?
১০১) সাধারণ কোনও বক্তব্য বা মন্তব্য।