বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

তালিবান ও আফগান নারী স্বাধীনতা

তালিবান ও আফগান নারী স্বাধীনতা

প্রতিভা সরকার

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— আফগান নাগরিকের ৩০% যদি শহরে বাস করে, তাহলে গ্রামাঞ্চলে তাদের সংখ্যা ৭০%। ও দেশে নারী স্বাধীনতার আলোচনায় এই তথ্যটি মনে রাখা খুব জরুরি। কারণ দেশটিকে দাবাখেলার ঘুঁটিতে পরিণত করেছে যে সব বিরাট রাষ্ট্রশক্তি তারা প্রত্যেকেই অন্তত মুখে নারী স্বাধীনতার দোহাই দিয়েছে, কিন্তু মুখের কথাকে কার্যকর করতে গিয়ে এই গোড়ার কথাটাই ভুলে গিয়ে সমান ও একরকম পরিবর্তন আনতে গিয়ে শহর ও গ্রামে দেশটিকে আড়াআড়ি ভাগ করে ফেলেছে বা সেই বিভাজন রেখাকে গভীরতর করেছে।

একদিকে থেকেছে সেই ধর্মানুরাগী তরুণ ও যুবকেরা যারা নারী স্বাধীনতার কথা শুনলে তওবা তওবা বলে মুখে হাত চাপা দেয় ও সমস্ত আধুনিক পরিবর্তনকে লড়াই করে রুখে দেবার প্রতিজ্ঞা করে। ফসলের খেত-ঘেরা ছোট ছোট দুর্গম পাহাড়ি জনপদে গার্লস স্কুল ও ল্যান্ড রিফর্মস, বিষবৎ পরিত্যাজ্য। জীবন্ত কোনও কিছুর মতো দেখতে খেলনা এখানে নিষিদ্ধ। এমনকি পাখির মতো দেখতে বলে ঘুড়ি ওড়ানোর নির্মল আনন্দও নিষিদ্ধ। এদিকের মেয়েরা শোবার ও রান্না ঘর ছাড়া সর্বত্র অদৃশ্য। আর বিভাজন রেখার ওদিকে রয়েছে আলো ঝলমলে শহর, যেখানে মেয়েরা নিজেদের জীবনকে খানিকটা হলেও ইচ্ছেমতো চালাতে পারে। যেখানে বোরখা পরা আবশ্যিক নয় এবং প্রশাসনিক কাজকর্মে, এমনকি পার্লামেন্টেও নারীর অংশগ্রহণ জায়েজ। পুরুষদের টুপি পরতেই হবে, এমন কথা কেউ বলে না, জীবন্ত কোনও কিছুর অনুকৃতিও এখানে ট্যাবু নয়।


নারীকে সামনে রেখে এই দুই আফগানিস্তানের জোর লড়াই সর্বপ্রথম সামনে আসে রাজা আমানুল্লার সময়। তালিবান থাকুক বা নাই থাকুক চিরকাল বৃহত্তর আফগানিস্তানে মেয়েদের ব্যক্তিগত এবং সর্বজনীন জীবন সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে চিরকালই অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলাতেও নিষেধ আছে, মেলামেশা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। বোরখা ছিল এবং আছে, লার্ভার গুটি যেন, যার ঘেরাটোপে ভেতর বয়ঃসন্ধি প্রাপ্ত মেয়েরা অদৃশ্য হয়ে যায়, যখন আবার বাইরে আসবার অনুমতি পায়, তখন সে দাদী হয়ে গেছে, তবুও দেহাবরণ নিজের জায়গাতেই রয়ে গেছে।  

