বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
স্বাধীনতার ২১২-বছরে কলম্বিয়ায় এই প্রথম বামপন্থা-ঘেঁষা প্রগতিশীল সরকার।
ইতিহাসের নতুন পাতা! আগস্টের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন বামপন্থী নির্বাচনী জোট প্যাক্টো হিস্টোরিকা (হিস্টোরিকাল প্যাক্ট)-র প্রার্থী গুস্তাভো পেত্রো। উপরাষ্ট্রপতি— গার্সিয়া মার্কেজের দেশে আরেক মার্কেজ। ফ্রান্সিয়া মার্কেজ। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা উপরাষ্ট্রপতি।
ব্রাজিলে ফিরেছেন লুলা। অক্টোবরের শেষে। উগ্র দক্ষিণপন্থাকে হারিয়ে ব্রাজিল আবার বামপন্থায়।
লুলার জয়ের পর লাতিন আমেরিকার অর্ধেকের বেশি দেশেই এখন মধ্য-বাম থেকে বামপন্থী সরকার। মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা আগেই ছিল। লুলার জয়ের পর লাতিনের বৃহত্তম প্রথম তিনটি দেশেই এখন বামপন্থী, মধ্য-বাম সরকার।
তখনও কলম্বিয়ার নির্বাচন হয়নি। ২০২২। বছরের গোড়ায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসের হিসেব, লাতিনের অন্তত ১৫টি দেশে সরকার চালাচ্ছেন বামপন্থী অথবা মধ্য-বাম নেতৃত্ব। আর এখন— বস্তুত, এই প্রথম লাতিন আমেরিকার পাঁচটি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ— ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, চিলি, কলম্বিয়াতে বামপন্থী অথবা মধ্য-বাম সরকার। ক’দিন আগে পেরুও ছিল। নভেম্বরে, দক্ষিণপন্থীদের অভ্যুত্থানে অপসারিত হন পেদ্রো কাস্তিও।
মার্কিন মদতে, উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সমর্থনে যে চিলি (১৯৭৩), হন্ডুরাস (২০০৯) এবং বলিভিয়া (২০১৯) একসময় সেনা অভ্যুত্থানের সাক্ষী, এখন সেখানে ক্ষমতায় বামপন্থীরা। ২০২১: বামপন্থী, মধ্য-বাম নেতৃত্বরা জেতেন পেরু, হন্ডুরাস, চিলিতে। তার আগে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা এবং বলিভিয়ায়। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, এই অঞ্চলের বৃহত্তম দেশে লুলার জয় এই স্রোতকে শিখরে তুলবে। লাতিন আমেরিকার অর্থনীতির ৪০ শতাংশের বেশি জুড়ে রয়েছে একা ব্রাজিল।
এই শতকের শুরুতে লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী প্রগতিশীল আন্দোলন শীর্ষে পৌঁছেছিল।
ভেনেজুয়েলায় উগো সাভেজ, আর্জেন্টিনায় নেস্টর কির্চনার সহ অন্যান্য বামপন্থী, বামপন্থা-ঘেঁষা নেতাদের জীবনাবসান, অথবা রাজনীতির অঙ্গন থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির জন্য তৈরি হয় নতুন পরিসর। আর তারা সেই সুযোগে ক্ষমতায় আসে ২০১৪-১৫তে। তখন মনে হয়েছিল দক্ষিণপন্থার এই চক্র অন্তত এক-দেড় দশক থাকবে। করোনা মহামারি এই অঞ্চলে দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি করে। ক্ষুধা-দারিদ্র-বেকারত্ব ভয়াবহ চেহারা নেয়। যা বামপন্থীদের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম উপাদান হিসেবে কাজ করে। লাতিনে দক্ষিণপন্থার রাজনীতির চক্র স্থায়ী হয় মাত্র তিনবছর (২০১৫-১৮)। তীব্র সামাজিক প্রতিবাদ ও গণআন্দোলনের মুখে দ্রুত তা পরাস্ত হয়।
২০১৮, এই প্রথম বিশ্বের বৃহত্তম স্প্যানিশভাষী দেশে বামপন্থা-ঘেঁষা সরকার। মেক্সিকোয় এক নতুন যুগের সূচনা। নব্বই বছরের দ্বি-দলীয় আধিপত্যে ভাঙন। সাড়ে তিন দশকের নয়া উদারবাদী জমানায় বিকল্পের সম্ভাবনা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আন্দ্রেজ ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোর। মেক্সিকোর মানুষের কাছে পরিচিত ‘আমলো’ নামে। তার আগে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে ‘গোলাপী স্রোত’ ধাক্কা খাওয়ার পর, লাতিনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে আমলোর এই জয় ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রিটিশ ইকনমিস্ট পত্রিকার ব্যাখ্যা ছিল, ‘এই জয়ে পরিবর্তন হতে পারে আঞ্চলিক কূটনৈতিক ভারসাম্য, উৎসাহিত করতে পারে ভেনেজুয়েলার মাদুরো জমানাকে এবং লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক একীকরণ প্রক্রিয়াতে নিতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।’
