বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

প্রকৃতি-পুঁজি সম্পর্ক প্রসঙ্গে

প্রকৃতি-পুঁজি সম্পর্ক প্রসঙ্গে

পুলক গোস্বামী

photo

১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন এবং উন্নত দেশের বড় শিল্পগুলিকে অনুন্নত দেশে আউটসোর্স করা, পুঁজিবাদকে নতুন অক্সিজেন যোগালো। পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার মানুষকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে আসা হল। শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে ছত্রভঙ্গ করা হল। তৃতীয় বিশ্বসহ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে শ্রমিক শ্রেণী দিশেহারা হয়ে গেল। বিশ্বায়ন পুঁজির গতিবৃদ্ধি ও শোষণের তীব্রতা বাড়ল।
কেন এই অবস্থার পরিবর্তন হল
পুঁজিবাদী সংকট বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনলে শ্রমিক শ্রেণী সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ায় ক্ষমতা দখল করে এবং রাশিয়ার সমস্ত উপনিবেশগুলিকে মুক্ত করে একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় নিয়ে আসে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে পুঁজিবাদী সংকট আরও তীব্র হয় এই উপনিবেশ হাত ছাড়া হওয়ায়। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ভেঙে দেওয়ায় হয়।
আন্তর্জাতিকের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস্ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পুঁজির আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরি হল। ফোর্ডিস্ট ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বিকল্প এক ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হল পুঁজিবাদ– মূল লক্ষ্য হল প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা ও শ্রমিকের মজুরি বাড়িয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়নগুলির একটি আপোষ গড়ে ওঠে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ভূমি সংস্কার করা হয় কৃষিতে প্রযুক্তি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য। রাসায়নিক সার, উন্নত বীজ, কীটনাশকের প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষিতে উৎপাদন বাড়িয়ে তোলা হয়। এই উৎপাদন বৃদ্ধি কৃষি-বাজারের সংকট ডেকে এনেছে এবং একই সঙ্গে প্রকৃতির বিপাকীয় ফাটলকে ত্বরান্বিত করেছে।
১৯৬০ সাল অবধি পুঁজি কিছুটা স্বর্ণময় যুগ ফিরে পেল। কিন্তু অচিরেই জার্মানি ও জাপান উঠে আসায় পুঁজির উদ্বৃত্ত হওয়ার সমস্যা দেখা দিল। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে এল কেনেথ অ্যারোর তত্ব। তাঁর মতে, জমি,পুঁজি, শ্রম ও সংগঠনের মত জ্ঞানকেও এবার থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাথমিক যোগান হিসেবে ভাবতে হবে। এতে মেশিনের খরচ এবং শ্রমিকের মজুরি দুটোকেই একই সঙ্গে কমানো যাবে যেখান থেকে লাভের হারে পতনকে আটকানো যাবে। আগে তা সম্ভব ছিল না কারণ সেসময় বৈদ্যুতিন ব্যবস্থার সাহায্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তথ্য প্রেরণ করার মত যোগ্য কোনও ব্যবস্থা ছিল না।
জ্ঞানের দুটি অংশ – একটি এক্সপ্লিসিট (Explicit) যা লিখিত আকারে বা ড্রইং এর আকারে প্রকাশ করা যায় । অন্যটি ট্যাসিট (Tacit) যেটি কর্মক্ষেত্রে অনেকগুলি মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত হয়। ১৯৬৭ সালে ফ্যাক্স মেশিন আবিষ্কার হওয়ায় এক্সপ্লিসিট জ্ঞানকে স্থানান্তরিত করতে পারলেও, ট্যাসিট জ্ঞানকে স্থানান্তরিত করার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, যতদিন না ইলেকট্রনিকস শিল্পের বিকাশ এবং কমিউনিকেশন শিল্পের বিকাশের ভিতর দিয়ে মাল্টিমিডিয়ার উদ্ভব ঘটেছে। আশির দশকের পর থেকে ভিডিওর ভিতর দিয়ে ট্যাসিট জ্ঞানকেও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল।
১৯৭০ দশকে স্ট্যাগফ্লেশন থেকে মুক্তি পেতে ডলারকে সোনার থেকে মুক্ত করে বিশ্বগ্রাহ্য অর্থে পরিণত করা হল। এতে ক্রেডিটের গতি বেড়ে গেল। ডলার নিয়ন্ত্রিত হল আমেরিকা রাষ্ট্র এবং তার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। আমেরিকার পুঁজির সংকট সারা পৃথিবীর ঘাড়ে চেপে বসল।
এদিকে সোভিয়েত ব্যবস্থা জাতীয় ক্ষেত্রে আবদ্ধ হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে ও সংকট থেকে মুক্ত হতে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শুরু হয় অর্থনীতির গ্লোবালাইজেশন। উন্নত দেশের শিল্পগুলিকে টুকরো করে অনুন্নত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হল তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে। জ্ঞান তা অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত বা ম্যানেজমেন্টের জ্ঞান যাই হোক না কেন, তথ্যে পরিণত করে ব্যক্তি মালিকানায় নিয়ে আসা হল। বড় শিল্পকে টুকরো করে ভার্টিকাল ডিভিশন অফ লেবার করা হল। এতে আন্তঃশিল্প কেনাকাটার পরিধি বেড়ে গেল। অর্থের প্রবাহ বাড়ল। কেনেথ অ্যারো বাস্তবে রূপায়িত হল। স্থির পুঁজি ও অস্থির পুঁজি উভয়ই কমে গিয়ে লাভের হার গেল বেড়ে। প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম তৈরি করে আমাজনের মতো কোম্পানিগুলি ইধার কা মাল উধার করে, উৎপাদনে কোনও অংশগ্রহণ না করেও লভ্যাংশের বড় অংশ তারা টেনে নিতে থাকলো। অনুন্নত দেশে যেখানে শ্রমিক ইউনিয়নের বালাই নেই, ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করানো যায়, সেই সমস্ত দেশে শিল্পের কাজগুলিকে আউটসোর্স করা হল। আর শিল্পের করণিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের কাজগুলি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের আওতায় এল।