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় দুর্গম আফগানিস্তানে দুর্ধর্ষ পাহাড়ি কৌম উপজাতির একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। তখন হয়তো মেয়েদের জন্য প্রথাগত এবং পিতৃতান্ত্রিক সম্মানের কিছু বন্দোবস্ত থাকবে, কিন্তু স্বাধীনতা কতটা ছিল সে সম্বন্ধে কোনও তথ্য প্রমাণ আজ আর অবশিষ্ট নেই। ১৯১৯ থেকে রাজা আমানুল্লা খান, যিনি ছিলেন কামাল আতাতুর্কের অনুসারী,  আফিগানিস্তানে খুব দ্রুত পশ্চিমি সভ্যতার ধারা নিয়ে আসবার চেষ্টা করেন। তার সংস্কারের অনেকটাই ছিল নারী কেন্দ্রিক। নতুন সংবিধানে নারীপুরুষের অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল। বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ করা হল, বহুবিবাহ, ধর্মীয় অনুশাসনের রমরমা কমিয়ে আনবার চেষ্টা হতে লাগলো। রাণী সুরাইয়া অবগুণ্ঠন মুক্ত অবস্থায় ইউরোপ ভ্রমণে গেলেন, কাবুলে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট পর্দাপ্রথা তুলে দেওয়া হল।


ধর্মান্ধরা নারীমুক্তির পথে এই পদক্ষেপগুলি এবং আধুনিকতা সইবে কেন! বিদ্রোহ হল, রাজা আমানুল্লাকে সরিয়ে দিয়ে রাজা হলেন মহম্মদ নাদির শাহ। তিনি পূর্বসূরির এইসব প্রচেষ্টা শিকেয় তুলে রাখলেও, তার পরে যিনি সিংহাসনে বসলেন, সেই জাহির শাহ মেয়েদের ভোটাধিকার দিলেন, ঘরের বাইরের পৃথিবীতে কাজের অধিকারের ব্যবস্থা করলেন। তার মানে এই নয়, যে মেয়েদের জন্য কোনও স্বর্গীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল বা উপজাতীয় সর্দাররা একেবারে রাজার বশে চলে এসেছিল। তবে আফগান নারীর নিজের অধিকারের জন্য অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের সেই শুরু। এখনও, 'ভালো' তালিবানের আফগানিস্তানেও তারা যা অকুতোভয়ে করে চলেছেন।

এরপর রাজতন্ত্রের কাল শেষ হয়ে গেলে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রত্যক্ষ উপস্থিতির কারণে আফগান মেয়েরা সমস্ত ক্ষেত্রেই অকুতোভয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে এগিয়ে এসেছে। ধর্মগুরু এবং ঐতিহ্যবাদীদের বিরোধিতার চোরকাঁটা ভালমতো বিছানো থাকলেও অন্তত শহরগুলোতে নারী স্বাধীনতার পথে তেমন প্রতিবন্ধকতা মাথা উঁচু করেনি। মেয়েরা ডাক্তার নার্স, শিক্ষক, প্রশাসক সমস্ত পদেই ছিলেন। নির্বাচনে লড়তেও বাধা ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনেও আইনি সাহায্য অপ্রতুল ছিল না। আশির দশকেই মেয়েরা ভাইস প্রেসিডেন্টের অফিস সামলেছে।

cover

গ্রামগঞ্জে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মেয়েলি জীবনকে মানুষের জীবনে রূপান্তরিত করাতে সোভিয়েত-বান্ধব আফগান সরকার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়েছিল। ১৯৭৯ সালেই প্রথম নারী সাক্ষরতা প্রোগ্রাম চালু হয়। বাল্যবিবাহ আবার নিষিদ্ধ হল। মেয়েরা নিজেরাই জীবনসঙ্গী নির্বাচনের অধিকার পেল। স্কুল কলেজে মেয়েরা ভিড় জমালো রেকর্ড সংখ্যায়। তার মাশুলও দিতে হচ্ছিল। এই সমস্ত সংস্কার কৌম নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে। হেলমন্দ প্রদেশে একটি গার্লস স্কুলের সমস্ত শিক্ষককে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়া হয়, কারণ তারা ছিলেন স্ত্রী শিক্ষার সমর্থক। এই অপরাধে তাদের কোতল করা হয়। প্রত্যুত্তরে সরকার নির্বিচারে তুলে নিয়ে যায় স্ত্রী শিক্ষার বিরোধী বলে পরিচিত উপজাতীয় নেতাদের। আর কোনও দিন তারা নিজের দেশ গাঁ-য়ে ফিরে আসেনি।

