বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধ করার জন্য আপনি ব্যক্তিগত ভাবে কী কী করছেন? প্লাস্টিকের দৌরাত্ম্য কমাতে সর্বদা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরোচ্ছেন, যে ব্যাগ বার বার ব্যবহার করা যায়? প্লাস্টিকের বোতল কিনবেন না বলে সঙ্গে রাখছেন নিজের আধার? বিদ্যুৎচালিত গাড়িও কিনেছেন? তা হলে শুরুতেই একটা কথা পরিষ্কার বলে দেওয়া যাক: এই সব ভাল ভাল কাজ শেষ অবধি একেবারেই অর্থহীন। এমনকি এতে যতটুকু লাভ হবে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে।
— এই কথাগুলি দিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক বইটি শুরু করেছেন কোহেই সাইতো। বইয়ের নাম স্লো ডাউন। জাপানি ভাষায় লেখা মূল বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, এটি তার ইংরেজি অনুবাদ, বাজারে এসেছে গত বছর। মূল বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দেশ জুড়ে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। চার বছরে বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লক্ষ কপি। ইংরেজি সংস্করণের পূর্বকথায় লেখক জানিয়েছেন, (মূল) বইটি যখন প্রথম বেরোয়, তিনি ভাবতেও পারেননি এত লোক এ-বই কিনবে। কিন্তু ‘আমি সম্পূর্ণ ভুল ভেবেছিলাম।’ ভুল কখনও কখনও বড় মধুর।
কোহেই সাইতোর জন্ম ১৯৮৭ সালে। দর্শনের ছাত্র। ইকোলজি তথা প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ে কার্ল মার্ক্সের ভাবনাচিন্তা নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য গবেষণা করেছিলেন। তার সূত্রেই মার্ক্স-এঙ্গেলস-এর সম্পূর্ণ রচনাবলি (মেগা) প্রকাশের সুদীর্ঘ, এবং এখনও অসমাপ্ত, প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি, তাঁদের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র ও আনুষঙ্গিক আলোচনা খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। কেবল গবেষণাপত্রে নয়, সাইতোর সামগ্রিক চিন্তাধারায় গভীর ছাপ পড়ে এই মার্ক্সীয় চর্চার। ২০১৭ সালে মান্থলি রিভিউ প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় কার্ল মার্ক্স’স ইকোসোশালিজ়ম: ক্যাপিটাল, নেচার অ্যান্ড দি আনফিনিশড ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকনমি। মার্ক্সের বিপুল রচনাসম্ভার, বিশেষত তাঁর শেষ বয়সের লেখালিখি, বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধ সম্পর্কে তাঁর নোট, টীকাটিপ্পনী, এঙ্গেলস ও অন্যদের সঙ্গে আলোচনা ইত্যাদির ভিত্তিতে সাইতো দেখান, পুঁজির গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণে মার্ক্স প্রকৃতি-পরিবেশের স্বাস্থ্য ও সুস্থিতিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, পুঁজি তার স্বভাবধর্মের অনিবার্য তাড়নাতেই কীভাবে প্রকৃতি-পরিবেশের কাঠামোকে, তার অন্তর্নিহিত ভারসাম্যকে ধ্বংস করছে এবং করবে। ‘মেটাবলিক রিফ্ট’-এর ধারণা এসেছে ক্যাপিটাল-এর প্রস্তুতিপর্বেই, বস্তুত তারও আগেই। সেই ধ্বংসকাণ্ড আজ পৃথিবী নামক গ্রহ ও তার অধিবাসীদের জীবনকে আক্ষরিক অর্থেই প্রলয়ের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন সহ প্রকৃতি-পরিবেশের যে বিপর্যয় নিয়ে আজ গোটা দুনিয়া গভীর উদ্বেগে জর্জরিত, তার মূলে আছে পুঁজিতন্ত্রের লীলা। সেই প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করছে, তার কার্যকারণসূত্র বুঝতে হলে মার্ক্সের আলোচনা আমাদের পরম সহায়।
