বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
ঠিক যেন লক্ষ্মীকান্তপুর বা ক্যানিং লোকাল। ভোর পাঁচটার দুবাইয়ের মেট্রো। ঠাসা ভিড়। সেই মেট্রো ধরেই ওরা ছড়িয়ে পড়ে শহরতলির বহুতলগুলোয়। বাড়ি-প্রতি বরাদ্দ দু-তিন ঘণ্টা। আট-দশ বাড়ি কাজ করে উপার্জন ভারতীয় মুদ্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা, বা তারও বেশি। দেশে থাকতে যা ওদের কাছে স্বপ্নাতীত ছিল।
গ্রীষ্মে মুখে কাপড় জড়িয়ে, মরুভূমির গরম হাওয়া অগ্রাহ্য করে, ই-স্কুটার নিয়ে ওরা ছুটে বেড়ায় এ বাড়ি থেকে সে বাড়ি। এরা বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইনস অথবা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মহিলা পরিযায়ী শ্রমিক। বয়স আঠারো থেকে পঞ্চাশ বছর। পরিবার পরিজন ছেড়ে কেউ রয়েছে দু’বছর তো কারও এক যুগ পেরিয়ে গেছে।
নিম্নবিত্ত পরিবারে পুরুষ সদস্যই বিদেশ গিয়ে উপার্জন করবে, সে ধারণা সরিয়ে বহু মহিলা স্বাধীন শ্রমিক হিসাবে উন্নত দেশগুলোয় পাড়ি দিচ্ছেন। প্রধানত গৃহসহায়ক হিসেবে ওরা উপার্জন করেন। গুগল জানাচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বে পরিযায়ী শ্রমিকদের অর্ধেকই মহিলা। এদের সংখ্যা বাড়ছে।
তেলের সন্ধান মেলার পর আবু ধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান-সহ সাতটি আমির-শাসিত অঞ্চল একত্রিত হয়ে ১৯৭১-এ তৈরি হয়ছিল ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরশাহী)। আশির দশকেই নতুন এই ছোট্ট দেশটি বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশের তকমা পেয়ে যায়। কাজের পরিধি বাড়ে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসতে থাকে কর্মপ্রার্থীরা। তখন থেকেই এখানকার বাসিন্দাদের গৃহসহায়ক হয়ে মেয়েরা প্রথম আসেন ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কা থেকে, পরে ইথিয়োপিয়া থেকে। ইংরেজি বলতে পারায় ফিলিপিন্সের মেয়েদের কদর ছিল বেশি।
এখন মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, ইথিয়োপিয়া, উগান্ডার মহিলা শ্রমিকদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। নেপালিরা আগেও ছিলেন, কিন্তু ২০১৫-র ভূমিকম্পের পর তাঁদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। নির্মলা রাইয়ের স্বামী অটো চালক। ভূমিকম্পের পর বাড়ি গড়তে ধার-নেওয়া মহাজনের টাকা সুদে-মূলে পৌঁছে যায় বিশাল অঙ্কে। অগত্যা আট বছরের ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে নির্মলা পাড়ি দেন দুবাই।
ঠিক তেমনই, তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কায় আর্থিক মন্দা শুরু হলে সে দেশের মেয়েরা আসতে থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। বছর বত্রিশের নিমিষা এসেছিল ২০২২-এ। করোনায় স্বামীর মৃত্যু পর দুটি ছোট সন্তান, বাবা-মা ও শাশুড়ির দায়িত্ব এসে পড়ে নিমিষার কাঁধে। তুতো দিদিদের সাহায্যে টুরিস্ট ভিসায় দুবাইতে এসে, এক পরিবারে পূর্ণ সময়ের গৃহসহায়কের কাজ জুটে যায়। এখন নিমিষা ইতালির ভিসা জোগাড় করে সেখানে গৃহসহায়কের কাজ করছেন। যাতে পরে ছেলে-মেয়েকেও ইতালিতে এনে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারেন।