এইভাবে আফগানিস্তানে ধীরে ধীরে মাথা তুলছিল ধর্মীয় মৌলবাদ, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আমেরিকার একান্ত অবদান কমিউনিস্টদের প্রতি ঘৃণা এবং আফগানদের নিজের দেশকে বৈদেশিক প্রভাব মুক্ত দেখবার অভিপ্রায়। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, ঐতিহ্যবাদী উপজাতীয়রা কখনো কারো বশ্যতা মানেনি, এবারও মানলো না। এর সঙ্গে যুক্ত হল আমেরিকান প্রশাসনের ওসামা বিন লাদেন নামে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরির কান্ড কারখানা। শুধু বিপুল অর্থসাহায্য নয়, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে মুজাহিদদের সোভিয়েত বিরোধিতায় মদত দিয়েছিল আমেরিকা। এই ভূখন্ডকে আফিম ও ড্রাগ পাচারের স্বর্গরাজ্য এবং অপরাধের মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার দায় মূলত তাদের। গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত আফগানিস্তানকে মুজাহিদদের হাতে রেখে সোভিয়েত ট্রুপ যেদিন দেশটা ছাড়ল, সেদিনই আফগানি নারীমুক্তির কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হয়েছিল।

তারপরের ইতিহাস (১৯৯০-২০০১) আফগান নারীর লাঞ্ছনার ইতিহাস বললেও অত্যুক্তি হয় না। ঠিক কথা, তালিবানের অনুশাসনের বিরুদ্ধে যে গেছে, সে নারীই হোক বা পুরুষ, তার কপালেই জুটেছে চরম শারীরিক লাঞ্ছনা, মৃত্যু, কিন্তু সমস্ত মানবিক অধিকার হরণ করে মানুষকে, এখানে পড়তে হবে নারীদের, কিভাবে গরু-ছাগলের পর্যায়ভুক্ত করা যায় তা আফগানিস্তানে তালিবানরা পৃথিবীকে দেখিয়েছে তাদের এক দশকের রাজত্বকালে।

আফগানিস্তানে যতোবার ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে মসনদটি দখল করা বা মসনদ থেকে হটিয়ে দেওয়া, যাইই হোক না কেন, ততোবারই এই নারী-স্বাধীনতার ব্যাপারটা বেশ সুস্বাদু ভোজ্যের মতো লোকের পাতে দেওয়া গেছে এবং লোকে সেটা খেয়েছেও।

সোভিয়েত পরবর্তী তালিবান অভ্যুত্থানে ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদের ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল অশিক্ষা অনুশাসনের অন্ধকার কন্দরে। কারণ ধর্মীয় মৌলবাদ সবসময়ই যাবতীয় অনাসৃষ্টির জন্য নারীদের দায়ী করে এবং সেই অছিলায় তাকে কেবল মাত্র যৌনদাসীতে পর্যবসিত করতে চায়। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির সবারই এই প্রবণতা আছে, কারো বেশি, কারো কম, এইমাত্র। আফগানিস্তানের মেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, কাজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল, কয়েক তলা আছে এমন বাড়ির একতলা, দোতলা আগাপাশতলা নিরন্ধ্র মুড়ে দেওয়া হল, যাতে ঘরের মেয়েদের বাইরের লোক দেখতে না পায়, কিম্বা উল্টোটা। নেইল পলিশে নখ রাঙিয়েছিল বলে যে মেয়েটির আঙুলগুলো কেটে নেওয়া হয়েছিল, কিম্বা ব্যভিচারের দায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হয়েছিল যে নারীকে, তাদের আর্তি ইউটিউব খুঁজলেই শুনতে পাওয়া যাবে। স্কুল কলেজ থেকে মেয়েদের নির্বাসন দেওয়া হল, প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি তো দূরের কথা, বাড়ি থেকে বেরোতে হলেই একজন পুরুষ আত্মীয়কে সঙ্গী  হতে হবে৷ যেন পৃথিবীতে এমন সংসার নেই, যেখানে সব সদস্যই মহিলা! এমন বোরখা মেয়েদের পরতে বাধ্য করা হল যাতে আধ ইঞ্চি ত্বকও কেউ দেখতে না পায়। তাহলেই নাকি ভগবানের পবিত্র সন্তানদের চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিতে পারে!
অসুস্থ হলে ভর্তি হতে হবে শুধু স্ত্রী চিকিৎসার হাসপাতালে পাছে পুরুষ ডাক্তার নারী রোগীকে দেখে ফেলে পাপের ভাগীদার না হয়! যদি মেয়েদের ঘর থেকে বারই হতে না দেওয়া হয়, লেখাপড়া শেখা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মহিলা ডাক্তার আবির্ভূত হবে কোথা থেকে কে জানে! মোদ্দা কথা, মেয়েরা মরলো কী বাঁচলো, তাতে কারো কিছু যায় আসে না। এসব না মানলে বরাদ্দ হবে প্রকাশ্যে চাবুক মারা, পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা, ইত্যাদি। 