কথাটা নতুন নয়, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকেই জন বেলামি ফস্টার, পল বার্কেট, ব্রেট ক্লার্ক প্রমুখ গবেষকরা মার্ক্সীয় তত্ত্বে পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কিত বিশ্লেষণের ধারা নিয়ে ব্যাপক ও গভীর আলোচনা করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, আজ যাকে ইকোসোশালিজ়ম বা পরিবেশবান্ধব সমাজতন্ত্র বলা হচ্ছে, যে সমাজতন্ত্র প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে চলতে চায়, মার্ক্স তার অগ্রপথিক। মার্ক্সের জন্মের দ্বিশতবর্ষে প্রকাশিত সাইতোর গবেষণাগ্রন্থটি সেই আলোচনাতেই এক নতুন মাত্রা যোগ করে বলল: ইকোলজি সম্পর্কে মার্ক্সের চিন্তা কেবল তাঁর সামগ্রিক তত্ত্বভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেই ভাবনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ— প্রকৃতি-পরিবেশকে বাদ দিয়ে তাঁর পুঁজি-তত্ত্বকে ধরাই যাবে না।
আরও পাঁচ বছর পরে, ২০২২ সালে, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশ পেল কোহেই সাইতোর পরের বই: মার্ক্স ইন দি অ্যানথ্রপসিন: টুওয়ার্ডস দি আইডিয়া অব ডিগ্রোথ কমিউনিজ়ম। ইতিহাসের কোনও কোনও পর্বে পাঁচ বছর অতি দীর্ঘ সময়। কেবল কোভিড-১৯ নামাঙ্কিত অতিমারির কারণে নয়, অন্য দিক থেকেও এই সময়পর্বের মধ্যে ইকোলজির সঙ্কট নিয়ে দুনিয়ার মানুষের সচেতনতা ও উদ্বেগ ঘনিয়েছে অভূতপূর্ব মাত্রায়। ২০১৮ সালে গ্রেটা থুনবার্গ নামক কিশোরীর একক প্রতিবাদ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে, নবীন প্রজন্মের অগণিত প্রতিনিধি বড় বড় রাষ্ট্রের মহাশক্তিধর নায়ক আর তাঁদের স্যাঙাত তথা চালক কর্পোরেট যূথপতিদের মুখের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে: কোন হিসেবে আপনারা আমাদের ভবিষ্যৎকে এমন সর্বনাশের গ্রাসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, এখনও কেন এই গ্রহকে বাঁচাতে তৎপর হচ্ছেন না? এই সমবেত প্রশ্ন যে শক্তিমানদের লুণ্ঠনলীলাকে দমন করতে পেরেছে এমন বলা যাবে না, ঠিক যেমন পারেনি অতিমারিও, তাঁরা দুর্বার গতিতে স্ফীতকায় থেকে আরও স্ফীতকায় হয়ে উঠছেন, এমনকি ওয়াশিংটন ডিসিতে দ্বিগুণ শক্তি সহকারে ফিরে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পৃথিবীর বিপন্নতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সচেতনতার কোনও দাম নেই। সচেতনতা ছাড়া আত্মরক্ষার লড়াই চলতে পারে না।