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আর্জেন্টিনায় উগ্র দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে এক নির্ণায়ক রায়। অক্টোবর, ২০১৯: মারাদোনা-মেসির দেশ ফেরে বামপন্থা-ঘেঁষা পেরনবাদী প্রগতিশীলতায়। লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ আর্জেন্টিনায় এই নির্বাচন ছিল নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক গণভোট। ‘মডারেট’ পেরনবাদী আলবার্তো ফার্নান্ডেজ পরাস্ত করেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি মাউরিসিও মাকরিকে। মাসের মাঝামাঝি, চতুর্থবারের জন্য বলিভিয়ায় নির্বাচিত হন বামপন্থী নেতা ইভো মোরালেস। যদিও, কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন মদতে সেনা অভ্যুত্থানে অপসারিত হন মোরালেস। ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ নেন প্রথমে লোপেজের মেক্সিকোয়, পরে ফার্নান্ডেজের আর্জেন্টিনায়।
অক্টোবর, ২০২০: বলিভিয়ায় সেনা অভ্যুত্থান থেকে গণ অভ্যুত্থান। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় চোয়ালচাপা লড়াই শেষে এক দুর্দান্ত জয়। বলিভিয়া ফেরে বামপন্থায়। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় ২৬.২৭ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজমের (এমএএস) প্রার্থী লুইস আরসে। সেদিন এই জয় শুধু বলিভিয়ার জন্য নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একইসঙ্গে, তা ছিল এই অঞ্চলে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থানের সাম্প্রতিক প্রবণতার জন্য এক বড় ধাক্কা। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক সপাটে আঘাত।
গত দশকের গোড়ায় লাতিন আমেরিকা জুড়ে ‘গোলাপী স্রোতে’র যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, বলিভিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর মধ্যে তার ফিরে আসার লক্ষণ ছিল স্পষ্ট। পরের নির্বাচনগুলি দেখেছে বামপন্থীদের তাক লাগিয়ে দেওয়া জয়।
জুলাই, ২০২১। দু’শ বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে এই প্রথম পেরুতে নির্বাচিত হন একজন বামপন্থী রাষ্ট্রপতি। এই প্রথম, পেরু নির্বাচিত করে আন্দিজের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানকে। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিও শুধু দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতিই নন, প্রথম কৃষক রাষ্ট্রপতিও। একসময় রাজধানী লিমায় কাগজ ফিরি করতেন। কখনও বিক্রি করতেন আইসক্রিম। আবার কখনও হোটেলের শৌচাগার সাফাইয়ের কাজ।
নভেম্বর, ২০২১: মুক্ত হন্ডুরাস! ফেরে বামপন্থায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয়ী হন বামপন্থী প্রার্থী আরেক কাস্ত্রো। জিয়োমারা কাস্ত্রো। দেশের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। ৬২-বছরের কাস্ত্রোর স্বামী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া। বারো-বছর আগে মার্কিন মদতে সামরিক অভ্যুত্থানে যাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল।