বিশ বছর বাদে সেই তালিবানদের চিত্তশুদ্ধি হয়েছে, এ কথা বিশ্বাস মুস্কিল। ধর্মের অনাচারের দোহাই দিয়ে আবার তালিবান সরকার মেয়েদের অন্ধকারে ঠেলে দেবে না এর কোনও ইঙ্গিত কি এখন দেখা যাচ্ছে।

সারা পৃথিবী জুড়েই খুব সঠিক কারণেই আফগান নারীর এই অমানবিক অবস্থায় হায় হায় রব উঠলো এবং রঙ্গমঞ্চে সদর্পে আমেরিকার প্রত্যক্ষ প্রবেশ হল। তার মুখেও কিন্তু ঐ একই ইস্যু, চোখে নারীর অবদমনের কারণে কুম্ভীরাশ্রু। আসলে মুখে নারী স্বাধীনতার বুলি কপচেছে তারা, নজর রেখেছে ড্রাগ আফিম গ্যাসের পাইপ লাইন ইত্যাদির ওপর। অর্বুদ অর্বুদ ডলার সৈন্যদের পেছনে খরচ হয়েছে কিন্তু আফগান নারীর অবস্থা কসমেটিক চেঞ্জের বাইরে যায়নি কখনো। তাও সেই পরিবর্তন একান্তভাবেই কাবুল কেন্দ্রিক।

৯/১১ এর হামলার পর আমেরিকার ফার্স্ট লেডি লরা বুশ হঠাৎ ফুকারি উঠে বললেন, "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই এক অর্থে নারী স্বাধীনতার জন্য লড়াই।" যখন রেগান প্রশাসন তালিবানদের নিয়ে হোয়াইট হাউজে মিটিং করছিল কিম্বা ওসামা বিন লাদেনকে কয়েকশো কোটি ডলারের পৈতৃক ব্যবসা জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে মদত দিয়েছিল তখন নারী স্বাধীনতার কথা কি তারা বিস্মৃত হয়েছিল! ৯/১১-র পরেও আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকান সৈন্যদের স্বাভাবিক মিত্র হল পূর্বতন মুজাহিদরা যারা তালিবানের বিরোধিতা করলেও তাদের মতোই ভয়াবহ ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। যেমন জেনেরাল রশিদ দোস্তাম, যার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের হিউম্যান রাইটস গ্রুপগুলো একমত যে সে এক গণহত্যাকারী, অত্যাচার অপহরণ ধর্ষণের অপরাধী।

তালিবান এবং আমেরিকা, দুইই প্রবঞ্চক। আফগান মেয়েদের তারা নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তালিবান মুক্তির বদলে নিয়ন্ত্রণ চাপিয়েছে, কারণ ওটাই তাদের কাছে ঐতিহ্যসম্মত এবং ইসলামের র্যাডিকাল ব্যাখ্যা সম্মত। আর আমেরিকা আফগান নারীকে ব্যবহার করেছে নির্বিচার বোমা বর্ষণ ও অন্যান্য অত্যাচারকে ন্যায় প্রমাণ করতে, দুর্নীতিকে আড়াল করতে, যেন তারা এই সবই করছে নারীমুক্তির মহান লক্ষ্যে। নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর বোমা বর্ষণের ওপর নকল ফেমিনিজমের প্রলেপ বুলিয়ে দেশটাকে তছনছ করে দু’ দশক পরে সেই তালিবানদের হাতেই আফগানিস্তান ছেড়ে পালাল।

