বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

অন্ধগলিতে পৌঁছেছে নয়া উদারবাদ আলগা হচ্ছে মুঠো

অন্ধগলিতে পৌঁছেছে নয়া উদারবাদ আলগা হচ্ছে মুঠো

প্রভাত পট্টনায়েক

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২২— ইউক্রেন যুদ্ধে একদিকে উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছে অ্যাংলো-স্যাক্সন দেশগুলো। আর অন্যদিকে অন্ধের মতো তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে ভীরু ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু পশ্চিমী শক্তি যে লক্ষ্য সামনে রেখে এই যুদ্ধ শুরু করেছিল তার পরিণতি হতে চলেছে সর্বনাশা। ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন পশ্চিমী শক্তিগুলি বিশ্বাস করেছিল, তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করলে রাশিয়ার অর্থনীতি তছনছ হয়ে যাবে। ফলে রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। রুবল পরিণত হবে রাবল বা ধ্বংসস্তূপে। ফলে নেটো যুদ্ধে সরাসরি না জড়ালেও রাশিয়া পরাজিত হবে। গোড়ার দিকে মনে হয়েছিল পশ্চিনী শক্তিগুলির অনুমানই বোধহয় সঠিক। কারণ তখন রুবলের দামে ধ্বস নেমেছিল এবং জ্বালানি তেল বিক্রি থেকে রাশিয়ার আয়ও দারুণভাবে কমে গিয়েছিল। কিন্তু সময় গড়াতে দেখা গেল রুশ অর্থনীতি সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে । শেষ পর্যন্ত এবছরের ২৬ জুন ডলারের তুলনায় রুবলের দাম এত বেশি বাড়ল যে গত সাত বছরে তা হয়নি। আবার পরিমাণে জ্বালানি তেলের রপ্তানি কমলেও বিশ্ববাজারে দামবৃদ্ধির কারণে তেল বিক্রির আয় থেকে রাশিয়ার আর্থিক ভাণ্ডার ফুলেফেঁপে উঠল। অন্যদিকে, পশ্চিমী দেশগুলির অর্থনীতিতে এখন মুদ্রাস্ফীতির হার এতটাই বেশি যে যা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। এবং চড়া মুদ্রাস্ফীতি সমাল দিতে গিয়ে এই সব দেশের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার জনগণের মধ্যে ভ্লাদিমির পুতিনের সমর্থন বেশ জোরালো। অন্যদিকে জো বাইডেন ও বরিস জনসন— দু’ জনেই দেশের মধ্যে জনতার সমর্থন হারানোর ভয়ে শঙ্কিত। ৭ জুলাই বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন।
এমনকী আন্তর্জাতিকভাবেও, আমেরিকার কঠোর প্রয়াস সত্ত্বেও, রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থন জাগিয়ে তোলার কাজে তেমন কোনও ফল হচ্ছে না। সম্প্রতি ইউক্রেনের সরকারকে সমর্থন করার জন্য আফ্রিকার ৫৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের একটি বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। সেই বৈঠকে হাজির হয়েছিলেন মাত্র চার জন রাষ্ট্রপ্রধান। আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের মনোভাব হল, এই যুদ্ধে কোনও পক্ষ না নেওয়া। বরং তারা চাইছে এই সংঘাতের নিরসন হোক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এবং শুরু থেকেই সেই পথের বিরোধিতা করে আসছে আমেরিকা ও ব্রিটেন। আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তি চায় চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বংলাদেশের মতো এশিয়ার প্রধান শক্তিগুলিও। এমনকী স্বয়ং পোপও এব্যাপারে সরাসরি রাশিয়ার সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছেন। বরং তিনি বলেছেন, এই সমস্যার শিকড় অনেক জটিল। এভাবে ঘুরিয়ে কথা বলে তিনি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন ইউক্রেনে মার্কিন মদতে অভ্যুত্থানের বিষয়টি যেখানে ২০১৪ সালে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি যেভাবে নিজেদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা (অটোনমি)প্রয়োগ করছে, সেটাই হল সাম্প্রতিক পরিস্থিতির সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য। এই পরিস্থিতি আবার মনে করিয়ে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কার নির্জোট আন্দোলনের চমৎকার দিনগুলির কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এবং নয়া উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থা জয়ী হওয়ার পর, আগেকার Diregisme (যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এর ইতিবাচক ভূমিকা স্বীকৃত) পর্বের তুলনায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি এখন যেভাবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিচয় দিচ্ছে তা অবশ্যই কিছুটা অপ্রত্যাশিত। এটা আরও লক্ষ্যণীয় একারণে যে এসব দেশের অনেকগুলিই এখন চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে যেখানে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে আইএমএফ এর জরুরি হস্তক্ষেপ দরকার। