বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
কোনও দেশকে, বিশেষ করে ফ্রান্সের মতো কোনও উন্নত দেশকে যদি অন্যদের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হয়, তাহলে সেই সক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে, পেনশন ব্যবস্থার সংস্কার হয়ে দাঁড়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। বিশেষ করে ফ্রান্স এখনও যখন রয়েছে জনকল্যাণবাদী যুগে।
ফ্রান্স ইউরোপীয় অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এই দেশ এখন রয়েছে শিল্প-পরবর্তী যুগে। এর মানে ম্যানুফ্যাকচারিং ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে ফ্রান্স এখন রূপান্তরিত হয়েছে পরিষেবা ভিত্তিক অর্থনীতিতে। এই অর্থনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে ফ্রান্সের পেনশন ব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্ন। এমনকী সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি কতদূর পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে সক্ষম, তার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে ফ্রান্সের পেনশন সংস্কারের ইস্যুটি। বিশ্বায়নের যুগে ফ্রান্সের সামনে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি আসছে সেটা শুধুমাত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে থেকেই মাথাচাড়া দিচ্ছে না, চ্যালেঞ্জগুলো আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং অন্যান্য বিকাশশীল অর্থনীতির দেশগুলির দিক থেকেও।
এখনকার ফ্রান্সের যে অর্থনৈতিক শক্তি তার একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। সেটা হল ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমী ঔপনিবেশিক শক্তির সম্প্রসারণ। এছাড়াও রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ফ্রান্সের একাধিক প্রজন্মের কঠোর পরিশ্রমে অর্জিত সাফল্য।
আজকের দিনেও ফ্রান্স তাদের ১৪টি পূর্বতন পশ্চিম আফ্রিকার উপনিবেশের মুদ্রাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে, ওই দেশগুলিতে ফ্রাঁ-ই হল বৈধ মুদ্রা। এসব দেশগুলি তাদের বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডারের সঞ্চয়ের ৫০ শতাংশ ফ্রান্সের সরকারি ট্রেজারিতে জমা রাখতে বাধ্য। এই তহবিলই অন্যতম কারণ যার ফলে ফ্রান্স এখনও গোটা বিশ্বের মধ্যে খুব উদার হস্তে জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে পারছে, এবং পেনশন হল সেই ব্যবস্থারই অন্যতম অঙ্গ।
বিশ্বায়নের ফলে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি পড়ে গেছে ফ্রান্স। সেকারণে আগের প্রজন্মের ফরাসিরা যেসব ডিভিডেন্ড বা লভ্যাংশ সঞ্চিত করে গিয়েছিলেন সেই সুবিধাগুলি হারাচ্ছেন এখনকার প্রজন্মের ফরাসিরা। ফ্রান্সের হাতে এখনও টাকা রয়েছে এবং সেই টাকায় ইউক্রেনকে ভালরকম সামরিক সহযোগিতা দিতে পারে ফ্রান্স। তবে ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যাবে ফ্রান্সে বয়স্ক লোকেদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং তার জেরেই পেনশন ব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দেবে। সেকারণেই পেনশন সংস্কার নিয়ে এতখানি একগুঁয়ে অবস্থান নিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্র।
জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল পেনশন। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে বন্টন ব্যবস্থার নায্যতার প্রতিফলন দেখা যায় পেনশন বন্টনের মাধ্যমে। তাছাড়া অনেক দেশের অভিজ্ঞতা থেকেও এটা দেখা গেছে যে, পেনশন শুধু বাড়ানোই যায় এবং তা কমানো বেশ কঠিন। সুতরাং, কীভাবে আরও ন্যায্যতার ভিত্তিতে পেনশনের টাকা দেওয়া হবে এর তুলনায় পেনশন তহবিলের অর্থ কীভাবে আরও বাড়িয়ে নেওয়া যায় সেটাই এখন বড় সমস্যা হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে।