পুঁজিবাদ যে হারে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, সেই হারে শ্রমিকের ভোগ বাড়াতে পারে না। তাহলে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হবে না। সেই কারণে মধ্যবিত্তের ক্ষুদ্র একটি অংশের ভোগ বাড়িয়ে তোলার জন্য ভোগবাদী একটি সংস্কৃতি তৈরি করতে ইন্ডিভিজুয়াল ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজেশন থিওরির অবতারণা হল। যার মূল কথা হল ব্যক্তি তার গুণকে সর্বাধিক বিকশিত করে বিক্রয় করবে এবং অর্থের বিনিময়ে জীবন উপভোগ করবে। কিন্তু এভাবে ভোগ বাড়াতে গিয়ে পুঁজিবাদ নতুন এক সংকটে নিমজ্জিত হল।
কী সেই সংকট?
যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে ততো দিন প্রকৃতির সঙ্গে তাকে মিথস্ক্রিয়ায় থাকতে হবে। মানুষ প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি উৎপাদন করতে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। শ্রমের বিষয়ে উৎপাদনের হাতিয়ারগুলি প্রকৃতির থেকে পাওয়া এবং উৎপাদনে সরাসরি ভূমিকা গ্রহণ করে প্রকৃতি। শ্রম হল জনক এবং প্রকৃতি জননী। মানুষের দেহটি হল ক্ষুদ্র সত্ত্বা, প্রকৃতি তার বৃহৎ সত্ত্বা। যদি কোনও ভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় বিপাকীয় ফাটল। জৈব ও অজৈব বস্তুর নানা বিপাক ক্রিয়ার ফলে গড়ে উঠেছে এই নীল গ্রহ। মানুষের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। তাই এর সাম্যতা বজায় না থাকলে সভ্যতা ধ্বংস হবে। পুঁজিবাদের পূর্ববর্তী সমাজগুলিতে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে একটি সাম্যতা থাকায় বিপাকীয় ফাটল ঘটেনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শহর ও গ্রামের উদ্ভব হওয়ায় গ্রামের উৎপাদিত ফসল চলে আসে শহরে। শহরে মাটির উর্বরতা চলে যায়। শহরে তৈরি হয় বর্জ্যের পাহাড়। তৈরি করে নানা রোগ।
শিল্পগুলি আমেরিকা ও ইউরোপকেন্দ্রিক ছিল, তেমনি বাজারও ছিল ওই সকল দেশে। তাই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ত কেবল সেই সব দেশের বাতাসে। কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের ফলে শিল্প অনুন্নত দেশে চালান হল এবং ভোগ উন্নত দেশে হওয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চাদরে আজ ঢেকে গেছে সারা পৃথিবীর বাতাস। সেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে কিছুটা পরিমাণে শোষণ করে কম করতে পারত অনুন্নত দেশের সমুদ্রাঞ্চল। যেহেতু গ্লোবালাইজেশনের আগে অনুন্নত দেশের আকাশ এভাবে দূষিত বাতাসে ঢাকা পড়েনি, তাই সমুদ্র প্রবাহিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং সমুদ্র শোষিত তাপ অনুন্নত অঞ্চলে বিকিরিত হয়ে মহাকাশে চলে যেত। এছাড়াও জল দূষিত হয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে অপূরণীয় বিপাকীয় ফাটল দেখা যাচ্ছে। বহু জীব প্রজাতি অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োগে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। বিষাক্ত হচ্ছে খাল-বিল- নদী-নালার জল। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বহু অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য। বিপাকীয় ফাটল আজ এমন চেহারা নিয়েছে যে একে রুখতে না পারলে সভ্যতা ধ্বংস হবে অচিরেই। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০৩০ এর মধ্যে একটা সীমায় বাঁধতে না পারলে নীল গ্রহকে আর বাঁচানো যাবে না। মানবজাতির কাছে আজ এই প্রশ্ন উঠে গেছে যে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে চরিতার্থ করতে সভ্যতা ধ্বংস করব, নাকি আমার বৃহত্তর সত্ত্বাকে পুনরুৎপাদন করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখব, প্রকৃতি মানুষের বিপাকীয় সম্পর্কের মধ্যে সাম্যতা ফিরিয়ে আনবো। শ্রমিক শ্রেণীকে ছাঁটাই করে শ্রমিকের মজুরিকে ন্যূনতম জায়গায় নামিয়ে এনে শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্বের যে মীমাংসা জোর করে ঘটাতে চায় পুঁজি, তারই ফলেই পুঁজি ও প্রকৃতির দ্বন্দ্ব এমন স্থানে এসে পৌঁছেছে যে পৃথিবীর অস্তিত্বই আজ সংকটাপন্ন।
উৎপাদনের দুটি উপাদান শ্রম ও প্রকৃতির মধ্যে সচেতন সম্পর্ক গড়ে তুলে পৃথিবীর বিপাকীয় ফাটল দূর করতে হবে। সেই কারণেই পুঁজির যে বিপাকীয় সম্পর্ক অর্থাৎ যে সম্পর্কে পুঁজি পুঁজির জন্ম দেয় ও তাকে ধারণ করে রাখে যে সমস্ত সংগঠন তাদের অবলুপ্তি ছাড়া শ্রম ও প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্ক টিকবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.