এই সস্তা শ্রম মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী প্রবাসীদের কাছেও এক দারুণ পাওনা। কেউ হপ্তায় তিন দিন গৃহসহায়ক রাখেন, তো কারও ঘরে দিনে বারো ঘণ্টা। বহু ভারতীয় পরিবার দেশ থেকে, বা নেপাল থেকে শ্রমিকদের ভিসা দিয়ে নিয়ে আসেন। এমনকি পশ্চিমি দেশের বাসিন্দারাও মধ্যপ্রাচ্যে এসে গৃহসহায়কে অভ্যস্ত হয়ে যান। চাহিদা বিস্তর, তাই অনবরত মহিলা শ্রমিকরা আসতে থাকেন। এ কাজে ভিসাও মিলে যায় চট করে।
ইথিয়োপিয়া থেকে বাইশ বছরের থেকে হানা এসেছিল আবু ধাবিতে। পরিবারের বড় মেয়ে, অনেকগুলো ভাইবোন। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে হয় হানাকে। প্রথম দু’বছর শপিং মলে ক্লিনারের কাজ করেন। পরে নিজেই ভিসার ব্যবস্থা করে গৃহসহায়কের কাজ জুটিয়ে নেন। এতে উপার্জন বেশি। সাত বছর পেরিয়ে গেছে। হানার স্বপ্ন ছোট দুটো ভাইয়ের পড়া শেষ হলেই দেশে ফিরে নিজের সংসার পাতা।
ভারতের বেশির ভাগ শ্রমিক আসে পাঞ্জাব থেকে। তাদের আনার জন্য আলাদা বহু সংস্থা আছে। শারজায় এমন এক সংস্থা গ্রাম থেকে নিরক্ষর, গরিব মেয়েদের নিয়ে এসে বাড়ি বাড়ি কাজ দেয়। এরা পেশাদার বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। স্বভাবতই এদের কাজ নিয়ে অভিযোগ আসতে শুরু করে। মজার ঘটনা, সংস্থার কর্ণধার রোজ শারজা থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোন, এবং এক একজন কর্মীকে এক এক বাড়ি থেকে তুলে অন্য বাড়িতে কাজে লাগান। এ বাড়ি-ও বাড়ি থাকতে থাকতে মেয়েরা কাজ শিখে যায়।
প্রথম দিকে শ্রমিকরা আসত কেবল মাত্র বিভিন্ন নিয়োগকারী সংস্থা মারফত। সংস্থাকে মোটা টাকা দিয়ে বিদেশ যাওয়ার ছাড়পত্র জোগাড় করতে হতো। জমিজমা বিক্রি করে বা মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হতো তাদের। টাকা পেলে সংস্থা ভিসা ও কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। শ্রমিকদের পাসপোর্ট থাকে এজেন্সি বা কোম্পানির জিম্মায়। দু’বছর ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত যাতে আটকে থাকে। অনেক সময় সংস্থা যত বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদের নিয়ে আসে, হাতে দেয় তার চাইতে অনেক কম টাকা। অনেকে কাজ ছেড়ে দেয়, সংস্থা ততক্ষণাৎ তাদের ভিসা বাতিল করে দেয়। ভিসা বা এ দেশের পরিচয়পত্র না থাকলে কেউ কাজ দেয় না। মামলা জেল অবধি গড়িয়ে যায়। এমন ঘটনা ভূরি ভূরি। তবে শ্রমিকরাও থাকতে থাকতে এখানকার হালহকিকত বুঝে যায়। চেষ্টা করে ভিসার মেয়াদ শেষে নিজের ভিসার ব্যবস্থা করতে। স্বাধীন ভাবে কাজ জুটিয়ে উপার্জন বাড়াতে।
এখন পরিচিত অন্য মহিলা শ্রমিকের মাধ্যমে, বা ব্যক্তিগত স্পনসর-এর সহায়তায় অনেক শ্রমিক এ দেশে আসছেন। ফরিদপুরের সাবিনা এসেছিল গ্রামতুতো দিদির মাধ্যমে, আরব পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার জন্য। সে ক্ষেত্রে পরিবারের বাধ্যবাধকতার গণ্ডির মধ্যে আটকে থাকতে হয়। পাসপোর্ট গচ্ছিত থাকে যিনি স্পনসর করছেন, তার কাছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে জাকিরা এসেছিল আজমানে এক আরব পরিবারে। সেই বৃহৎ পরিবারে শেখের তিনটি বউ এবং পনেরোটি সন্তান। গৃহ সহায়ক চার জন। খাওয়া-পরার অভাব নেই, কিন্তু খাটতে হতো প্রচুর। রাত দুটোয় সেই পরিবারে বাজার আসত। তখন জাকিরাদের ঘুম থেকে উঠে সে সবের ব্যবস্থাপনা করতে হতো।