এই সময়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়ার অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেও ব্যর্থ হয়েছে ওয়াশিংটন। নভেম্বরে নিকারাগুয়াতে বিপুল ভোটে জয়ী হয় মার্কসবাদী সান্দিনিস্তা সরকার। ৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থবারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন একসময়ের গেরিলা, ফিদেলের বিশ্বস্ত অনুগামী সান্দিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা দানিয়েল ওর্তেগা। অন্যদিকে, রাজধানী কারাকাসের মেয়র-সহ ভেনেজুয়েলার ২৩টি প্রদেশের ১৭টিতেই গভর্নর পদে জয়ী হয় সাভেজের দল পিএসইউভি। ৩৩৫টি শহরের মধ্যে ২০৫টিতে জয়ী হয় সাভেজপন্থী ‘সাভিস্তা’রা। ঘটনা হল, ২০০৭ সালের পর এই প্রথম বিরোধী দলগুলির অধিকাংশ, এমনকি মার্কিন মদতপুষ্ট দলগুলিও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
আর বছর শেষে, ডিসেম্বরে নব্য ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে চিলিতে জয় মধ্য-বামপন্থার। ‘চিলির বোলসোনারো’ উগ্র দক্ষিণপন্থী নয়া নাৎসী প্রার্থী আন্তোনিও কাস্ত’কে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থিত অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি’র প্রার্থী গ্যাব্রিয়েল বোরিক।
এই সময়ে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের বৃহত্তর জোট, আর শহরের গরির-মধ্যবিত্তের তুমুল লড়াই সংগ্রাম থেকে এসেছে একের পর এক এই তাৎপর্যপূর্ণ জয়। ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকাকেও তাদের ‘আজকের বিশ্ববীক্ষা’য় বলতে হয়েছে, এই শতকের প্রথম দশকের ‘গোলাপী স্রোতে’র ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। সংবাদ সংস্থা এএফপি’র শিরোনাম: ‘লাতিন আমেরিকার ভোটারদের চাহিদা হল: পরিবর্তন।’ ডাচ বহুজাতিক ব্যাঙ্ক আইএনজি’র গবেষণাপত্রের অকপট বিশ্লেষণ: ‘২০২১ সালে, লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেখেছে বামপন্থার প্রতি এক নির্ণায়ক পরিবর্তন।’
কলম্বিয়া এবং ব্রাজিলের নির্বাচনের কথা মনে রেখে ২০২২ সালের জন্য তাদের পূর্বাভাস ছিল,‘ এটি হতে চলেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বছর’ এবং ‘হারতে চলেছে শাসক দক্ষিণপন্থী দলগুলি’।
যদিও, ভেনেজুয়েলায় উগো সাভেজের জয়ের পরে এই শতকের প্রথম দশকে ‘গোলাপী স্রোতে’র সময়ে যে পরিস্থিতি ছিল, বামপন্থী ও মধ্য-বামপন্থীদের নির্বাচনী জয়গুলির এই সাম্প্রতিক ‘স্রোত’ তার দর্পণ নয়। সেসময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখ ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। জিনিসের দাম ছিল চড়া। লাতিন আমেরিকার সাধারণ মেজাজ ছিল অতীতের সামরিক ও নয়া উদার জমানার বিরুদ্ধে। সাভেজের বলিভারিয়বাদে ছিল আঞ্চলিক ঐক্যের সঙ্গে এই গোলার্ধের গভীর সামাজিক সমস্যাগুলি মোকাবিলার সুলুকসন্ধান। উত্তর অতলান্তিকের পুঁজির বাজার আর মার্কিন সামরিক উপস্থিতির নির্ভরতা থেকে বেরতে না পারলে ক্ষুধার অবসান যে অসম্ভব, সে নিয়ে ছিল সাধারণ সহমত। বলিভারিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভেনেজুয়েলা থেকে আর্জেন্টিনায় নিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা বৃহত্তর সামাজিক কর্মসূচির চেহারা।
তবে, সাম্প্রতিক নির্বাচনী জয়গুলি যে পরিস্থিতিতে আসছে, তা এই শতকের শুরুর তুলনায় অনেক বেশি অনিশ্চিত। একদিকে, আগের তুলনায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দৃশ্যতই অনেকটা নাজুক, মার্কিন অর্থনীতিতেও নিস্তেজ ভাবের লক্ষণ স্পষ্ট, চীন ও রাশিয়াকে দুর্বল করতে ওয়াশিংটনের মরিয়া চেষ্টার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মার্কিন নির্দেশ মেনে না চলার মেজাজ। বিদেশনীতির প্রশ্নে মেক্সিকোর লোপেজের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার সঙ্গেই লাতিন আমেরিকায় যেমন এক নতুন উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, তেমনই তা প্রকাশ পাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়ায়। অন্যদিকে, বিশ্বায়িত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্কট, ধারে মাল কেনা-বেচা ও ঋণের ফাঁদের সমস্যা, ওয়াশিংটনের হুমকির মুখে বেশ কয়েকটি দেশের সরকার সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করা থেকে বিরত থাকছে। চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের চাপিয়ে দেওয়া ঠাণ্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ সাধারণভাবে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করছে। সেকারণে দেখা যাচ্ছে না বলিভারিয়বাদের দ্বিতীয় পর্যায়। