বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
পঁচাত্তর বছর আগে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে দক্ষিণ এশিয়ায় যে বিপুল মন্থন হয়েছিল, তাতে অমৃত আর গরল, দুই-ই উঠেছিল। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব পালন করছে ভারত, কিন্তু দেশভাগের গরল? তা কি এখনও ভুলতে পেরেছে? না কি উপেক্ষা করতে পেরেছে জন্মলগ্নে বিচ্ছিন্ন প্রতিবেশীকে, ভারতের সঙ্গে যার সম্পর্ক আস্ফালন আর বিদ্বেষের, কিন্তু ভারতের মতোই যে দেশ বহন করে চলেছে বিপুল দারিদ্র, অসাম্য, অনুন্নয়নের ভার?
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের সূত্র ধরে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা সৃষ্টি হয়৷ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালে৷ পশ্চিম পাকিস্তানের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঠেকিয়ে রাখতে পারল না৷ বরং ভারতের ভয় দেখিয়ে ওই দেশের সামরিক প্রতিষ্ঠান পারমাণবিক বোমা বানানো থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষার নানা খাতে অনুৎপাদনশীল ব্যয় বাড়িয়ে গেছে৷ আজকের পাকিস্তান তার খেসারত দিচ্ছে। এ হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতির স্বাস্থ্যের প্রতি অমনোযোগের মাশুল৷
পাকিস্তানে সামরিক প্রতিষ্ঠান অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উপর আধিপত্য কায়েম করেছে, সেগুলিকে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে দেয়নি৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিচার বিভাগকে ক্রমাগত কোণঠাসা করা হয়েছে৷ মৌলবাদী গোষ্ঠীকে হাতে রাখতে গিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের পথরুদ্ধ হয়েছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মান্ধতাকে চাপিযে দিয়ে তাকে করা হয়েছে অদক্ষ ও উৎপাদনবিমুখ৷
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মোটা টাকা অনুদান পেয়েছিল পাকিস্তান৷ তাই পুরো আশির দশক মার্কিন সাহায্যপুষ্ট পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল রমরমা৷ ওই দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি বৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের কাছাকাছি, যা ৫.৭ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি অর্জনকারী ভারতের কাছে ছিল ঈর্ষণীয়৷ বাংলাদেশের কাছে ছিল তা ছিল স্বপ্নের মতো৷ কারণ, সামরিক শাসনের জাঁতাকলে এরশাদের ‘স্বর্ণযুগে’ও বাংলাদেশ সেই দশকে মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি অর্জন করেছিল৷
পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠান দেশবাসীকে বোঝাতে সক্ষম হল, যে যুদ্ধ আশপাশে যুদ্ধ পরিবেশ থাকলে তা পাকিস্তানের জন্য ‘স্বাস্থ্যকর’৷ আশির দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে দিল৷ নব্বইয়ের দশকে, আশেপাশে বড় কোনও যুদ্ধ আশেপাশে না থাকা সত্ত্বেও — পাকিস্তান পারমাণবিক বোমায় মনোযোগ দিল৷ সম্ভবত ভারতকে টেক্কা দেবার ইচ্ছাই তাদের প্রণোদিত করেছিল। কাশ্মীর নিয়ে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধেও খুব একটা লাভ হল না৷ পাকিস্তানে ওই দশকের গড় জিডিপি বৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে এল৷
মোড় ফিরল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনার পরে৷ আফগানিস্তানে ছিল আলকায়দার আস্তানা ও তালিবানের চারণভূমি৷ তাদের মোকাবিলা করতে আমেরিকার বাহিনী পাকিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করল৷ পাকিস্তানি সেনাশাসক সুযোগটি লুফে নিলেন৷ এই শতকের প্রথম দশকে পাকিস্তান পশ্চিমের উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ভালই সুবিধা পেল৷ তবে জিডিপি বাড়ল সামান্যই, গড়ে সাড়ে ৪ শতাংশ৷ কারণ, তত দিনে ব্যাপক সামরিকীকরণে অনুৎপাদনশীলতা ক্যানসারের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ একই দশকে বাংলাদেশে জিডিপি বৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল৷
