বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন যুদ্ধ ও ভূ-রাজনীতি

ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন যুদ্ধ ও ভূ-রাজনীতি

সমুদ্র দত্ত

photo

কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি
বড্ড বেশি মানুষ গেছে মরে…

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানিতে ইহুদি জনগোষ্ঠীর যে ভয়াবহ নিধনযজ্ঞ হয়েছিল তা আমরা দেখিনি, পড়েছি। কিন্তু ইজরায়েলি বাহিনী গাজায় কীভাবে প্যালেস্তিনিদের নিকেশ করছে – আমরা প্রতি দিন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। গাজা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম মৃত্যুপুরী – ধ্বংসস্তূপ। গাজার মৃত্যু ও ধ্বংসের ছবির সঙ্গে বড় বেশি মিল মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হাতে ইরাক ধ্বংসের বর্বরতার।

বোমার আঘাতে আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাজার একের পর হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, ঘর-বাড়ি, উপাসনালয়। ইজরায়েলি সেনার আস্ফালনে পালাচ্ছেন ভয়ার্ত প্যালেস্তিনিরা – শিশু, নারী, বৃদ্ধ – উত্তর গাজা থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে – কিন্তু তারপর পালাবার আর জায়গা নেই। পানীয় জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ নেই, জ্বালানি তেল-গ্যাস নেই। জরুরি প্রয়োজনীয় মানবিক সাহায্য গাজায় প্রবেশের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে ইজরায়েলি সেনা। গাজায় বিপন্ন মানবতা।

হামাসের অতর্কিত আক্রমণের জবাবে ইজরায়েলি বাহিনী যে অভিযানে নেমেছে তা এককথায় প্যালেস্তিনি জনগোষ্ঠীর নিধনযজ্ঞ – গণহত্যার অভিযান। গাজায় দখলদার বাহিনী ইতিমধ্যে হত্যা করেছে ১৫০০০ জন প্যালেস্তিনি সাধারণ নাগরিককে। তার মধ্যে শিশু ৬০০০ জন, নারী ৪০০০ জন। ১৭ লক্ষ মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে – যার অর্ধেকই শিশু ও নাবালক। গাজায় আগ্রাসনের পাশাপাশি অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও পূর্ব জেরুজালেমে চলছে ইজরায়েলি সেনার আক্রমণ— বোমাবর্ষণ, হত্যা, গ্রেপ্তারি। আত্মরক্ষার অধিকারের যুক্তি অছিলা মাত্র। ৭৫ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে ইজরায়েল প্যালেস্তাইন ভূমি দখল ও প্যালেস্তিনি জনগণকে নিকেশ করার যে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে – গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধ তার বিস্তার মাত্র।

হামাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি তীব্র নিন্দায় ফেটে পড়ে। এ তাদের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতিরই বহিঃপ্রকাশ। ইজরায়েলের মতোই তারা হামাসকে সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করে। ইজরায়েলি অভিযানকে সমর্থন জানাতে তেল আভিবে উপস্থিত হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। ইজরায়েলের সমর্থনে দুটি বিমানবাহী রণতরী-সহ বিশাল মার্কিন নৌবহর ভূমধ্যসাগরে উপস্থিত হয়।

কিন্তু মোদি সরকার যেভাবে হামাসের আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ায় তা ভারতের দীর্ঘ দিনের প্যালেস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের অবস্থানের থেকে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত অবস্থান। হামাসের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের অভিযান সমর্থন, মোদি সরকারের এদেশে মুসলিম সহ সংখ্যালঘু জনগণের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদী অভিযান চালানোর নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদিও ভারতে হামাস নিষিদ্ধ ঘোষিত নয় এখনও পর্যন্ত।

প্রথম থেকেই পশ্চিম এশিয়া, মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলি থেকে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলি ইজরায়েলের গাজা-যুদ্ধের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। এরই প্রতিফলন পড়ে তিন সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতি ও গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে। জর্ডন উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি সহ চীন, রাশিয়া, তুরস্কের মতো ১২০টি দেশ। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় ইজরায়েল ও আমেরিকা সহ মাত্র ১৪টি দেশ। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি ও ভারত সহ ৪৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ইজরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির অবস্থানের এই আনুষ্ঠানিক ফারাকের কারণ সে দেশগুলিতে ইজরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে ও স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের সপক্ষে ক্রমবর্ধমান জনমত। গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধ বন্ধ করা ও ও গাজায় মানবিক সাহায্যের দাবি জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি সহ ইউরোপের দেশে দেশে, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় একের পর পর শহরে বিশাল বিশাল মিছিলে জনতার ঢল নামে — নিজ নিজ রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়ে বিশ্বমানবতা। কিছুটা দেরিতে হলেও ফ্রান্স, স্পেনের মতো ইউরোপীয় দেশ ইজরায়েলি বর্বরতা বন্ধ, যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সাহায্যের পক্ষে অবস্থান ঘোষণা করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপের দেশগুলি সহ মোট ১৪১টি দেশ। প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় রাশিয়া সহ মাত্র ৭টি দেশ। ভোটদানে বিরত থাকে চীন, ভারত, পাকিস্তান সহ ৩২টি দেশ। যদিও রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সেভাবে জাগ্রত ভূমিকায় দেখা যায়নি। বিশেষ করে, রাশিয়ার ওপর আর্থিক-বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার ক্ষেত্রে ফ্রান্স-জার্মানি সহ ইউরোপের অনেক দেশেরই দ্বিধা ছিল। রাশিয়ার সস্তা তেল ও গ্যাসের উপর ইউরোপের নির্ভরতার কারণে সেই দ্বিধা। বরং যুদ্ধের মূল্য চোকাতে চড়া দামে তেল-গ্যাস আমদানির খেসারত দিতে গিয়ে জীবনযাত্রার মানে টান পড়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ইউরোপের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী একের পর এক ধর্মঘটে সামিল হয়— ইউক্রেনকে সামনে রেখে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা-ইউরোপের প্রক্সি-যুদ্ধ বন্ধ করার আওয়াজ ওঠে।