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, চিলি, কিংবা মেক্সিকো— মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণ মদতে শাসকশ্রেণীর হাতেই রয়েছে অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ।
যেমন চিলিতে, গ্যাব্রিয়েল বোরিকের নেতৃত্বে মধ্য-বাম সরকার তামার খনিগুলির জাতীয়করণের কথা বললেও, তা রয়েছে দেশের শক্তিশালী বুর্জোয়াদের হাতে। এবছর, রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দের নেতৃত্বে তামার খনিগুলির জাতীয়করণের পঞ্চাশতম বার্ষিকী, যে সরকারকে তার পরের বছরই অপসারিত করা হয়েছিল মার্কিন মদতে সেনা অভ্যুত্থানে।
কলম্বিয়ায় পেত্রোর সামনেও রয়েছে অনেক বাধা। শক্ত চ্যালেঞ্জ। কলম্বিয়ার নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে রয়েছে আধা সামরিক গোষ্ঠীগুলির নিবিড় সম্পর্ক, যাদের শিকার হতে হয়েছে হাজারো নিরাপরাধ সাধারণ মানুষকে, যারা প্রকাশ্যে পেত্রোর বিরোধিতা করে এসেছে। নির্বাচনের সময় কলম্বিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল এদুয়ার্দো জাপাতিরো রীতিমতো টুইট করে পেত্রোর বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছিলেন। লঙ্ঘন করেছিলেন দেশের আইনকে, যে আইনে দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না সামরিক কর্তারা। পেত্রোর জয়ের পর সশস্ত্র বাহিনী জানিয়ে দিয়েছে তারা কোনও রকম মৌলিক সংস্কার বরদাস্ত করবে না। পেত্রোর শপথ আটকাতে জাপাতিরো জুলাইয়ের শেষে পদত্যাগ করেছেন। এই হল মনোভাব!
তাছাড়া, ব্যয়সঙ্কোচের নীতি এবং সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহ্যের কারণে এই গোলার্ধের শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকরা তুলনায় টুকরো-টুকরো এবং অসংগঠিত।
ফলে পেরুতে বামপন্থা-ঘেঁষা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও, তাঁকে প্রতিদিন বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। সংগঠিত শক্তির সমর্থন তিনি পাননি। প্রতিশ্রুতি থেকে সরেছেন। কাস্তিওকে মোকাবিলা করতে হয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষির চ্যালেঞ্জ। ‘নতুন দেশ’ হিসেবে পেরুর পুনর্জন্মের জন্য কাস্তিওকে লড়তে হয়েছে গেঁড়ে বসা শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্রযন্ত্রে তাদের বিভিন্ন শাখার বিরুদ্ধে। লড়তে হয়েছে মিডিয়ার একপেশে কুৎসা প্রচারের বিরুদ্ধে। সংসদ, যার সংখ্যাগরিষ্ঠ তাঁর বিরুদ্ধে। ১৩০-সদস্যের সংসদে তাঁর দলের সদস্যের সংখ্যা সাকুল্যে ৩৭। কাস্তিও’র কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তারা, যাঁরা বিদ্রোহের হুমকি দিয়েছিলেন। দেড়-বছরে তাঁকে তিনবার সংসদে ভর্ৎসনা প্রস্তাবের মুখে পড়তে হয়েছে। চার-চারবার মন্ত্রিসভা রদবদল করতে হয়েছে। পরিবর্তন করতে হয়েছে ৭২ জন মন্ত্রীকে। এবং শেষে নিজেই অপসারিত। আপতত জেলে বন্দি। আদালত দেড় বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে। নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি দিনা বলুয়ার্ত, যিনি কাস্তিওর সময় ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি। শপথ নিয়েই তিনি মার্কিন বিদেশসচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন।
