বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
ধনকুবেরদের বিলাসবহুল প্রাসাদ লেনিহান আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। অসহায় অবস্থায় পড়িমরি পালাতে হচ্ছে সেসব প্রাসাদের অধিবাসীদের। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না দমকল কর্মীরা এবং আগুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য সম্প্রতি দেখেছে বিশ্ববাসী। অকুস্থল উত্তর আমেরিকার লস এঞ্জেলস। আগুন লেগেছে বনে-বনে। ঘটনা বহু আলোচিত, পুনরাবৃত্তি বাহুল্য। ঘটনার কার্যকারণ বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করছে বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে। ট্র্যাজেডি এই যে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীজুড়ে উঠলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে তার কোনও মান্যতা নেই। প্রসঙ্গত আরও বলা যায় মাথাপিছু গ্রীন হাউজ গ্যাস কার্বন ডাই অক্সাইড নি:সরণে আমেরিকা এক নম্বরে। আমেরিকান পেট্রোডলার অশ্বমেধের ঘোড়া হয়ে সারা পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই, প্রধানত অটোমোবাইলের জ্বালানী হিসাবে। পরে মিলিটারি ইন্ড্রাসটিয়াল কমপ্লেক্স, নগরায়ন ও বৃহদাকার ডেয়ারি শিল্পের প্রয়োজন মেটাতে অরণ্য ধ্বংস এই কাজে হাত মিলিয়েছে।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিপালিকান রোনাল্ড রেগন এবং ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামা দু’জনই আমেরিকার জনগণকে জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ জীবন উপহার দিয়েছেন বলে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিলেন। বিশ্বজনমতের চাপে অবশ্য ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন দেশের ভিতর ও বাইরে পৃথিবী জুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের চাপে বিশ্ব-উষ্ণায়ন কমাতে ‘প্যারিস চুক্তি’তে স্বাক্ষর করতে হয়। আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট তার শাসনের বিগত পর্বে এই চুক্তি ছিন্ন করেন, বেরিয়ে আসেন বিশ্বমঞ্চ থেকে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট, রিপালিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষ্যে বিশ্ব-উষ্ণায়ন একটি ‘প্রতারণা' ( Hoax)।
বিশ্ব-উষ্ণায়ন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ বিতর্কিত। তাঁর প্রথমবারের শাসনকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি পরিবেশগত নিয়মকানুনও শিথিল করেন এই প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে বিশ্ব উষ্ণায়নের অস্তিত্ব ও তীব্রতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন যে জলবায়ু পরিবর্তন মানব কার্যকলাপের কারণে হচ্ছে না। এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেন যে বিজ্ঞানীরা পূর্বে ‘গ্লোবাল কুলিং’ বা বিশ্ব শীতলায়নের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এবং তাঁর মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাটি বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত নয়।
তবে, অধিকাংশ আমেরিকান বিশ্ব-উষ্ণায়নের মানবসৃষ্ট কারণগুলিতে বিশ্বাসী। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৩% উত্তরদাতা মনে করেন বিশ্ব-উষ্ণায়ন ঘটছে এবং ৬০% মনে করেন এটি মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলেই হচ্ছে। ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান সত্ত্বেও, অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বনেতা জলবায়ু সংকট মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল (IPCC) সতর্ক করেছে যে, শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ের তুলনায় ১.৫°C-এর মধ্যে বিশ্ব-উষ্ণায়ন সীমিত রাখতে হলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে উল্লেখযোগ্য হ্রাস দরকার।