এই সচেতনতাকেই এক নতুন স্তরে পৌঁছে দেয় কোহেই সাইতোর দ্বিতীয় গ্রন্থটি। পৌঁছে দেয় মার্ক্সের হাত ধরেই। এ-বইয়ের ভূমিকায় সাইতো লিখেছিলেন, ১৮৬৮ সালের পরে মার্ক্সের চিন্তাধারায় একটি তাত্ত্বিক পর্বান্তর (থিয়োরেটিকাল ব্রেকথ্রু) ঘটে যায়। তার পিছনে ছিল তাঁর দিগন্তপ্রসারী পড়াশোনা। এক দিকে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন ‘ন্যাচারাল সায়েন্স’ বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের পাঠে মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি, অন্য দিকে মানবিকী বিদ্যা এবং সমাজবিজ্ঞানের আকৈশোর প্রগাঢ় অধ্যয়ন প্রগাঢ়তর হয়ে চলছিল। বিশেষত এই পর্বে তিনি পশ্চিম ও পূর্ব গোলার্ধের বিভিন্ন প্রাচীন সমাজের জীবনধারা সম্পর্কে গভীর ভাবে চর্চা করেন, পাশাপাশি গবেষণা করেন রাশিয়ার কৃষিসমাজের কাঠামো ও গতিপ্রকৃতি বিষয়ে। ‘মেগা’ প্রকল্পের কল্যাণে এখন তাঁর এই পর্বের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তাভাবনার অনেক বেশি বিশদ এবং স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া গিয়েছে।
সাইতোর বক্তব্য, এই চর্চার মধ্য দিয়ে ১৮৮০-র দশকে অর্থাৎ জীবনের শেষ পর্বে মার্ক্স পুঁজিতন্ত্র-উত্তর সমাজের এক নতুনতর ধারণার কাছে পৌঁছেছিলেন। সমাজতন্ত্রকে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যত্নবান থাকতে হবে— এই লক্ষ্য তখন আর তাঁর কাছে যথেষ্ট নয়, এই পর্বে এসে তিনি ভাবছিলেন এমন একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা, যেখানে গ্রোথ অর্থাৎ আর্থিক বৃদ্ধিকে লক্ষ্য বলে মনে করা হবে না, বজায় রাখা হবে একটি ‘স্টেডি স্টেট’ বা সুস্থিত অবস্থা, সেই সুস্থিতিই হবে আদ্যোপান্ত সুষম ও সুস্থায়ী (র্যাডিকালি ইকোয়াল অ্যান্ড সাস্টেনেবল) এক সমাজের ভিত্তি। সাইতো এরই নাম দিয়েছেন ‘ডিগ্রোথ কমিউনিজ়ম’। ‘ডিগ্রোথ’ শব্দটি স্পষ্টতই গ্রোথ বা আর্থিক বৃদ্ধির বিপরীত। বাংলায় একে বলা চলে অ-বৃদ্ধি। সম্পদ, আয়, উৎপাদন ইত্যাদির (ক্রমাগত) বৃদ্ধি ঘটাতে হবে— এই নীতি বা অনুশাসনকে সরাসরি অস্বীকার করে অ-বৃদ্ধির ধারণাটি। কমিউনিজ়মের মার্ক্সীয় দর্শনকে এই ধারণার সঙ্গে যুক্ত করছেন সাইতো। এ-কথা বহুচর্চিত যে কমিউনিজ়ম সম্পর্কে মার্ক্সের প্রকল্প অসম্পূর্ণ এবং, অসম্পূর্ণ বলেই, সম্ভাবনাময়। মার্ক্সীয় ভাবনার অনুসারী তাত্ত্বিক এবং নীতিকাররা নানা ভাবে নানা দিক থেকে সেই সম্ভাবনাকে চরিতার্থ করার নানা পথ খুঁজেছেন। সাইতোর গবেষণা তার একটি নিদর্শন। সেখানে মার্ক্সীয় কমিউনিজ়ম-এর পথটি গ্রোথ বা আর্থিক বৃদ্ধির ছকে বাঁধা নয়, তা হল অ-বৃদ্ধির পথ।
ডিগ্রোথ বা অ-বৃদ্ধির ধারণাটি নতুন নয়। বহু যুগ ধরেই বিভিন্ন ধরনের সামাজিক উপদেষ্টা সম্পদ, আয় এবং উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলার পথ বর্জন করার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। কেবল ধর্মগুরু নয়, সেই তালিকায় আছে তলস্তয় বা গান্ধী সহ বহু পরিসরের বহু চিন্তানায়কের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কিন্তু মার্ক্স? ১৮৪৮ সালের ইস্তাহারে যিনি পুঁজির অনন্ত আত্মস্ফীতির অভিযানের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবকে দেখেছিলেন, যে সমাজতন্ত্র জাগতিক সমৃদ্ধির এক অভূতপূর্ব এবং অসীম দিগন্তে পৌঁছে দেবে শ্রমজীবী মানুষকে, অর্থাৎ সবাইকে? ‘প্রমিথিউস’ আখ্যায় ভূষিত সেই চিন্তানায়ক ‘ডিগ্রোথ’-এর কথা বলবেন কোন যুক্তিতে?