আশি-নব্বইয়ের দশকে আরব পরিবারগুলো মহিলা শ্রমিকদের সরাসরি স্পনসর করে নিয়ে আসত। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় তাদের জীবন বিষময় হয়ে উঠত। কারও সঙ্গে কথা বলা যেত না। অনেক মহিলা শ্রমিকই পরবর্তীতে বিভিন্ন সমীক্ষায় নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন তারা একাকিত্বে ভুগতেন। সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হতো বছরের পর বছর। উদয়-অস্ত খেটে যেতে হতো। অনেকেই মনিব পরিবারে লাঞ্ছিত, নিগৃহীত হতেন। উগান্ডার এক মহিলা শ্রমিক জানিয়েছিলেন, তাঁকে খেতে দেওয়া হতো অন্যদের ভুক্তাবশেষ। যৌন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটত বহু। ১৯৯৫তে দুবাইতে এক ফিলিপাইনস মহিলা শ্রমিক প্রাণদণ্ডের সাজা পেয়েছিলেন পরিবারের পুরুষ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে। যদিও তিনি জানিয়েছিলেন, ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে এ কাজ করেছিলেন।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বদলও এসেছে। এখন অনেক মহিলা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীকে নিরাপদ দেশ বলে মনে করেন। নেপালের লক্ষ্মী মাগার দশ বছর রয়েছেন আবু ধাবিতে। পার্লারে ক্লিনারের কাজ করতেন। ক্রমে রূপসজ্জার কাজ শিখে এখন নিজেই স্বাধীন ভাবে কাজ করেন। তাঁর কথায়, কাজ শেষ হতে অনেক রাত হলেও নির্ভয়ে ঘরে ফিরতে পারেন। রাস্তায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তৎক্ষণাৎ পুলিশের সাহায্য মেলে। এখানকার প্রবাসীরাও এ দেশের কড়া আইন সম্বন্ধে সতর্ক থাকেন।
গৃহসহায়কদের নিজেদের থাকার ব্যবস্থা ঠিক কী রকম? মনিব ভিসা স্পনসর করলে তার বাড়ি থাকতে হয়। তখন তারা সর্বক্ষণের কর্মী। কেমন কাটে এদের জীবন তা অনেকটাই নির্ভর করে মনিবের পরিবারের ওপর। যারা নিজেদের ভিসায় আছেন, তারা অনেকে মিলে একটি ঘরে থাকেন। দশ বাই বারো ফুট ঘরে ছয় থেকে আট জন থেকে যান। একটার ওপর আর একটা বাঙ্ক। বাঙ্কগুলোই তাদের আস্তানা। ভাড়া বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী সকলেই সপ্তাহে এক দিন ছুটি পান। সে দিনটা নিজেদের মতো করে কাটান তাঁরা। আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যান। অনেকেই সময়ের সঙ্গে এ দেশের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। দেশে ফিরে আর অভাব-অনটনের মধ্যে পড়তে চান না। ভিসার খরচ, ঘর ভাড়া, নিজেদের খরচ মিটিয়ে এঁরা দেশে সংসারের জন্য যত টাকা পাঠাতে পারেন, তা কখনওই দেশে থেকে উপার্জন করা সম্ভব নয়। তাই এঁরা বুঝে যান, এখানেই থাকতে হবে। নিজেদের মতো করে ওরা ভাল থাকার, আনন্দে থাকার পথ খুঁজে বের করেন। q
অভিবাসী-পরিযায়ী শ্রমিকদের
অধিকার, নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষার দাবি
আজ শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের
আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দাবি।