“কিছুই বদলাবে না, যতক্ষণ না আমাদের রাগ যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু একবার যখন তুমি ক্ষতির নির্মম সত্য গ্রহণ করবে, এবং বুঝতে পারবে কারা এই ক্ষতির জন্য দায়ী ও কারা তাতে লাভবান হয়েছে, তখন সেই রাগ ধেয়ে আসবে সান্তা আনা বাতাসের মতো তীব্র, অপ্রতিরোধ্য”। উদ্ধৃতিটি জলবায়ু বিজ্ঞানী পিটার কালমাসের। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত “I'm a Climate Scientist. I Fled Los Angeles Two Years Ago” শীর্ষক প্রবন্ধে কালমাস লিখেছেন। এই প্রবন্ধে, কালমাস বর্ণনা করেছেন কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লস অ্যাঞ্জেলেসে ক্রমবর্ধমান দাবানল এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাকে শহরটি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। “দুই বছর আগে আমি আমার পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছিলাম কারণ ক্যালিফোর্নিয়ার জলবায়ু আরও শুষ্ক, গরম এবং দাহ্য হয়ে উঠছিল, আমি ভেবেছিলাম আমাদের এলাকাটি পুড়ে যাবে। কিন্তু আমি নিজেও ভাবিনি যে এই পরিমাণ এবং তীব্রতার অগ্নিকাণ্ড এত দ্রুত আমার এলাকা এবং শহরের অন্যান্য বৃহত্তর অংশগুলোকে ধ্বংস করবে। তবুও, এই সপ্তাহে আলটাডেনার ছবি একটি দুঃস্বপ্নের দৃশ্য প্রদর্শন করছে, যেন অক্টাভিয়া বাটলারের অসাধারণভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা উপন্যাস ‘পারাবল অফ দ্য সাওয়ার’-এর একটি দৃশ্য”।
পিটার কালমাস তাঁর এই লেখায় স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পের প্রধানরা কয়েক দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু তারা ক্রমাগত বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন এবং পরিচ্ছন্ন শক্তিতে নির্ভরতা বৃদ্ধির কাজে বাধা দিয়েই গেছেন।
এক্সন মোবাইল এই পেট্রোলিয়াম কর্পোরেট সংস্থাটি বহুবছর আগেই বৈদ্যুতিক ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরি করতে সমর্থ হয়। যদিও পেট্রোল ব্যবসার স্বার্থে তারা সবকিছু গোপনে রাখে। এখন সবকিছু স্পষ্ট। বিশ্ব-উষ্ণায়ন লাগামছাড়া বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে এখন একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে সবকিছু কতটা খারাপ হবে, তা নির্ভর করছে আমরা কতদিন পর্যন্ত জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছি তার ওপর।
তেল, গ্যাস ও কয়লা কোম্পানিগুলো অর্ধশতক ধরে জানে যে তারা পৃথিবীর অপরিবর্তনীয় জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করছে। কিন্তু তাদের পরিচালকরা, প্রচারকরা এবং আইনজীবীরা বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির দিকে পরিবর্তন বাধাগ্রস্ত করার পথ বেছে নিয়েছে। এই সমস্ত কর্পোরেটরা তাদের বিশাল সম্পদ ব্যবহার করে দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করে। কর্পোরেট বন্ধু ট্রাম্পের জমানায় তেল-গ্যাস লবির দৌরাত্ম বাড়বে বৈ কমবে না। দুর্নীতি এই ব্যবস্থারই অঙ্গশোভা। কালমাসের মতে, এই সত্যগুলো মেনে নেওয়ার পর মানুষের মধ্যে যে রাগ সৃষ্টি হয়, তা সান্তা আনা বাতাসের মতোই তীব্র যা আবার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার “সান্তা আনা” বাতাস সাধারণত শীতকালে প্রবাহিত হয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রবাহ সময় ও তীব্রতা বেড়েছে। এই বাতাসের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে, যা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।
২০২৪ সালের দাবানল এই বাতাসের কারণে দ্রুত শহরতলি ও আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল জঙ্গল ধ্বংসের সঙ্গে সেই আগুনে পুড়েছে প্রাসাদোপম অট্টালিকা, কোটিপতির আবাসসহ ঝাঁ-চকচকে শহরের বিলাসবহুল হোটেল, মাল্টিপ্লেক্স, ক্যাফেটেরিয়া। হলিউড, যেখানে তৈরি হয়েছে এই ধরণের অ্যাপোকালাপসির চলচ্চিত্র তা নিজেই আজ ধ্বংসের স্থিরচিত্র।