শরিয়ত হচ্ছে ইসলাম ধর্মসম্মত আইনকানুন। সতত পরিবর্তনশীল, কারণ এটি ধর্মগুরুদের ব্যাখ্যানির্ভর। শক্তিমান রাজনীতিকদেরও। এবং তারা কোনও দিনই খুব নারীবান্ধব এরকম অপবাদ শত্রুও দিতে পারবে না। যদি পবিত্র কোরাণের উদাহরণ দেখা যায় তাহলে তো নারী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হচ্ছে তার কোনওটাই ধোপে টেঁকে না। হজরত মহম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিন খুয়েলিদ নিজে সফল ব্যবসায়ী ছিলেন এবং অধীনস্থ কর্মচারীদের দাপটের সঙ্গে পরিচালনা করতেন। অথচ আগের বার ক্ষমতায় এসে তালিবান পত্রপাঠ আফগান নারী কর্মরতাদের ঘরে ফেরত পাঠিয়েছিল। এবার যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মেয়েদের লেখাপড়া আর কাজকর্ম করবার অধিকার কেড়ে নেবে না, কিন্তু সেটা কতটা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আদায়ের জন্য, আর কতটা সত্য বচন তা নিয়ে বিলক্ষণ সন্দেহ আছে।

এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে পূর্বতন সরকারের নারী পদাধিকারীদের লাঞ্ছনা। ৫ সেপ্টেম্বর ঘোর প্রদেশে এক অন্তঃসত্ত্বা পুলিশ অফিসারকে পিটিয়ে মারা হয় তার পরিবারের লোক এবং তার সন্তানদের সামনে। গোটা কাবুলে মোট ২৫০ জন মহিলা বিচারক ছিলেন। বেশিরভাগই এখনও দেশে, বাইরে পালাতে পারেননি। তালিবান কাবুলে ঢুকেই জেল ভেঙে ৫০০০ হাজার বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। এই মুক্তিপ্রাপ্তরা এখন মহিলা বিচারকদের খুঁজে বার করে তাদের জেলে পাঠানোর বদলা নিতে উদগ্রীব। বাড়ি বাড়ি খানাতল্লাশি চালানো হচ্ছে। ৭০০ মহিলা সাংবাদিক ছিলেন, এখন মেরেকেটে ১০০ দেখা যাচ্ছে। বাকিরা যেন স্রেফ উবে গেছেন। এদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কারো নয়।

মেয়েদের লেখাপড়া কাজকর্মের যে কোনও স্থিরতা থাকবে না, তা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। শরিয়তের তালিবানি ব্যাখ্যায় মেয়েরা আট বছর হয়ে গেলেই নিজেদের বিশাল বোরখায় মুড়ে নেবে, বাড়ির বাইরে পা রাখতে হলে সঙ্গে নেবে প্রাপ্তবয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও পুরুষ আত্মীয়কে। বার বছরের বালকের ভরসায় বাজারহাট করা, শিক্ষা নেওয়া, চাকুরিস্থলে যাওয়া, একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারীর পক্ষে সম্ভব? সুতরাং নারীশিক্ষা, কর্ম সংস্থান, প্রত্যেক পদে বাধাপ্রাপ্ত হবে তাতে আর সন্দেহ কী!

আরো আছে। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়তে পারবে না, নারী শিক্ষক ছাড়া চলবে না। ইউনিভার্সিটি আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই উচ্চশিক্ষা সম্ভব। খুব হাস্যকর একটি কথা বলেছে 'ভাল' তালিবানেরা। যদি বৃদ্ধ এবং 'ভাল চরিত্রের' কোনও শিক্ষক পাওয়া যায়, তখন তারা ভেবে দেখবে। বার্ধক্য এবং চরিত্রের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে নাকি? আমাদের দেশে যৌন কেলেংকারীতে জড়িয়ে পড়া সব ধর্মগুরুই তো বৃদ্ধ!