ইজরায়েলের গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে সব থেকে সক্রিয় ভূমিকা নেয় পশ্চিম এশিয়া, মধ্য প্রাচ্যে আরব দেশগুলি। ন্যাটোভুক্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বৃহত্তম যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশে প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান ইজরায়েলকে যুদ্ধ-অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেন। হামাস সন্ত্রাসবাদী নয় বলেও তিনি জানান। পশ্চিম এশিয়ার দুটি প্রবল শক্তি সৌদি আরব ও ইরান চীনের মধ্যস্থতায় পারস্পরিক বৈরিতা দূর করে আর্থিক-বাণিজ্যিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় একদা সৌদি আরব ছিল আমেরিকার নির্ভরযোগ্য মিত্র এবং ইরান এখনও আমেরিকার আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ও হুমকির শিকার। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আরব লিগ ও ইসলামিক কো-অপারেশনের সংগঠনের ৫৭টি দেশ সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধে এক জরুরি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়। ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন সৌদি আরবের প্রিন্স মহম্মদ বিন সলমন, ইরানের প্রেসিডেন্ট রইসি, প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান, জর্ডনের রাজা আবদুল্লা, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফতাহ, কাতারের আমির শেখ তামিম, প্যালেস্তাইন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ আব্বাস, সিরিয়ার বাসার আল আসাদ প্রমুখ। আরব ও ইসলামিক দেশগুলি ইজরায়েলের গাজা-যুদ্ধকে ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসাবে ন্যায্যতার দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। অবিলম্বে যুদ্ধ-বিরতি কার্যকর করার জন্য বিশ্বের দরবারে উদ্যোগ নেবে বলে একমত হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আরব ও ইসলামিক দেশগুলির প্রতিনিধিরা চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্সে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে মিলিত হন। পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের ক্ষয় এবং যুদ্ধ বিরোধী বিশ্ব জনমত ইজরায়েল ও তার মুরুব্বি আমেরিকার নৈতিক সাহসকে কার্যত বহুলাংশে খর্ব করে দেয়। তার উপর, ইজরায়েলে অভ্যন্তরে পণবন্দিদের মুক্ত করার ব্যর্থতায় অসন্তোষ বাড়তে থাকে – যুদ্ধবিরোধী জনমতও চাপে ফেলে যুদ্ধবাজ সরকারকে।

হামাসের হাতে থেকে বন্দিদের উদ্ধার ও হামাসের সামরিক শক্তিকে ধবংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে বলে ঘোষণা করেছিল ইজরায়েল। ৪৭ দিন সামরিক অভিযান চালিয়েও কোনও লক্ষ্যই পূরণ করতে পারেনি তারা। গ্রাউন্ড অপারেশন শুরু করার পর কত জন ইজরায়েলি সেনার মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব তারা দিচ্ছে। কিন্তু হামাসের কত জন যোদ্ধাকে তারা বন্দি বা হত্যা করেছে তার হিসাব তারা দিতে পারেনি। তার উপর, লেবানন সীমান্ত থেকে হিজবুল্লা আর ইয়েমেনের হুথিদের মিসাইল ও ড্রোন হামলা চলছে ইজরায়েলে। হামাস, হিজবুল্লা আর হুথি – তিন ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাতে গেলে ইজরায়েলকে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। আমেরিকা ঘোষণা করেছিল, হামাসকে পর্যুদস্ত না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি নয়, এমনকি মানবিক সাহায্যও নয়। কিন্তু সেনা অভিযানের আক্রমণাত্মক রণনীতি কোনও ফল না দেওয়ায় ইজরায়েল ও আমেরিকা কূটনৈতিক দৌত্যের রাস্তা নিতে বাধ্য হয়।

পণবন্দি মুক্তির জন্য ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ নিয়ে দোহায় কাতারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন সিআইএ ও মোসাদের প্রধান। তাতেও নিশ্চিন্ত না হয়ে পণবন্দিদের মুক্তির জন্য খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন – কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও মিশরের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে বার বার বার্তালাপ চালান। হামাস তাদের হাতে বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে ইজরায়েলের জেলে প্যালেস্তিনি বন্দিদের মুক্তি, গাজার মানবিক সাহায্য এবং যুদ্ধবিরতির শর্ত দেয়। অবশেষে, কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় চার দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতি, গাজায় মানবিক সাহায্য এবং ৫০ জন ইজরায়েলি পণবন্দি এবং ১৫০ জন প্যালেস্তিনি বন্দি মুক্তির বিষয়ে হামাস ও ইজরায়েল রাজি হয়। ২৪ নভেম্বর যুদ্ধ বিরতি শুরু হয়েছে। মিশরের রাফা সীমান্ত দিয়ে জল, খাবার, ওষুধ, জ্বালানি তেল-গ্যাস নিয়ে ট্রাকগুলি গাজায় প্রবেশ করছে।
প্যালেস্তাইন সহ সারা পৃথিবী জুড়ে সাময়িক স্বস্তি। সারা বিশ্বের যুদ্ধবিরোধী মানুষের সঙ্গে আমরাও চাই দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি। চাই স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র – বৈদেশিক শক্তির সামরিক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এমন এক দেশ যেখানে প্যালেস্তিনিরা নিজেরা নিজেদের শাসন করবে। যদিও আমরা জানি স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র এবং যুদ্ধহীন শান্তির পথ বন্ধুর। এখনও অনেক সংগ্রাম লড়তে হবে প্যালেস্তিনিদের।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.