বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

রাজনীতির সীমান্তে

রাজনীতির সীমান্তে

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

রেস্তোরাঁর নাম ‘তড়কা।’ টেক্সাসের রাজধানী অস্টিনে এমন নামের একটা খাবার দোকান! দিনের শেষ বাস ধাওয়া করার গতিতে ক’জন বাঙালি ছুটল সে দিকে। অচিরে টেবিলে এল মালাই পনির, ডাল মাখানি, মাটন কোর্মা উইথ রাইস। চেহারাও দিব্যি। কিন্তু মুখে দিয়েই সকলের কেমন ভ্যাবাচাকা ভাব। পনির ফ্রেশ, মালাইটাও মন্দ নয়, তবু দুটো মিলে মালাই পনির তো হয়ে ওঠেনি! এ যেন ভাংড়ার গানের সঙ্গে ট্যাঙ্গো নাচ! চারদিকে চেয়ে বোঝা গেল, দোকানটা ভারতীয় খানার বটে, তবে চালাচ্ছেন মেক্সিকোর লোকেরা। তেজপাতা-গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে, বাটা মশলা কষে স্বাদ-গন্ধ বের করার দিকে তেমন ঘেঁষেননি। রান্না বেশ হালকা, সুপাচ্য বটে, তবে কোনও সর্দারজি মুখে দিলে ‘ওত্তেরি ...’ বলে হাঁক দিতে পারে। স্থানীয় সঙ্গী জানালেন, এই দামে খাবারের জন্য পাঞ্জাব থেকে কুক আনা পোষাবে না। মেক্সিকানরাই আমেরিকায় অল্প টাকায় বেশি পরিশ্রমের কাজগুলো করেন — খাবারের দোকান থেকে বাড়ি-রাস্তা তৈরি, খেত-খামার, সর্বত্র। অস্টিনে যে পাড়ায় আমরা অতিথি, তার বাড়িগুলো তাঁরাই ক্রিসমাসে আলো দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন।
তাঁদের নিজেদের জীবনে অবশ্য অনিশ্চয়তার অন্ধকার। মেক্সিকো এবং লাতিন আমেরিকার নানা দেশ থেকে একটু ভাল জীবনের আশায় যাঁরা আমেরিকায় পালিয়ে এসেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ অবৈধ। এই মানুষগুলোকে বার করে দেওয়ার হুমকি ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী চাল। ২০ জানুয়ারি, ২০২৫ দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করার পর ট্রাম্প শেষমেশ কতটা কঠোর হবেন অবৈধ অভ্যাগতদের প্রতি, তা নিয়ে জল্পনা চলছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হয়ে মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তোলার শাসানি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এ বার নাকি অবৈধদের জেলে পোরার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বড় বড় শহরে বন্দিশিবির (ডিটেনশন সেন্টার) তৈরির জন্য জায়গা বাছা চলছে। পোড়-খাওয়া লোকেরা অবশ্য বলছে, আর ধুস, ও সব ফাঁকা আওয়াজ। মেক্সিকান, কিউবানদের তাড়ালে আমেরিকা সস্তার মজুর পাবে কোথায়? ট্রাম্পের সঙ্গে যাঁদের গলাগলি, সেই শিল্পপতিরা কাজ করাবেন কাদের দিয়ে?
ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের দুই প্রধান উপদেষ্টা, শিল্পপতি ইলন মাস্ক এবং উদ্যোগপতি বিবেক রামস্বামী বলেছেন, প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মীদের গ্রিন কার্ড দেওয়া চলছে, চলবে। তাতে কট্টর ট্রাম্পপন্থীরা চটেছেন। এমন তো কথা ছিল না? দক্ষই হোক আর অদক্ষ, বাইরের লোক এ দেশে কাজ করবে কেন? অভ্যাগত শ্রমিককে ঠাঁই দেওয়া হবে কি না, এ প্রশ্নটা আমেরিকায় নির্বাচনী রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে উঠে এসেছে বটে। কিন্তু সারা বিশ্বেই অতি-দক্ষিণপন্থার অভ্যুত্থানের পিছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে ভিন দেশ, ভিন অঞ্চল থেকে আগত শ্রমিকদের প্রতি ভীতি আর বিদ্বেষকে। প্রকৃত সমস্যাটা যে অনেক বড়, অনেক জটিল, সে আর বলতে? সব দেশেই মানুষ দেখছেন যে তাঁদের কাজ চলে যাচ্ছে, ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে আয় বাস্তবিক আয় নামছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ধাক্কা খাচ্ছে কৃষি, অথচ জনকল্যাণ থেকে রাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। তাঁরা টের পাচ্ছেন যে শিল্প-বাণিজ্যে বিশ্বায়ন আর ডিজিট্যাল প্রযুক্তির ফলে নিয়োগের নকশা দ্রুত বদলাচ্ছে। তার উপর আসছে কৃত্রিম মেধার যুগ। কাজের জগৎ পরিচিত সব ছকের বাইরে চলে যেতে বসেছে। এই অস্থির অবস্থায় কাজ বাঁচানোর, নিজে বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা প্রতিফলিত হচ্ছে ভোটে।
উদারবাদী (লিবারাল) নেতারা মুখে সাম্য আর মানবাধিকারের জয়গান গাইলেও, তাঁদের সময়েই অসাম্য বেড়েছে। অনেক কর্পোরেট সংস্থা শক্তি, সম্পদ, রাজনৈতিক প্রভাবের নিরিখে বহু দেশের সরকারকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এদের বিপরীতে অতি-দক্ষিণপন্থী নেতারা ভিন ধর্ম, ভিন জাতের প্রতি কেবলই বিষোদ্গার করছেন। জাতীয়তাবাদ নিয়ে আস্ফালন করছেন। অনেকে ভাবছেন, এরা হয়তো বাইরের বিপদ থেকে দেশের মানুষকে আড়াল করবে। দেশের কাজ দেশে থাকবে, দেশের লোকজনই সে কাজ করবে।
সত্যিই কি বাইরে থেকে কর্মী, মজুর আসা বন্ধ হলে দেশের ভিতর কাজ বাড়বে? ক্যালিফোর্নিয়া হোক বা কেরালা, দেখা গিয়েছে যে বাইরের মজুরেরা সেই কাজগুলোই করেন, যেগুলো ভিতরের লোকেরা করেন না। তাই অভ্যাগত মজুরদের তাড়ালেও নাগরিকের কাজ বাড়ে না, বরং উৎপাদন মার খায়। উদাহরণ, আমেরিকার চাষবাস। আমেরিকায় খেতমজুরদের দশজনে সাতজনই ‘অতিথি শ্রমিক’, আর তাদের প্রায় অর্ধেকই অবৈধ। অনুপ্রবেশ নিয়ে কড়াকড়ি করায় তাদের সংখ্যা দ্রুত কমেছে। তাতে সবজি আর ফল, মজুর না হলে যে সব চাষ হয় না, সেগুলির উৎপাদনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে আমেরিকায়। ভুট্টা, সয়াবিন, গম, কাপাস আর পশুখাদ্য, এগুলি এখন আমেরিকার কৃষি উৎপাদনের ৯০ শতাংশ। কারণ এই পাঁচটির চাষ যন্ত্রনির্ভর, মজুর লাগে নামমাত্র। চাষ বদলে গেল, কাজ বাড়ল না। আমেরিকাকে সবজি, ফল জোগাচ্ছে মেক্সিকো।
এই নকশা ভারতের ভিতরে, শ্রমিকদের আন্তঃরাজ্য পরিযানেও। পরিযায়ী শ্রমের উপর যে রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদ, তাতে দেখা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু শ্রমিক যেমন অন্যান্য রাজ্যে কাজ করতে যায়, তেমনই অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত শ্রমিকের সংখ্যাতেও পশ্চিমবঙ্গ উপরের দিকে। বহু প্রজন্ম ধরে ‘দেহাতি’ মজুরদের দল বাংলার ইটভাটায় চুল্লি ধরাচ্ছেন, বড়বাজারে মোট বয়ে রাত কাটাচ্ছেন ফুটপাথে, মালদায় আমবাগান ইজারা নিয়ে রাতদিন পাহারা দিচ্ছেন। খেত থেকে খাদান, যে কাজগুলি ভিনরাজ্যের মানুষরা করেন, বাঙালি শ্রমিক তা করবে না। আবার, তামিলনাড়ুর কাপড়কলে দিনে আট থেকে বারো ঘণ্টার শ্রমে আজ আর পাওয়া যায় না তামিল মেয়েদের। সে কাজ করে বাংলা আর ওড়িশার মেয়েরা। শ্রমিকের চলাচলে নিষেধ আরোপ করলে বাংলার ইটভাটা, তামিলনাড়ুর কাপড়কল বন্ধ হবে।
এই মৌলিক সত্যগুলোকে ঢেকে দিতে চান নেতারা। বিরোধীরা চেঁচায়, হাতের কাছে কাজ নেই বলে শ্রমিকদের বাইরে যেতে হচ্ছে। শাসক কখনও বড়াই করে, এত কাজ তৈরি করবে যে কারওকে বাইরে যেতে হবে না। কখনও দাবি করে, বাইরে থেকে শ্রমিক আসতে দেবে না। এই শোরগোলের মধ্যে চাপা পড়ে যায় জরুরি প্রশ্নগুলো — কোন কাজ করতে লোকে বাইরে যাচ্ছে? কোন কাজ করতে আসছে? তাদের আটকালে কাদের লাভ? কতটুকু লাভ?