৭ ডিসেম্বর: পেরুতে অভ্যুত্থান। তৃতীয়বার আনা ভর্ৎসনা প্রস্তাব আটকাতে ওইদিন শেষ চেষ্টা করেন কাস্তিও। সাময়িক সময়ের জন্য প্রতিক্রিয়াশীল সংসদ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন। নতুন সংবিধান লেখার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন আইনসভা গঠনের ডাক দেন। পেরুর সাংবিধানিক আদালত যখন তার সমালোচনা করে, তখন তাঁর সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়, কাস্তিও’র পদক্ষেপকে বলে ‘অভ্যুত্থানের চেষ্টা’। কাস্তিও ও তাঁর পরিবার মেক্সিকোর দূতাবাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু পথেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পেরুর সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের (জুলাই, ২০২১) পর থেকেই কাস্তিওর প্রতিদ্বন্দ্বী কেইকো ফুজিমোরি এবং তাঁর সহযোগীরা তিনি যাতে রাষ্ট্রপতি হতে না পারেন, তার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। ফুজিমোরি এমন লোকেদের সঙ্গে কাজ করেছেন, যাদের সঙ্গে মার্কিন সরকার এবং তার গোয়েন্দা সংস্থার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যেমন, ফুজিমোরি-টিমের একজন সদস্য ফার্নান্দো রোসপিগ্লিওসি ২০০৫ সালে ওলান্তা হুমালার বিরুদ্ধে লিমায় মার্কিন দূতাবাসকে জড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, যিনি ২০০৬ সালের পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। একসময় সিআইএ’র এজেন্ট ভ্লাদিমিরো মন্টেসিনোস, যিনি এখন রয়েছেন পেরুর একটি জেলে, পেরুর সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন কমান্ডার পেদ্রো রেজাসকে ‘মার্কিন দূতাবাসে যেতে এবং দূতাবাসের গোয়েন্দা কর্তার সঙ্গে কথা বলতে’ বার্তা পাঠিয়েছিলেন ২০২১ সালের পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলার জন্য। নির্বাচনের ঠিক আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেরুতে তার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করে একজন প্রাক্তন সিআইএ এজেন্ট লিসা কেননাকে। এই ৬ ডিসেম্বর তিনি পেরুর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গুস্তাভো ববিওর সঙ্গে দেখা করেন। এবং পরের দিন সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য কাস্তিওর পদক্ষেপের বিরুদ্ধে টুইট করেন। আর কাস্তিও’র অপসারণের পর দেরি না করে পেরুর নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেন। যথারীতি নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে ব্রিটিশ ইকনমিস্ট ‘অভ্যুত্থানের চেষ্টা’র জন্য একতরফাভাবে দায়ী করে কাস্তিওকে, ঘটনা হল তাঁর শত্রুরাই কাস্তিওর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে, ২০২১ সালে তাঁর নির্বাচনে জেতার আগে থেকে। ভেনেজুয়লার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো বলেন, দক্ষিণপন্থীরা আসলে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে: ‘আমরা তোমার সরকার চালানো মোটেই বরদাস্ত করব না।’
কাস্তিওর দুর্বলতা কোথায়? দক্ষিণপন্থীরা যখন তাকে হটাতে এককাট্টা, তখন তিনি সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি রাস্তা থেকে তোলেননি। সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে হয়নি কোনও মিছিল-সমাবেশ। কাস্তিওর সবচেয়ে বড় ভুল তিনি বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বোঝাপড়া করে তাদের সাহায্য-সমর্থন নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন। শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে নয়, যাঁরা তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিলেন। এই ঘটনা লাতিন আমেরিকার জন্য একটি বড় শিক্ষা: তুমি সরকারে আসতে পারো, কিন্তু তার অর্থ রাষ্ট্র ক্ষমতায় নয়।