সাইতোর জবাব: পুঁজিতন্ত্রকে উৎখাত করার যুক্তিতেই। এই আলোচনার প্রথম পর্বে যে কথা বলা হয়েছিল সেটিতে ফিরে আসা যাক। আমরা দেখেছি, মার্ক্স কার্যত শুরু থেকেই লক্ষ করেছিলেন যে, পুঁজি তার স্বভাবধর্মের অনিবার্য তাড়নাতেই ইকোলজিকে ধ্বংস করছে এবং করবে। শ্রমজীবীর শ্রমশক্তিকে শোষণ করে করে, অর্থাৎ তার উৎপাদন থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করে করে নিজেকে উত্তরোত্তর স্ফীত করে তোলাই তার ধর্ম। স্বধর্মে স্থিত থাকতে হলে সে যেমন শ্রমিকের শরীর-মনের স্বাস্থ্য নিয়ে মাথা ঘামাতে পারে না, তেমনই মাথা ঘামাতে পারে না প্রকৃতি-পরিবেশের সুস্থায়ী ভারসাম্য নিয়েও। এটা পুঁজির ‘দোষ’ নয়, এটাই তার স্বভাব। অতএব, প্রকৃতি-পরিবেশকে যদি রক্ষা করতে হয়, তবে পুঁজির ধর্মকেই সরাসরি অস্বীকার করা জরুরি। এই লড়াইয়ে মধ্যপন্থা বলে কিছু নেই।
কিন্তু সবুজ প্রযুক্তি? যার অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আজ এত কলরব, এত আশাবাদ? সে কি শেষ অবধি পুঁজির এই স্বভাবকে অতিক্রম করতে পারবে না? না, পারবে না। সৌরবিদ্যুৎ, কার্বন সংগ্রহ (ক্যাপচার), জলসঞ্চয়, সবই যত দূর যায় তত দূর খুব ভাল, কিন্তু যথেষ্ট দূর অবধি যাওয়ার ক্ষমতা এদের নেই। সবুজ প্রযুক্তি দিয়ে শিল্পায়ন এবং নগরায়ণের পরিবেশ-সংহারী প্রভাবকে পাকাপাকি ভাবে প্রতিহত করা যাবে, উন্নয়ন এবং পরিবেশ-রক্ষা একই সঙ্গে সম্ভব হবে— এই গল্পটা শেষ অবধি দাঁড়ায় না, কারণ পুঁজি তেমন কোনও ভারসাম্যকে মেনে নিতে পারে না। তার কাছে প্রযুক্তি এবং প্রকৃতি, দুইই মুনাফার উৎস বা উপকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাই, যে সবুজ প্রযুক্তি আজ প্রকৃতি-সংহারের মাত্রা কিছুটা কমাচ্ছে, কাল আরও বেশি মুনাফা সংগ্রহের তাড়নায় সেই প্রযুক্তিকেই আরও ব্যাপক এবং গভীর ভাবে ব্যবহার করতে চাইবেন কর্পোরেট অধীশ্বররা, প্রকৃতির উপর চাপ আবার বাড়বে, বেড়ে চলবে। এই প্রক্রিয়া বড়জোর কিছুটা প্রলম্বিত হতে পারে, ধ্বংসলীলাকে কালকের বদলে পরশু অবধি ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে, তার বেশি নয়। শুধু তা-ই নয়, যাকে ‘পরিচ্ছন্ন’ শিল্প বা প্রযুক্তি বলা হচ্ছে, তার উপকরণ জোগাতেও প্রায়শই প্রচণ্ড দূষণ সৃষ্টি করা হচ্ছে— বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরির জন্য লিথিয়াম নিষ্কাশনের আয়োজন যার এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। বস্তুত, আমরা যদি ব্যক্তিগত জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে বা বৈদ্যুতিক গাড়ি চালিয়ে পরিবেশ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত বোধ করি, সেই নিশ্চিন্ততা ওই ধ্বংসের প্রক্রিয়াকেই জোরদার করবে। সুতরাং, কোনও বিচ্ছিন্ন বা সাময়িক ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, পুঁজিতন্ত্রের নির্দেশে চালিত সমাজ আর অর্থনীতিকে বলতে হবে: আর নয়, ইহ তিষ্ঠ, ঘুরে দাঁড়াও, ভাবো, সীমাহীন সমৃদ্ধির নামে এই লাগামছুট দৌড় বন্ধ করো, ধীরে চলো।