উদ্বাস্তু শরণার্থী দেশে প্রবেশ করলে স্থানীয়দের মজুরি কমে কি না, সে বিষয়ে নানা দেশে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী সমীক্ষা হয়েছে। সেগুলি খতিয়ে দেখে অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার ডুফলো লিখছেন, বাইরের মজুর ঢুকলে স্থানীয়দের মজুরি কমে না, কর্মহীনতা বাড়ে না। বরং নানা কারণে স্থানীয় নাগরিকদের রোজগার বাড়তে দেখা যায়। যেমন, উচ্চশিক্ষিত মহিলারা যদি সন্তানের পরিচর্যার জন্য ভিন দেশ থেকে আসা (বা গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা) পরিচারিকা রাখতে পারেন, তা হলে তাঁরা বাইরে কাজ করতে পারেন। এমন রোজগেরে গিন্নি যত বাড়বে, তত পরিচারিকা, আয়া, রাঁধুনির চাহিদা বাড়বে। নতুন নতুন কাজ তৈরি হবে।
পাশাপাশি, আমেরিকা দেখিয়েছে যে নতুন উদ্যোগ শুরু করার তাগিদ অভিবাসীদের মধ্যেই বেশি। আমেরিকার সব চাইতে সফল পাঁচশোটি কোম্পানির ৪৩ শতাংশের প্রতিষ্ঠাতা কোনও অভিবাসী, বা তাদের সন্তান। ফোর্ড গাড়ির প্রতিষ্ঠাতা হেনরি ফোর্ডের পরিবার এসেছিল আয়ারল্যান্ড থেকে, ‘অ্যাপল’-এর কর্ণধান স্টিভ জোবসের জন্মদাতা পিতা ছিলেন সিরিয়ার লোক, অ্যামাজ়ন-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজ়োস-এর পালক পিতা মাইক বেজ়োস কিউবা থেকে এসেছিলেন। ‘টেসলা’ গাড়ি, ‘স্পেস এক্স’-এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক আদতে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ। অগণিত ছোট ছোট উদ্যোগও রয়েছে — মেক্সিকান-স্টাইল মালাই পনিরও কি একটা উদ্ভাবন নয়?
আমেরিকায় এসে অভিবাসীরা কত কাজ তৈরি করেছেন, কত কর দিয়েছেন, তার হিসেব কষে বারবার দেখা গিয়েছে যে লাভের পাল্লাই ভারী। ভারতে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকরা সংখ্যার হিসেব করে, কাজের মূল্যায়ন করে না। হয়তো তাতে প্রশ্ন উঠতে পারে, শ্রমিক যে এত দিচ্ছে, কী পাচ্ছে? তখন সব দল, সব রাজ্যকে মুখ লুকোতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসেব, ভারতের জিডিপির অন্তত দশ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকদের অবদান। তবু দেশের মধ্যেই পরবাসী হয়ে দিন কাটে পরিযায়ীদের। দেশে, বা রাজ্যে, কর্মহীনতা দূর করতে, যথাযথ পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে, সামাজিক নিরাপত্তা দিতে সরকার কী করছে, সেই কঠিন প্রশ্ন এড়ানোর সহজ উপায় অভ্যাগত শ্রমিকের প্রতি তর্জন-গর্জন। এমন বিদ্বেষ উস্কানির ফল কী হয়, পশ্চিমবঙ্গের বহু পরিযায়ী শ্রমিক প্রাণ দিয়ে তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন দিচ্ছেন লাতিন আমেরিকার নানা দেশের বহু মানুষ, জেলবন্দি দিন কাটিয়ে। ইউরোপের এক একটা দেশে অভিবাসী শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম, অসহনীয় জীবনযাত্রা কতশত কাহিনির জন্ম দিচ্ছে। মনে করাচ্ছে, আমাদের রাজনীতির কেন্দ্রে যুক্তি-তথ্য নেই। আছে শুধু দূরাগত স্বজনের প্রতি ভিত্তিহীন ভয়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.