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া কোনও ভাবেই আইএমএফ এসব দেশে সঙ্কটত্রাণে এগিয়ে আসতে পারবে না। ঘটনা হল এসব সত্ত্বেও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যেভাবে পুনর্জীবিত হচ্ছে তা ইঙ্গিত করছে যে আজকের বিশ্বে আরও গভীর সব পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন ঘটে গেছে তা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালে ফুলেফেঁপে ওঠার পর হঠাৎ করে আবাসন ক্ষেত্র যে ধ্বসে পড়েছিল, তার পর থেকে নয়া উদারবাদী সঙ্কট একেবারে সর্বশেষ বিন্দুতে পৌঁছেছে। অতিমারির ঠিক আগের দশকে বিশ্ব অর্থনীতির যে বৃদ্ধি হয়েছিল, তা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দশকগুলির তুলনায় সবচেয়ে কম। মন্দার এই যে দীর্ঘকালীন পর্ব, এখন যা অতিমারির কারণে আরও ঘনীভূত হয়েছে, তার পিছনে রয়েছে নয়া উদারবাদী জমানার দুটি বৈশিষ্ট্য— একটা হল আয় ও সম্পদের মালিকানায় তীব্র বৈষম্য বৃদ্ধি এবং তা ঘটেছে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অর্থনীতিতে এবং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব পরিসরে। এরই পরিণতিতে বিশ্ব অর্থনীতিতে তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত উৎপাদনের প্রবণতা। এর কারণ হল বিশ্বের ধনীদের ভোগের প্রবণতা বিশ্বের গরিবদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কম।
দ্বিতীয় কারণ হল, চাহিদা বাড়ানোর উপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলির অক্ষমতা। চাহিদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেওয়া আর্থিক নীতিসমূহ তখনই সফল হতে পারে যদি রাষ্ট্রের খরচ করার ক্ষমতা বাড়ে। এই ক্ষমতাবৃদ্ধির উৎস দুটি। যদি ধনীদের ওপর বেশি হারে কর বসানো যায় অথবা যদি রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানো যায়। একমাত্র সেক্ষেত্রেই চাহিদায় নীট বৃদ্ধি ঘটে। রাষ্ট্রের খরচ বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের ওপর বাড়তি কর বসানোর মানে হল স্রেফ এক ধরনের চাহিদার বদলে আরেক ধরনের চাহিদা সৃষ্টি। রাষ্ট্রের বাড়তি খরচ করার লক্ষ্যে অর্থ জোগাড়ের জন্য ধনীদের ওপর বেশি হারে কর বসানো বা রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়ে যাওয়া– এই দুটিই বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজির পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ফলে যে কোনও জাতি রাষ্ট্র, যারা বিশ্বায়িত পুঁজির অবাধ চলাচলের ঘূর্ণিপাকে পড়ে রয়েছে, তাদের পক্ষে ওই দুই পদক্ষেপ নেওয়া অসম্ভব।
চাহিদাকে চাঙ্গা করার জন্য আর্থিক নীতিসমূহ, যাতে সম্মতি দিতে পারে বিশ্বায়িত লগ্নি পুঁজি, সেগুলি এক কথায় ভোঁতা অস্ত্র হিসাবেই পরিচিত। তাছাড়া, গোটা পৃথিবীজুড়ে বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতি বর্তমানে কোনও সম্প্রসারণশীল আর্থিক নীতি গ্রহণের সম্ভাবনাকেও খারিজ করে দিয়েছে। বরং, এখনকার প্রবণতা মন্দারই দিকে যা আবার তৈরি হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতিকে রোধ করার উপযোগী আর্থিক নীতি কার্যকর করতে গিয়ে।
এখন নয়া উদারবাদ এমন এক গলিতে গিয়ে পৌঁছেছে যেখান থেকে তার পিছু ফেরার রাস্তা বন্ধ। এর ফলে ভবিষ্যতে ঠিক কী ঘটবে তা স্পষ্ট নয়। ফলে আগামী দিনে ঠিক কী ঘটতে চলেছে তা নিয়ে রয়েছে এক বিপুল অনিশ্চয়তা এবং তার জেরে বৃহৎ শক্তিগুলির সব কিছু আগের মতো চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতায় চিড় ধরবে। এসবের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল তাদের শক্ত মুঠো আলগা হবে, বিশেষত যখন চীন, এবং কিছুটা কম পরিমাণে হলে রাশিয়াও, পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছে।
চরম আগ্রাসী হয়ে উঠে এই আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে — একথা বিশ্বাস করাটা নিছকই এক স্বপ্ন। অথচ বাইডেন এবং জনসন সেই স্বপ্নই দেখছেন। এই সঙ্কটকালে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সন্ধানে বৃথা চেষ্টা করা অর্থহীন কারণ পশ্চিমী শক্তিগুলির মুঠো থেকে সেই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা আলগা হয়ে ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বরং তাদের উচিত নতুন বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া, এমন একটা বিশ্বব্যবস্থাকে মেনে নেওয়া যেখানে কারোর একার আধিপত্য চলবে না। তবে দুর্ভাগ্য হল ক্ষয়িষ্ণু শক্তিগুলি মোটেই এই সত্যটা বুঝতে পারে না। ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিকে মুক্তি দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। অথচ বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। নয়া উদারবাদ বিরোধী বিশ্ব নিশ্চিতভাবে সেই পথই বেছে নেবে যে পথ বেছে নিয়েছিল উপনিবেশ–পরবর্তী বিশ্ব।
সৌজন্য: দ্য টেলিগ্রাফ, ১৩ জুলাই, ২০২২।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.