বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

মে-দিবস ও পরিবেশ আন্দোলন

মে-দিবস ও পরিবেশ আন্দোলন

বঙ্কিম দত্ত

photo

বিশ্বজুড়ে ১লা মে সরকারি ছুটির দিন যা উদযাপিত হয় মিডিয়া কভারেজ এবং কর্পোরেট শুভেচ্ছাবার্তা দিয়ে। কিন্তু পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর শক্তি হ্রাস, চুক্তিভিত্তিক কাজের বিস্তার এবং শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী প্রয়োগের কারণে দিবসটির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব কমেছে। দিনটিকে শ্রমিকের মর্যাদার প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করা হলেও বাস্তবত শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক ভূমিকার নিম্নগামিতা স্পষ্ট।
১লা মে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য আজ গুণগতভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। ১৮৮৬ সালের হে মার্কেটের দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরি, ইউনিয়ন অধিকার। শত্রু ছিল স্পষ্ট — শিল্পপতিরা, রাষ্ট্রের দমনমূলক (পুলিশ, সামরিক বাহিনী) ব্যবস্থা।
শ্রমিক আন্দোলনের অস্ত্র ছিল শ্রেণীসংগ্রাম, গণধর্মঘট, কারখানা গেটে মিছিল মিটিং ইত্যাদি।
আজ অনেক পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। শত্রু এখন আর শুধু “কাপড়কলের মালিক” নয়, বরং একটি জটিল, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় শ্রমের সঙ্গে সমানতালে প্রকৃতিও শোষিত। শ্রমিক আন্দোলন ও পরিবেশবাদকে ঐতিহাসিকভাবে পৃথক হিসাবে দেখা হলেও, জলবায়ু সংকট ও নব্য-পুঁজিবাদী শোষণের যুগে এদের মিলন অপরিহার্য। নাওমি ক্লাইনের This Changes Everything: Capitalism vs. The Climate (২০১৪) বইয়ের একটি উক্তি “যখন শ্রমিক ও পৃথিবী একসঙ্গে লড়ে, তখন পুঁজির অট্টহাসি থেমে যায়।” স্পষ্টত পরিবেশ বনাম উন্নয়ন যে একটি মিথ্যা দ্বন্দ্ব নাওমি ক্লাইন সে কথাই বলছেন। নাওমি ক্লাইন (জন্ম: ১৯৭০, মন্ট্রিয়ল, কানাডা) একজন বিশ্ববিখ্যাত কানাডীয়-ইহুদি সাংবাদিক, লেখিকা ও বামপন্থী কর্মী, যাঁর চিন্তাশীল লেখনি ও কর্ম-উদ্দীপনা পুঁজিবাদসৃষ্ট জলবায়ু সংকট এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের মধ্যেকার সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে। তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এবং কর্পোরেটবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত। “আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবীদের একজন... যিনি পুঁজিবাদের অন্ধকার দিককে আলোয় আনেন” বলেছে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা।
শ্রমিক ও পরিবেশবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের মূল কারণ অর্থনীতি বনাম পরিবেশগত প্রাধান্যের টানাপোড়েন। যেমন, কারখানা বন্ধ করলে পরিবেশ রক্ষা হয়, কিন্তু শ্রমিকরা বেকার হয়। এই দ্বন্দ্ব দূর করতে ন্যায্য পরিবর্তন (Just Transition), প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সামাজিক সংহতির মডেল প্রয়োজন।
নাওমির মতে শ্রমিকরাই পারেন উৎপাদন ব্যবস্থাকে টেকসইভাবে বদলাতে, আর পরিবেশকর্মীরা পারেন তাদের সংগ্রামকে বিশ্ব স্তরে নিয়ে যেতে। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে শ্রমিক আন্দোলন ও পরিবেশ আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিভাজন ভেঙে একটি বিপ্লবী সম্মিলিত শক্তি গঠিত হতে পারে। সমাজতন্ত্র, ইকো-সোশ্যালিজম ও ফেমিনিজম দ্বারা প্রভাবিত নাওমি অবস্থানগতভাবে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ ও বহুজাতিক কোম্পানির বিরোধী। মে দিবসের চেতনায় শ্রমিক ও পরিবেশ আন্দোলনকারীদের জোটই হতে পারে একুশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের মডেল, নাওমির মত এমনই।