যেমন ব্রাজিলে লুলার জয়। রুদ্ধশ্বাস হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে শেষে জিতেছেন লুইস ইনাসিয়ো ‘লুলা’ দা সিলভা। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে এই জয়কে স্বাগত জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। এটা ঠিক, উগ্র দক্ষিণপন্থী জেইর বোলসোনারোর এই পরাজয়ের প্রভাব ভবিষ্যতে পড়বে ব্রাজিল-সহ গোটা লাতিন আমেরিকায়। আবার এও ঠিক, লুলার সঙ্গে বোলসোনারোর ভোটের ফারাক ২ শতাংশেরও কম।
লুলা জিতে রাষ্ট্রপতি হলেও তাঁকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেবে না দক্ষিণপন্থীরা। সেনেট ও কংগ্রেসে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা দক্ষিণপন্থীরা প্রতি মুহূর্তে বাধা দেবে তাঁর জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণে। সামাজিক সম্পদ বন্টনে বৈষম্য অপসারণের নীতি তারা মানবে না।
ব্রাজিলের ২৭টি রাজ্যের মধ্যে বোলসোনারো জিতেছেন ১৪টিতে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গেই ছিল রাজ্যগুলির গভর্নর এবং আইনসভার ভোট। আর এর প্রতিটি ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থীরা তাঁদের শক্তি বারিয়েছে। গভর্নর নির্বাচনে ১১টিতে জিতেছেন বোলসোনারোর প্রার্থী। মাত্র ৮টিতে লুলার প্রার্থী। সবচেয়ে বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ মিনাস গেরাইস, রিও ডি জেনিরো এবং সাও পাওলো— ২০২৩ থেকে শাসন করবে বোলসোনারোর দল। সাও পাওলো মানে, যার জনসংখ্যা প্রায় আর্জেন্টিনার সমান, জিডিপি কলম্বিয়ার চেয়ে বেশি।
ব্রাজিলের সংসদের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভায় দক্ষিণপন্থীদের আসন সংখ্যা ২৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪৯। ৫১৩-আসনের সংসদে অর্ধেকের চেয়ে সামান্য কম। জিতেছেন বোলসোনারোর প্রাক্তন তিন মন্ত্রী। অন্যদিকে, লুলার ওয়ার্কার্স পার্টি ও শরিকদের মিলিয়ে আসন সংখ্যা সাকুল্যে ১৪১। অন্যদিকে সেনেটে জিতেছেন বোলসোনারোর প্রাক্তন পাঁচ মন্ত্রী, যেখানে বোলসোনারোর লিবারেল পার্টি বৃহত্তম ব্লক। আইনসভায় দক্ষিণপন্থীদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বের কারণে লুলার পক্ষে তাঁর নীতি রূপায়নের কাজ শক্ত হবে। তাঁকে মধ্যপন্থীদের সমর্থন নিতে হবে। কিছু আপস, কিছু বোঝাপড়া করতে হবে।
নির্বাচনে জয়ের জন্য ইতিমধ্যেই কিছু আপস করেছেন লুলা। গির্জার ধর্মপ্রচারকদের প্রচারের মোকাবিলায় তিনিও বক্তৃতায় ধর্মশাস্ত্র, ঈশ্বরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। লুলার উপরাষ্ট্রপতি জেরাল্ডো অ্যালকম্যান একসময় ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, মধ্যপন্থী দলের নেতা। লুলার বিরুদ্ধে প্রথম রাউন্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন যে সাইমন টিবেট, তিনিই দ্বিতীয় রাউন্ডে লুলার হয়ে প্রচার করেছেন, সম্ভবত লুলার মন্ত্রিসভায় জায়গা পাচ্ছেন। লুলার জোটে রয়েছে কমিউনিস্টরা-সহ সোস্যালিস্ট থেকে উদারবাদী-বুর্জোয়ারা। সকলে একজোট হয়েছেন একটি সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে— গণতন্ত্র রক্ষা, উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থানকে প্রতিহত করা, আমাজন অরণ্যের সুরক্ষা এবং পরিবেশকে বাঁচাতে।
বোলসোনারো হেরে গেলেও, তিনি যে পরিমাণ ভোট পেয়েছেন, তাতে স্পষ্ট দক্ষিণপন্থা কীভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে জেঁকে বসে আছে। লুলা যদি তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ না করতে পারেন, গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের জীবনজীবিকা পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র মোকাবিলায় পদক্ষেপ না নেন, তবে দক্ষিণপন্থার বিপদকে মুছে ফেলা যাবে না।