লস অ্যাঞ্জেলেসসহ ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দাবানল এক দীর্ঘকালীন সমস্যা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দাবানলের সংখ্যা, তীব্রতা ও ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূলত বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। ক্রমবর্ধমান বিশ্ব তাপমাত্রার কারণে ক্যালিফোর্নিয়া দীর্ঘমেয়াদী খরার সম্মুখীন হচ্ছে। ২০২৪ সালে, অক্টোবর পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেসে মাত্র ০.১৬ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা গড় ৪.১৬ ইঞ্চির তুলনায় অনেকটাই কম। দীর্ঘস্থায়ী শুষ্ক আবহাওয়া উদ্ভিদকে দাহ্য জ্বালানিতে পরিণত করে। দাবানলের ঝুঁকি বাড়ে।
গত এক শতাব্দীতে ক্যালিফোর্নিয়ার গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.৫°C (২.৭°F) বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে, লস অ্যাঞ্জেলেসের কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৩°C (১১০°F) ছাড়িয়ে গেছে।
এই উচ্চ তাপমাত্রায় বাষ্পীভবন বেড়ে যায়, ফলে উদ্ভিদ আরও শুকিয়ে যায় এবং সহজ দাহ্যে পরিণত হয় ।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ভেতরের মরুভূমি থেকে আসা শুষ্ক, উষ্ণ বাতাস (আনা সান্তানা) দাবানলকে আরও তীব্র করে তোলে ও সহজেই দাবানলকে চর্তুদিকে ছড়িয়ে দেয়। বিশ্ব-উষ্ণায়ন বাতাসের প্রবাহের ধরণ পরিবর্তন করেছে। বাতাস আরও অপ্রত্যাশিত ও তীব্র হয়ে উঠছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দাবানলের সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। সব দিক ঈঙ্গিত দিচ্ছে, হয়ত আমেরিকার এই অঞ্চলে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের কারণগুলি ‘টিপিং পয়েন্ট’ অতিক্রম করে গেছে বা করে যাচ্ছে। যার মানে অনতিবিলম্বে অপরিবর্তনীয় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
কর্পোরেট স্বার্থে আমেরিকান রাষ্ট্র প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লস এঞ্জেলসের দাবানল একে আরো স্পষ্ট করেছে। আপাতভাবে মনে হচ্ছে সবকিছু আমেরিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের জায়গায় আছে। ট্রাম্পের পুনরাবির্ভাব এই ভাবনাকে জোরদার করেছে। সমস্ত দিক থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী মনোভাবকে শুধু জাগিয়ে তোলা হচ্ছে যে তাই নয়, এটাও দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে যে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আমেরিকার স্বার্থবিরোধী কাজ করছে ও আমেরিকান রাষ্ট্র পরিবেশকে যে কোনও মাত্রায় পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভূমিকা নিতে সক্ষম।
রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতাকে সীমান্তের বেড়াজালে পরিবেশকে আটকানোর কাজে ব্যবহার করছে। এর ফলে দ্রুত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। লস এঞ্জেলস দাবালল তারই একটি প্রকাশ। বিজ্ঞানীরা সাবধানবাণী উল্লেখ করছেন বারবার, আমেরিকার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করছেন, অথচ কর্পোরেট স্বার্থে প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য আমেরিকা রাষ্ট্রের সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে যা বিপদজনক ও বিধ্বংসী প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ। পুঁজি-প্রকৃতির এই দ্বন্দ্ব এমনভাবে গভীর রূপ নিচ্ছে যে আমেরিকার মতো দেশেও একাধিক প্রতিবাদী আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে যার মর্মবস্তুতে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা। শ্রমিক ও আদিবাসীরা অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে পরিবেশ সংক্রান্ত দাবিদাওয়াকে আন্দোলনে যুক্ত করছেন। বোঝা যাচ্ছে পরিবেশ আন্দোলন সৌখিনতার গন্ডী অতিক্রম করে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধের সঙ্গে, পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রামের সঙ্গে।