সবাইকে আরও বেশি বছর ধরে কাজ করানোর ব্যবস্থা ফ্রান্সের পক্ষে মোটেই ন্যায্য ব্যবস্থা নয়। কারণ এর মানে দাঁড়াবে বিপুল সংখ্যক অভিজাত শ্রমিক, যাঁদের মধ্যে পড়েন সেই সব শ্রমিকেরাও যারা কাজ করেন দূষিত ও বিপজ্জনক পরিবেশে, তাদেরও বাড়তি বোঝা বয়ে চলতে হবে। অথচ তাঁদের কাজের ধরন, আর যারা কম্পিউটারে কাজ করেন কিংবা স্টক বা শেয়ারের কাজে যুক্ত তাদের কাজের ধরন পুরোপুরি আলাদা। ফলে পেনশন সংস্কারকে দেখা হচ্ছে এমন একটা পদক্ষেপ হিসাবে যা সম্পদের বণ্টনে ফারাকের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেবে।
ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্স পরিচিত ছিল এমন একটা দেশ হিসাবে যেখানে সম্পদের বৈষম্য ছিল আপেক্ষিকভাবে কম। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই বৈষম্য ক্রমশ বাড়ছে। প্যারিস স্কুল অফ ইকনমিকস-এর ওয়ার্লড ইনইকোয়ালিটি ল্যাবের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সেই ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় সর্বত্রই আয় ও সম্পদের অসাম্য বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, সম্পদ কর (আইএফআই), যা একজন ব্যক্তির রিয়েল এস্টেটের সম্পদের ওপর আরোপিত কর, তার বদলে এখন চালু করা হয়েছে সংহতি সম্পদ কর (আইএসএফ) এবং এটা অসাম্যে আরও গতি আনছে।
ফ্রান্স বিশ্বের প্রথম সারির ক্ষমতাবান দেশ। এই দেশের সামনে এখন টাকাটাই শুধু চ্যালেঞ্জ নয়। নতুন প্রজন্মের যারা জলকল্যাণমূলক ব্যবস্থার সুযোগ সুবিধা উপভোগ করে তাদের মধ্যে কতজন, পূর্ববর্তী প্রজন্মের ফরাসিদের মতো, কঠোর পরিশ্রম করে, বিশেয করে সমাজের একেবারে নীচের দিকে এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে, স্থায়ীভাবে অর্থনৈতিক সম্পদ বৃদ্ধিতে রাজি? প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সার্কোজির সেই বিখ্যাত কথাগুলো মনে করা যেতে পারে যখন তিনি বলেছিলেন, ‘বেশি আয় করতে হলে আরও বেশি কাজ করুন।’ কয়েক বছর আগেও লোকে এসব কথা সঠিক বলে মনে করতো। তবে অনেক ফরাসি নাগরিক, বিশেষত যুব সম্প্রদায় এখন এসব কথা আর মোটেই শুনতে চায় না। তারা এসব কথাকে স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছে।তাই পেনশন সংস্কার শুধু একটা ব্যবস্থার সমস্যা নয়, এটা ফরাসি জনগনের মনোভাবেরও একটা ব্যাপার। প্রতিযোগিতার বাজারে ফ্রান্স নিজেকে জোরালোভাবে ধরে রাখতে পারবে কিনা, সেটা একটা দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ। একটা চ্যালেঞ্জ আসছে ব্যবস্থার দিক থেকে, অন্যটা জাতির মনোজগতের দিক থেকেও।
ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায়, ইউরোপীয় পুঁজিবাদ সর্বদা ন্যায্যতা ও দক্ষতার মধ্যে কোনও একটিতে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছে এবং তার মধ্যে দিয়ে ধারাবাহিকভাবে এমন একটা অভিমুখ বের করতে চেয়েছে যে পথ ধরে সংস্কারে পৌঁছনো যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে ইউরোপের লোকেরা সম্পূর্ণ অন্য এক পথ বেছে নিয়েছে। সেই পথটা হল, কল্যাণমূলক বিষয়গুলিতে গুরুত্ব দেওয়া এবং ন্যায্য বণ্টনে জোর দেওয়া। যদিও এমনকী কল্যাণমূলক পুঁজিবাদের অধীনেও, পুঁজিবাদের স্বরূপ কখনও বদলায় না, বদলায় না এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত স্ববিরোধগুলি, এবং এই অন্তর্নিহিত স্ববিরোধগুলিই অনিবার্যভাবে সম্পদে বৈষম্য গড়ে তোলার পথ সুপ্রশস্ত করে।
এর ফলেই মনে হয় যে, ফরাসি জনগণ সঙ্কট সমাধানের কোনও একটা রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। যতদূর দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদ এখন একটা সংকট বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেছে। যদিও পুঁজিবাদ খুব দ্রুত পৃথিবীর বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে না, তবুও একথা ঠিক যে, পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ পথের রূপরেখা অনিশ্চয়তায় ভরা।
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস, ২৬ মার্চ, ২০২৩