পাশাপাশি, আর্জেন্টিনায় বাড়ছে সংকট। উগ্র দক্ষিণপন্থী, নয়া উদারবাদী, ওয়াশিংটনপন্থী মাউরিসিও মাকরিকে পরাস্ত করে ২০১৯ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মধ্য-বামপন্থী আলবার্তো ফার্নান্ডেজ, যাঁর উপরাষ্ট্রপতি ক্রিস্টিনা কির্চনার, যিনি একসময় ছিলেন রাষ্ট্রপতি। ক্রিস্টিনা যেহেতু একসময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি নেস্টর কির্চনারের স্ত্রী, সাধারণ মেহনতি মানুষ তাঁকে রাষ্ট্রপতির চেয়েও বড় করে দেখেন, তাঁর প্রগতিশীল ও সার্বভৌম নীতির জন্য। আর সেকারণেই আর্জেন্টিনার শাসকশ্রেণীর রাজনীতিকদের লক্ষ্য তিনি। আর তাই তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়ো অভিযোগ, তথাকথিত ‘আইনি যুদ্ধ’।
‘আইনি যুদ্ধ’ মানে লাতিন আমেরিকার দেশে-দেশে অভিজাতরা ক্রিস্টিনা কির্চনারের মতো জনপ্রিয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে আইন, আদালত ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিচারপতিদের। এবং বামপন্থী ও প্রগতিশীল নেতৃত্বকে অপসারিত করছে রাষ্ট্রপতি থেকে, পারলে পুরে দিচ্ছে জেলে। ৬ ডিসেম্বর ক্রিস্টিনা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ছ’বছরের জেল হয়েছে। তবে তিনি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। করেছেনও।
তথাকথিত এই ‘আইনি যুদ্ধের’ ব্যাপক প্রভাব দেখেছে ব্রাজিল। রাষ্ট্রপতি দিলমা রুসেফকে হটাতে ২০১৬-তে ব্যবহার করা হয়েছিল এই আইনি যুদ্ধ। পরে লুলার ক্ষেত্রেও তা ব্যবহার করা হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনে, যে নির্বাচনে লুলা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি, থাকতে হয়েছিল জেলে। জিতে গিয়েছিলেন বোলসোনারো। এই আইনি যুদ্ধই ছিল ইকুয়েদরে বামপন্থীদের দমনপীড়নের মুখ্য অস্ত্র। যেমন পশ্চিমরঙ্গে, ২০১১ সালের ভুয়ো
মামলায় হাজার হাজার বামপন্থী কর্মীদের জেলে পোরা হয়েছে।
দক্ষিণপন্থীরা তৎপর মেক্সিকোতেও। রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোরের বিরুদ্ধে তুলে চলেছে একেবারে ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ। পরিস্থিতি আঁচ করে লোপেজ ও তাঁর মোরনো পার্টি গণসমাবেশের ডাক দেয় ২৭ নভেম্বর। মেক্সিকো সিটির জোকালো স্কোয়ারে তাঁর সরকারের প্রগতিশীল সংস্কারমূলক পদক্ষেপের সমর্থনে জড়ো হন ১২ লক্ষের বেশি মানুষ।
গণপ্রতিবাদ লোপেজের কর্মসূচির জয়কে নিশ্চিত না করলেও, এটা বলা যায় অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র এবং আইনি যুদ্ধের ছকের বিরুদ্ধে তাঁর হাতকে এই সমাবেশ শক্তিশালী করবে।
বলিভিয়ার কথাই ভাবুন। ২০১৯’র বসন্ত। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিত্তশালী ১ শতাংশ হটিয়ে দেয় নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইভো মোরালেসকে। কিন্তু গরিব শ্রমজীবী মানুষ পিছু হটেননি। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বছরভর দুর্বার গণআন্দোলেনের চাপে শেষে হয়েছে নতুন নির্বাচন। এবং ২০২০-তে নির্বাচিত হয়েছে মোরালেসের দল। কিংবা ব্রাজিল। তুমুল গণআন্দোলনের চাপে শেষে লুলার প্রত্যাবর্তন।
তবে, নির্বাচনে জয় আর রাষ্ট্রক্ষমতা এক নয়।
রাষ্ট্র ও বিপ্লব সংক্রান্ত পুস্তিকায় মার্কসের উদ্ধৃতি দিয়ে লেনিন দেখিয়েছেন শ্রেণীশাসনের পরিবর্তনে নির্বাচনী জয়ের সীমাবদ্ধতা: ‘‘বিশেষ করে মনোযোগ দেওয়া উচিত মার্কসের অত্যন্ত গভীর মন্তব্যের প্রতি যে আমলাতান্ত্রিক-সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংসই হল ‘প্রত্যেকটি প্রকৃত জনগণের বিপ্লবের পূর্বশর্ত’।’’
একটি নির্বাচন শ্রমিকশ্রেণী ও গরিব মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার আভাস দিতে পারে— নির্বাচন দেখাতে পারে মানুষ কী চান— যদিও মনে রাখা দরকার, এটি অর্থের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের প্রভাব দ্বারা সীমাবদ্ধ। একটি নির্বাচনে পুঁজিবাদ-বিরোধী জনমত থাকা সত্ত্বেও পুলিশ, আদালত এবং সেনাবাহিনী একটি পুঁজিবাদী শাসন চাপিয়ে দিতে পারে। যেমন আবার একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ প্রকৃত অর্থে ক্ষমতা গ্রহণ না করেও দায়িত্বে থাকতে পারেন।