এ দিকে চীন পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে যথাসম্ভব শক্তিশালী করার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল পুরো ২০১০-এর দশকে, প্রধানত ভারতের মোকাবিলার জন্য৷ তবু ২০১০-এর দশকে পাকিস্তানের গড় জিডিপি বৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে এল৷ অ্যাটম বোমা, এফ-সিক্সটিন আর সামরিক দাপটের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন স্তব্ধ৷ পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের এই হল ইতিহাস। যা দেখে অনেকে মনে করছেন, রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে, এখন আর উন্নয়নের সম্ভাবনাও নেই৷ রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃঢ় ভাবে হাল ধরলে বহু দুর্বল প্রতিষ্ঠান আবার সবল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানে বারবার দেখা গিয়েছে, একটিই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা সেনাবাহিনী৷
১৯৭৩-২০২১, এই ৪৯ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশে সামরিক ব্যয় জিডিপির ১.২৩ শতাংশ, ভারতে তা ২.৯৬ শতাংশ, আর পাকিস্তানে ৫ শতাংশের ওপরে৷ সেখানকার অনেক সংস্থার দাবি, যে হিসাব পাকিস্তান সরকার দেখায়, তার চেয়ে আসল খরচ অনেক বেশি৷ অনামে, বেনামে বা ভিন্ন নামে সামরিক ব্যয় বাড়িয়ে প্রতিটি সরকার তাদের ভাগ্যনিয়ন্তাকে তুষ্ট করে রাখে৷
১৯৯৩ সাল থেকে গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে মোট সরকারি ব্যয়ের ১১ শতাংশ দেওয়া হয়েছে সামরিক খাতে৷ ভারতে তা প্রায় ১০ শতাংশ, আর পাকিস্তানে তা প্রায় ২১ শতাংশ৷ অর্থনীতিবিদেরা এ খরচের সিংহভাগকে অনুৎপাদনশীল খাতের খরচ বলে ধরে থাকেন৷ এই ২১ শতাংশও প্রকৃতপক্ষে ৩০ শতাংশের ওপরে, এমন দাবি করা হয়৷ একটা রাষ্ট্রের মোট বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যদি এই যুদ্ধবাহিনী পুষতেই চলে যায় তাহলে সে দেশের উন্নয়ন খাতে আর থাকে কী! তাই দু’হাত তুলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফকে ডাকাডাকি৷
পাকিস্তানের আজকের দূরবস্থা শুধু আকস্মিক ডলার সঙ্কট নয়৷ আইএমএফ হয়তো আপাতত এই সঙ্কট থেকে উতরে দেবে পাকিস্তানকে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানের রোগ সারবে কি?
একটা দেশের মুদ্রার মজুতের পরিমাণ তার স্বস্তির নির্ধারক৷ এ জন্য একটা দেশের মজুত বিদেশি ঋণের শতকরা কত ভাগ মেটাতে পারবে, সে হিসাব রাখা জরুরি৷ পাকিস্তান তার মজুত মুদ্রা দিয়ে মেটাতে পারে ঋণের মাত্র ১৬ শতাংশ৷ এই কাহিল অবস্থা হঠাৎ হয়নি৷ এটি পাকিস্তানের আজন্মলালিত ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের অনিবার্য পরিণতি৷
পাকিস্তানের আর্থিক ও রাজনৈতিক দুরবস্থায় ভারতের উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই৷ বরং সতর্ক হতে হবে, যেন কোনও প্রতিষ্ঠান সর্বগ্রাসী হয়ে না পড়ে৷ মেক্সিকোকে খেয়ে দিয়েছে ওদের মাদক বিক্রেতা চক্র (ড্রাগ কার্টেল), যেমন এক সময়ে ইতালিকে গ্রাস করেছিল অপরাধী ও মাফিয়া চক্র। এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার নানা দেশে সামরিক বাহিনীর অতিরিক্ত আধিপত্যও একই ভাবে দেশকে বলদর্পী হিসাবে দেখাতে গিয়ে উলটে দুর্বল করে তুলেছে। পাকিস্তানে বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংবাদ জগত, নাগরিক সমাজের নানা প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনী যে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, ও যে কায়দায় নীতি নির্ধারকদের কিনে নিচ্ছে, তা ভারতের জন্যও অশনি সঙ্কেত। আমাদের সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে৷
সামরিক বাহিনী আমাদের দেশকে নিয়ন্ত্রণ করে না। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের বহিরঙ্গের পোষাকে আজকে ভারতের অন্তরাত্মাকে ধীরে ধীরে হত্যা করা হচ্ছে। আজকের ভারতে শাসকরা কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে যোগসাজসে শাসন বিভাগ শুধু নয়, বিচার বিভাগ, শিক্ষা ব্যবস্থা, ইতিহাস এমন কি সামরিক বাহিনীকেও কর্পোরেট-হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় নিয়ন্ত্রণ করার মত্ততায় লিপ্ত। এ সম্পর্কে ভারতবাসীকে সজাগ ও সতর্ক হতে হবে।