এই কথাটা ঠিক এই ভাবে বলতে চেয়েছেন বলেই কোহেই সাইতো তাঁর সাম্প্রতিক বইটির ইংরেজি সংস্করণের শিরোনাম দিয়েছেন স্লো ডাউন। তাঁর আগের দুটি বই থেকেই সরাসরি উঠে এসেছে এই তিন নম্বর গ্রন্থ, কিন্তু এ-বইয়ের রচনাশৈলী অন্য দুটির থেকে অনেক বেশি সহজ। এখানে মার্ক্সীয় ও অন্যান্য তত্ত্বের আলোচনা চলে গিয়েছে নেপথ্যে, সামনে এসেছে সমকালীন দুনিয়ার নানা দৃষ্টান্ত। সেই সব দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখক তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, পেশ করেছেন তাঁর মতামত। আলোচনার এই পদ্ধতি, সদর্থেই, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। পুঁজি-শাসিত পৃথিবীর বিপদটা কী ও কেন এবং কী ভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব— এই দুটি বিষয় সহজ ভাষায়, প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে, চার পাশের অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত নানা উদাহরণ সহযোগে মানুষকে বুঝিয়ে বলাই এই বইয়ের উদ্দেশ্য। লক্ষণীয়, বইটির উপ-শিরোনাম: ডিগ্রোথ কমিউনিজ়ম কী ভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। স্পষ্টতই, লেখক একটি ইস্তাহার রচনা করতে চেয়েছেন। ইকোলজির রক্ষাকবচ নির্মাণের জন্য পুঁজিতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধী সমাজদর্শনের ইস্তাহার। ‘ডিগ্রোথ কমিউনিজ়ম’-এর ইস্তাহার। বলা যেতে পারে, তাত্ত্বিক এখানে অ্যাক্টিভিস্ট বা কর্মনায়কের ভূমিকায়। যাঁরা অন্য পৃথিবী তৈরি করতে চান, তাঁদের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক, বস্তুত অনিবার্য। জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগ যৌথভাবে অনুশীলন করা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ১৮৪৮ সালের কমিউনিস্ট ইস্তাহারের রচয়িতারা সে-কথা জানতেন।
প্রশ্ন উঠবে, অ-বৃদ্ধির সঙ্গে জনকল্যাণের সরাসরি বিরোধ নেই কী? আর্থিক বৃদ্ধি যদি না ঘটে, উৎপাদন এবং আয় যদি না বাড়ে, তা হলে দারিদ্র দূর হবে কী করে, যাঁদের হাতে সুস্থ সচ্ছল জীবন যাপনের যথেষ্ট সংসাধন নেই তাঁরা কীভাবে নিজেদের অবস্থায় উন্নতি ঘটাবেন? সাইতোর স্পষ্ট উত্তর: পুঁজির নিয়মে গড়ে তোলা যে সমাজব্যবস্থায় আমরা এখন আছি, সেখানে অ-বৃদ্ধির যুক্তি একেবারেই অচল। কিন্তু সেই কারণেই তো অন্য ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জিডিপি যথেষ্ট বাড়লে তবে প্রয়োজন মেটানো যাবে এমন যুক্তি সেই ব্যবস্থায় আদৌ গ্রাহ্য হতে পারে না, সমস্ত মানুষের প্রয়োজন মেটানোর কাজটা সেখানে অবশ্যকর্তব্য বলেই সসম্মানে স্বীকৃত হবে। এবং, সেই কর্তব্য সম্পাদনের সামর্থ্য মানবসভ্যতা অনেক কাল আগেই অর্জন করেছে। এই বিষয়ে মোহনদাস গান্ধীজির উক্তি আজকের পৃথিবীতে দ্বিগুণ সত্য: আমাদের প্রয়োজন মেটানোর মতো সম্পদের কোনও অভাব এই পৃথিবীতে নেই। তিনি এর সঙ্গে যোগ করেছিলেন: আমাদের লোভ মেটানোর মতো সম্পদের অভাব আছে। মার্ক্স অবশ্য ‘মানুষের লোভ’ বলে কোনও সর্বজনীন সর্বকালীন ধারণায় বিশ্বাস করেন না, এ বিষয়ে কোনও নৈতিক বা ধর্মীয় অবস্থান নিতেও তিনি রাজি নন, তিনি লোভকে দেখেন বাস্তব সামাজিক ব্যবস্থার পরিণাম হিসেবে। পুঁজির শাসনে যে সমাজ চালিত হয়, সেখানে লোভ কোনও ব্যক্তিগত প্রবণতা নয়, লোভই অর্থনীতির চালিকা শক্তি, সামাজিক মানুষ সেই শক্তির বশীভূত। ওই শক্তি সক্রিয় থাকলে পুঁজি নিজেকে উত্তরোত্তর স্ফীত এবং সমৃদ্ধ করে চলতে পারে, নচেৎ নয়।