জলবায়ু সংকট হল পুঁজিবাদের ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা। এর সমাধান শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া অসম্ভব। কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। কারখানার দূষণ, খনির ধ্বংসসাধন তাদেরই প্রথম আঘাত করে। উৎপাদন ব্যবস্থায় সরাসরি হস্তক্ষেপে সক্ষম শ্রমিকরা যখন ধর্মঘট বা কারখানা দখল এর মাধ্যমে উৎপাদন বন্ধ করে, তখন দূষণকারী শিল্পের লাভ ক্ষতিগ্রস্ত হয় (২০১৯-এ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণা দেখায়, শ্রমিক ধর্মঘট কার্বন নিঃসরণ ৫% কমায়), বিকল্প টেকসই মডেল চাপিয়ে দেওয়া যায় (আর্জেন্টিনার Zanon ফ্যাক্টরি দখল করে শ্রমিকরা ইকো-ফ্রেন্ডলি সিরামিক উৎপাদন শুরু করে), ইউনিয়ন শক্তি বৃদ্ধির আইন পাস করানো সম্ভব হয় (যুক্তরাষ্ট্রের PRO Act ২০২১)।
বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে হওয়া মামলা (২০০৩) Chevron vs. Ecuador স্মরণ করা যাক। সেখানে আদিবাসী ও তেল শ্রমিকদের যৌথ লড়াইয়ে কোম্পানিকে ৯.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা ধার্য করা গেছে। ২০০৩ সালে ইকুয়েডরের ৩০,০০০ জন আদিবাসী ও স্থানীয় বাসিন্দারা Chevron (Texaco) এর বিরুদ্ধে Lago Agrio আদালতে অভিযোগ করে, Texaco ইচ্ছাকৃতভাবে পরিবেশ দূষণ করেছে, কোম্পানিটি ক্ষতিগ্রস্তদের কোনও স্বাস্থ্যসেবা বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা দেয়নি ও ইকুয়েডরের পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতি করেছে। যে জনগণ প্রাকৃতিক সম্পদে নির্ভর করে বাঁচে, যদি সেই সম্পদই ধ্বংস করে ফেলা হয় — তবে উন্নয়নের আসল অর্থ কী, এই নৈতিক প্রশ্নে পরিবেশ কর্মী, শ্রমিক ও আদিবাসী মানুষের সমন্বিত আন্দোলনের এক যুগান্তকারী উদাহরণ এই কর্পোরেটবিরোধী আইনী লড়াইটি।
খনিজ তৈল-জ্বালানি কর্পোরেট Shell-এর বিরুদ্ধে ডাচ আদালতের রায় (২০২১)-এ কার্বন কাটছাট বাধ্যতামূলক করা অন্য আরেকটি উদাহরণ। ফ্লিন্ট, মিশিগানের জল সংকট (২০১৪-বর্তমান), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিবেশগত ও জনস্বাস্থ্য কেলেঙ্কারিগুলোর একটি। এই পরিবেশগত বিপর্যয়ে সীসা-দূষিত জল সরবরাহ কয়েক হাজার বাসিন্দাকে (বিশেষত শিশু) প্রাণঘাতী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে। এই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়ন ও পরিবেশ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক মডেল তৈরি করেছে। কানাডার টারস্যান্ডস অয়েল প্রজেক্ট বিরোধী আন্দোলন, ২০১৩এ তৈরি হয় শ্রমিক ও আদিবাসীদের এক ঐতিহাসিক জোট।
কানাডার অ্যালবার্টার টারস্যান্ডস অয়েল স্যান্ডস প্রকল্প বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত জ্বালানি প্রকল্পগুলোর একটি, যেখানে শ্রমিক ইউনিয়ন ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের যৌথ আন্দোলন জলবায়ু, স্বাস্থ্য ও শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নকে একসূত্রে গেঁথেছে। নাওমি উল্লেখিত শ্রমিক ও পৃথিবীর একসঙ্গে লড়ার উদাহরণ বাড়ছে।
আধুনিক বিশ্বে বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রভাব যেমন অর্থনৈতিকভাবে সুদূরপ্রসারী, তেমনি সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রেও তাদের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা প্রবল। বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই নয়, মানুষের জীবনধারা, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও জীবনের মান অনেকক্ষেত্রেই পুরোদস্তুর উপেক্ষিত। বিশ্বায়নে বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের সুযোগ তৈরি হওয়া এবং অতি সামান্য মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি ঘটলেও, এর নেতিবাচক দিকগুলো শ্রমিকদের জীবনে সরাসরি গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষত কম মজুরিতে শ্রমশক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমানোর প্রবণতা তথা ‘সুপার প্রফিট’ কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে চূড়ান্ত শ্রমিক শোষণের রাস্তায় নিয়ে গেছে। রাষ্ট্র কর্পোরেট-বন্ধু ভূমিকা নিয়ে জনগণের অর্থ ও সম্পদ তুলে দিচ্ছে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছ থেকে ধার নেওয়া এই গ্রহের প্রাকৃতিক সম্বলকে লুন্ঠন ও পরিবেশ বিপর্যস্ত করাটাই আজকের CSR (Corporate Social Responsibility)। কিন্তু এখন স্পষ্ট যে এ কোনও অন্ধগলি নয় যার নাম TINA (there is no alternative)। ২০১৯ সালে গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক-এ ইতালির শ্রমিক ইউনিয়নগুলি কর্মবিরতি ডেকে সমর্থন জানায়, বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন এর সঙ্গে পরিবেশবাদী গোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব (যেমন: “পরিবেশ বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও” ক্যাম্পেইন) গড়ে ওঠে, যুক্তরাজ্যের “ক্লাইমেট জাস্টিস কোলাব”-এ ট্রেড ইউনিয়ন ও পরিবেশ এক্টিভিস্টরা একসঙ্গে কাজ করে। ভারতের কুদানকুলাম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনে মৎস্যজীবী, কৃষক, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ও শ্রমিক সংগঠন একত্রিত হয়েছিল। একই উদাহরণ তৈরি হচ্ছে এরাজ্যের নদীয়া জেলায় বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার আন্দোলনে। শ্রমিক-পরিবেশ আদালত যেমন লাতিন আমেরিকায় “ট্রাইব্যুনাল ফর ইকোলজিক্যাল ডেবট”-এর মডেলে শ্রমিক ও পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ একসঙ্গে আদায় করার আইনী ব্যবস্থার জন্য লড়াই জারি আছে। লাতিন আমেরিকার পরিবেশগত ন্যায়বিচার আন্দোলন-এর একটি উদ্ভাবনী হাতিয়ার হল “ইকোলজিক্যাল ডেবট ট্রাইব্যুনাল”। এটি একটি জন-আদালত (People’s Tribunal) যেখানে রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা পরিবেশগত ধ্বংস ও শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতীকী ও বাস্তবমুখী রায় দেওয়া হয়। একথা ঠিক যে ট্রাইব্যুনালের রায় আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে। আজকে মে-দিবসের আবহে শ্রমিক ও পরিবেশ আন্দোলনের যৌথমঞ্চে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত সংলাপ হতে পারে — ইকোলজিক্যাল ডেবট ট্রাইব্যুনাল শুধু আদালত নয়, এটি একটি বিপ্লবী থিয়েটার — যেখানে শোষিতরা ইতিহাসের বিচারক হয়।
বিগত কয়েক দিনে খোদ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে শ্রমিক, কর্মচারী, পরিবেশ কর্মী ও মধ্যবিত্ত নারী-পুরুষরা লক্ষাধিক সংখ্যায় ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে সামিল। ডলার সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে মার্কিন দেশ তাদের শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত সমাজের উপর আক্রমণ জোরালভাবে নামিয়ে আনছে। আগেই আউটসোর্সিং এর মধ্যে দিয়ে মার্কিন শ্রমিকের জীবনকে চরম দারিদ্রতায় নামিয়ে এনেছে, বেকারি বেড়েছে। এখন তার বোঝা নামছে মধ্যবিত্ত সমাজেরও মাথার উপর। দিকে দিকে প্রতিবাদ সবল হচ্ছে। গড়ে উঠছে শ্রমিক আন্দোলনের সমকালীন ভাষ্য। মে-দিবস নতুন তাৎপর্যে ভাস্বর হয়ে উঠছে এসবের সম্পৃক্ততায়। চে গুয়েভারার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করা যাক, “The revolution is not an apple that falls when it is ripe. You must make it fall.”

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.