মেয়েরা বোরখা পরবে নিজের পরিবারের লোকের সামনেও। উন্মোচন হবে শুধু নিভৃতে স্বামীর সামনে, পুরুষটির রূপতৃষ্ণা বা অন্য চাহিদা মেটাতে। রূপের কথাই যদি উঠল, তাহলে বলি এবার কাবুল প্রবেশের পর তালিবান আর একটি মহান কাজ সেরে ফেলেছে। সেটি হল বিউটি পার্লারগুলিতে ভাঙচুর করা। পোস্টারের সুন্দর মুখগুলোতে কালি লেপে দিয়ে তারা এই বার্তা দিয়েছে যে মেক-আপ বন্ধ। এমনকি নখরঞ্জনীও চলবে না। মেয়েরা হাইহিল পরবে না। কারণ তাদের উচ্চকিত পদশব্দ যেন কোনও পুরুষের কানে না ঢোকে। কথা বলবে এমন মৃদু কন্ঠে, যেন কোনও অপরিচিত তার কন্ঠস্বর না শুনতে পায়।

গানবাজনা, মডেলিং, অভিনয়, সবই শরিয়ত বিরোধী। সেই পেশায় থাকা মেয়েদের গা ঢাকা না দিয়ে উপায় নেই। রীতিমতো চিতা জ্বেলে অডিও ভিডিও ক্যাসেট পোড়ানো শুরু হয়ে গেছে। আফগানি মহিলা ফুটবলার, ক্রিকেটাররা একই অবস্থায়৷

এই পরিস্থিতিতে যে পরিবারগুলো পারছে, ঘরের মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে বাঁচাতে চাইছে। ট্রানজিট ক্যাম্পে ইভ্যাকুয়েশনের যোগ্য অচেনা পুরুষের সঙ্গে অনেক ডলারের বিনিময়ে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে স্নেহপুত্তলিটির। তার পরের ভবিষ্যত কারো জানা নেই।

আর যারা তা পারছে না, তাদের ঘরের মেয়ে-বৌরা প্রস্তুত হচ্ছে চূড়ান্ত লাঞ্ছনার জন্য, যন্ত্রণাময় জীবন ও মৃত্যুর জন্য। যেন তারা ফাঁসির আসামি, যে কোনও দিন টেনেহিঁচড়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হবে। যদি কোনও আফগান পিতা কন্যা সন্তান না জন্মাবার প্রার্থনা করে, তা কি খুব অযৌক্তিক হবে?

তবু আফগান মেয়েরা লড়ছেন। কাবুলে, হিরাটে তারা কাজের দাবি, শিক্ষার দাবিতে পথে নেমেছেন। কিন্তু অসম যুদ্ধের ফল কী হবে সকলেই জানে। তালিবানের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স নেমে গেছে এই মেয়েদের জব্দ করতে। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের সামনে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে বন্দুকের কুঁদো, পিপার স্প্রে আর কাঁদানে গ্যাস। বহু একটিভিস্ট রক্তাক্ত, বিপর্যস্ত। তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় মেয়েদের জন্য যেটুকু কাজ এগিয়েছিল তা যেন আবার একটি বৃহৎ শূন্যে পর্যবসিত হল। একটি কথা এতো দিনে পরিষ্কার বোঝা গেছে, বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস হতে পারে, কিন্তু নারী স্বাধীনতার উৎস অবশ্যই অন্যকিছু, অনেক শতাব্দীর অনেক রক্তপাত এবং মেকি সহানুভূতি তাকে হাসিল করতে পারে না।

আফগানিস্তানের মেয়েরা এখন চূড়ান্ত বিপদের সম্মুখীন। তাদের নিগ্রহ করার অনেক অছিলাই এখন খুঁজে বার করা হতে থাকবে। কোরাণ পোড়ানোর মিথ্যা অভিযোগে খোদ রাজধানীতে পিটিয়ে মারা হয়েছিল যাকে সেই ফারকুন্দা মালিকজাদা অনেক অনেক লাশ হয়ে আমাদের স্মৃতিতে হানা দিতেই থাকবে। আফগানি মেয়েদের দোহাই, ভাল তালিবানের জয়ধ্বনি দেবার সময় আমরা যেন এই মেয়েদের কথাও ভাবি।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.