এই কারণেই সাইতো বলবেন: সমাজ ও অর্থনীতিকে পুঁজির শাসন থেকে মুক্ত করা আর সমস্ত মানুষের প্রয়োজন মেটানো— এই দুটি লক্ষ্য বিচ্ছিন্ন নয়, একই লক্ষ্যের দুটি দিক। বস্তুত, পুঁজির নিয়মের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রয়োজন মেটানোর কাজটা সম্পাদন করাই সেই লক্ষ্য পূরণের উপায়। তার মূল মন্ত্র একটাই: যা আমাদের প্রয়োজন তা মেটানোর কাজটা বাজারের হাতে তুলে দেওয়া চলবে না। বলা বাহুল্য, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা আমাদের প্রচলিত পথ থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন। তার কারণ, গত কয়েক দশকে আমরা নানা ধরনের প্রয়োজন মেটানোর অধিকার ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে বাজারের হাতে তুলে দিয়েছি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান তো বটেই,
আমাদের শিক্ষা, আমাদের চিকিৎসা, আমাদের বিনোদন, আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি সংসাধনই এখন বাজার থেকে কিনতে হয়। যার কেনার সামর্থ্য নেই, তার কার্যত বেঁচে থাকার কোনও হক নেই। যাকে ‘কমনস’ বা সমষ্টিগত সম্পদ বলা হত, তার প্রায় সবটাই এখন বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে। এর কোনওটাই আকস্মিক নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, সমস্ত ব্যাপারটাই পুঁজির শাসন উত্তরোত্তর ব্যাপক এবং গভীর হয়ে ওঠার পরিণাম। সবটার সঙ্গেই ওতপ্রোত হয়ে আছে আর্থিক বৃদ্ধির সাধনা। অ-বৃদ্ধির পথে হাঁটতে চাইলে সমাজ পরিচালনার তন্ত্রকে উল্টো দিকে নিয়ে যেতে হবে। এবং সেটাই হয়ে উঠবে প্রকৃতি-পরিবেশকে রক্ষার উপায়। স্পষ্টতই কাজটা বিপুল। সেই কারণেই তা অবিলম্বে এবং সর্বক্ষেত্রে শুরু করা দরকার, সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।
কীভাবে তা সম্ভব? এক মুহূর্তে এক ধাক্কায় এ-কাজ করা যাবে না, করার প্রশ্নও নেই। কোনও চমকপ্রদ, অভাবিত, ঐন্দ্রজালিক কর্মসূচি অনুসারে ‘যুগান্তকারী বিপ্লব’ ঘটিয়ে পুঁজিতন্ত্রকে ধ্বংস করার বিশ শতকীয় প্রকল্পে কোহেই সাইতোর আস্থা নেই। তাঁর মতে, পরিবর্তন ঘটানো দরকার সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ছোট, মাঝারি, বড়, যেখানে যেমন সম্ভব সেখানে তেমন ভাবে। বলা বাহুল্য, এই ‘সম্ভব’-এর কোনও পূর্বনির্দিষ্ট পরিধি বা মাত্রা নেই, বরং আমাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সেই পরিধি আর মাত্রাকে উত্তরোত্তর প্রসারিত করে চলা— অর্থাৎ, আজ যে পরিবর্তন সম্ভব নয়, কাল তাকে সম্ভব করে তোলা। কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে জীবনযাত্রার ধারায় সংস্কার ঘটিয়ে, প্লাস্টিকের বদলে কাপড়ের বা কাগজের থলি হাতে দোকানে গিয়ে কিংবা মাটির ভাঁড়ে চা খেয়ে অথবা বিদ্যুচালিত গাড়ি চড়ে বিপদ কাটানোর স্বপ্ন কেবল অলীক নয়, আত্মঘাতী। কারণ, ‘দূষণ কমান, পরিবেশ বাঁচান’ গোছের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে আমরা ভাবতেই পারি যে, নিজের নিজের মতো করে পরিবেশ-সচেতন হয়ে উঠলেই এবং নিজের ব্যক্তিগত পরিসরে সেই চেতনার নির্দেশ পালন করে ‘পরিবেশ-বান্ধব’ জীবন যাপন শুরু করলেই আমাদের কাজ সারা হয়ে যায়। যায় না, বরং ওই আত্মসন্তুষ্টি আমাদের অনেক বড় দায়িত্বের কথা ভুলিয়ে দিতে পারে, ভুলিয়ে রাখতে পারে।