একমাত্র গণজমায়েত নিরুৎসাহিত করতে পারে রাষ্ট্রের সশস্ত্র সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করা ষড়যন্ত্রীদের একটি ছোট গ্রুপের বেআইনি কাজকে। কিন্তু জনগণ সশস্ত্র ও সংগঠিত না হলে তাদের সুরক্ষায় থাকে অনিশ্চয়তা।
এটা ঠিক মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াতে বামপন্থী প্রার্থীদের নির্বাচনী জয় যথেষ্টই উৎসাহব্যঞ্জক। আবার এও ঠিক, সাম্রাজ্যবাদ এবং তার স্থানীয় অভিজাত জুনিয়র পার্টনাররা রয়ে গিয়েছে একটি বিপজ্জনক হুমকি হিসেবে। এবং বেশিরভাগ দেশেই রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। এক মুহূর্তের জন্য একে ভোলা হবে বড় ভ্রান্তি। বিপরীতে রয়েছে কিউবার উদাহরণ, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর হাতে। সেকারণে জনগণের উপর ওয়াশিংটনের বর্বর নিষেধাজ্ঞা এবং অবরোধ সত্ত্বেও, সেখানে তারা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করে চলেছে তাদের উৎখাত করার সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত।
চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে রয়েছে একটি সত্যিকারের সম্ভাবনা। নয়া উদারবাদের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বিকল্প নির্মাণ। নয়া উদারবাদের বিরোধিতা থেকে নয়া উদারবাদ-উত্তর মডেল নির্মাণ। যদিও কাজটা সহজ নয়। দু’টি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক মডেলের সংঘাত অনিবার্য। একদিকে নয়া উদারবাদ, অল্প কিছু মানুষের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভবন, সামাজিক খাতে বরাদ্দে তাচ্ছিল্য, অন্যদিকে প্রগতিশীল কর্মসূচি, যেখানে উন্নয়নের কেন্দ্রে জনগণ। আর এই চ্যালেঞ্জের মুখে ঐক্য নির্মাণে ব্রতী লাতিন আমেরিকা।
কলম্বিয়া এবং ভেনেজুয়েলা প্রতিবেশী দুই দেশ ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে দুই দেশ তাঁদের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে। সন্ত্রাসবাদে মদতদাতা রাষ্ট্রের মার্কিন তালিকায় কিউবাকে রাখার বিরোধিতা করেছে কলম্বিয়া।
বামপন্থী শক্তিগুলি আবারও তাদের আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংহত করার কাজ শুরু করেছে। যেমন সেলাক। ২০১০ সালে তৈরি এই ব্লকটিতে ধীরে হলেও রাজনৈতিক ঐক্য নির্মাণের প্রয়াস শুরু হয়েছে। যার অন্যতম নেতা মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি লোপেজ ওব্রাডোর মার্কিন নিয়ন্ত্রিত অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)-র পরিবর্তে সেলাককে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। সম্প্রতি হাভানায় আলবার বৈঠকে রাষ্ট্রপ্রধানরা ঐক্য জোরদারে অঙ্গীকার করেছেন। জুনের গোড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেসে অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)-র শীর্ষ বৈঠক বয়কট করেন মেক্সিকো, বলিভিয়া, হন্ডুরাস এবং গুয়েতামালার রাষ্ট্রপতি। ক্যারিবিয়ান কমিউনিটির বেশকিছু দেশও এই বয়কটে যোগ দেয়। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়াকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণেই ছিল এই প্রতিবাদ। এদিকে, ডলারিকরণের মোকাবিলায় অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে লুলা চাইছেন লাতিন আমেরিকার এক এবং অভিন্ন একটি ডিজিটাল মুদ্রা। যা গোটা মহাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সঙ্গে গোটা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে বাড়বে একতাও।