সেটা রাজনৈতিক দায়িত্ব। অন্য সব ক্ষেত্রেই যেমন, তেমনই ‘ইকোলজি’ বা প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষেত্রেও, সত্যকারের সামাজিক পরিবর্তন ঘটানোর কাজটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কাজ। ক্ষমতার কাঠামো বদলানোর কাজ। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে বোঝাপড়ার কাজ। নিজস্ব চেতনায় ও জীবনযাত্রায় প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারলে সেই কাজে আমাদের তাগিদ বাড়বে, সমবেত ও সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ব, সুতরাং প্রতিস্পর্ধার জোরও বাড়বে, কিন্তু সেই তাগিদ, সম্ভাবনা এবং জোর আমাদের সংগ্রামের প্রকরণ। সেই প্রকরণ ব্যবহার করে রাজনীতির কাজটা রাজনীতির নিয়মেই করতে হবে, তার কোনও বিকল্প নেই। এককথায় বলে, সেটা রাষ্ট্রের উপর, কর্পোরেট শক্তির উপর সামাজিক চাপ তৈরি করার কাজ। তাদের প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে বাধ্য করার কাজ। এবং শেষ বিচারে রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতির সমস্ত ও সামগ্রিক পরিসরে ক্ষমতার কাঠামো পাল্টানোর কাজ।
এই কাজে সাফল্যের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে কোহেই সাইতো সামাজিক মানুষকে সমবেত ও সংগঠিত করার উপর জোর দিয়েছেন। দুনিয়ার নানা ভূখণ্ডে গত কয়েক দশকের বিভিন্ন জনজাগরণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি দাবি করেছেন যে, একটা দেশের জনতার মোটামুটি সাড়ে তিন শতাংশ যদি কোনও দাবিতে সমবেত এবং সংগঠিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রনীতির রূপকাররা সচল হতে বাধ্য। শতাংশের হিসেব নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু এই আশাবাদের মূল কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার অধীশ্বরদের উপর সংগঠিত ও সমবেত চাপ জারি রাখার এবং ক্রমাগত সেই চাপ বাড়িয়ে চলার কোনও বিকল্প থাকতে পারে না।
প্রকৃত অর্থে সমবেত ও সংগঠিত হওয়ার আবশ্যিক শর্ত হল শিক্ষিত ও সচেতন হওয়া। আমাদের শিক্ষা এবং চেতনাকে পুঁজিতন্ত্র বহু দূর অবধি গ্রাস করে নিয়েছে। আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি যে, পুঁজির শাসিত বাজারে রেষারেষি করে টিকে থাকা ছাড়া বাঁচবার আর কোনও রাস্তা নেই। সর্বাগ্রে এই মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র থেকে মুক্তি জরুরি। বিশ্বাস করতে শেখা জরুরি যে, অন্য রকম ভাবেও বাঁচা সম্ভব। কেবল সম্ভব নয়, সেটাই এই গ্রহের এবং তার অধিবাসীদের বাঁচবার একমাত্র উপায়। আত্মরক্ষার এই শিক্ষাসত্রে কোহেই সাইতোর মতো তত্ত্ব-কর্মীরা এক বড় সহায়। q
*কার্ল মার্ক্স’স ইকোসোশালিজ়ম: ক্যাপিটাল, নেচার অ্যান্ড দি আনফিনিশড ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকনমি, কোহেই সাইতো। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১৭
*মার্ক্স ইন দি অ্যানথ্রপসিন: টুওয়ার্ডস দি আইডিয়া অব ডিগ্রোথ কমিউনিজ়ম, কোহেই সাইতো। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২২
*স্লো ডাউন, কোহেই সাইতো। ওয়াইডেনফেল্ড অ্যান্ড নিকলসন, ২০২৪