বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে এখনই নির্দিষ্ট করে কিছু বলাটা কঠিন। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প বসলে, পশ্চিম ইউরোপ, ন্যাটো জোট এবং রাশিয়া সম্পর্কে তিনি ও তাঁর প্রশাসন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চেয়ে ভিন্নতর কোনও নীতি গ্রহণ করবেন কিনা, তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। ট্রাম্প যদি বাইডেনের ইউক্রেন নীতি চালিয়ে যান, তবে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা। আবার আমেরিকার অর্থনীতির হাল ফেরানোর পথে যদি তিনি হাঁটতে চান, তাহলে তাঁকে অনেক বেশি পরিমাণে শুল্ক যুদ্ধের পথে নামতে হবে। সেটা অর্থনীতির লড়াই। এক্ষেত্রে মূলত তাঁকে মোকাবিলা করতে চীনকে। কারণ অর্থনৈতিক ফ্রন্টে চীনই এখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি অর্থনীতির দ্বন্দ্ব ও সামরিক দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে প্রথমটি, তাহলে সামরিক দ্বন্দ্ব অপ্রধান দ্বন্দ্বের জায়গায় চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, পশ্চিম ইউরোপ, ন্যাটো জোট — এসব বিষয় থেকে আপাতত দূরে থাকতে চাইতে পারেন ট্রাম্প। তখন ইউক্রেনকে ঘিরে ন্যাটো জোটের পরিকল্পনা ধাক্কা খাবে। এতে সুবিধা হবে রাশিয়ার। অন্যদিকে, পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র যেভাবে নতুন করে সাজাতে চলেছে ইজ়রায়েল, তা নিয়ে ভাবতে হবে ট্রাম্পকে। যদিও চাইলেই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না ট্রাম্প। কারণ মার্কিন দেশের অস্ত্রের কারবারীরা পশ্চিম এশিয়া ও ইউক্রেনে তাদের লাভজনক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবসা জলাঞ্জলি দিতে চাইবে না।
আবার ব্রিকসভুক্ত দেশগুলিকে ঘিরে উঠে আসছে একটা নতুন সমীকরণ। যদি চীন ও রাশিয়া ডলারের একাধিপত্য ভাঙার প্রচেষ্টায় কোমর বেঁধে নামে তাহলে মার্কিন বনাম চীন-রাশিয়ার দ্বন্দ্ব বাড়বে। তখন ট্রাম্পকে চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শুল্ক যুদ্ধ জোরদার চালাতে হবে। পাল্টা চীন ও রাশিয়া তাদের দেশের রপ্তানি বাজারকে অটুট রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিলে দু’ পক্ষের সঙ্ঘাত তীব্র হবে। এক্ষেত্রে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে মদত দেওয়ার যুক্তি আমেরিকার পক্ষে তীব্রতর হবে। একই কারণে ভারত ও তাইওয়ানকে চীনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে আমেরিকা। যদিও একইসঙ্গে রাশিয়া ও চীনকে মোকাবিলা করার কাজটা ট্রাম্প করতে চাইবেন কিনা, সেনিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। আর যদি সত্যি সত্যিই ট্রাম্প ন্যাটো সম্পর্কে ঠান্ডা মনোভাব দেখান, তাহলে বিশেষ করে জার্মানি ও ফ্রান্সের পক্ষে একার চেষ্টায় ইউক্রেনকে সামরিক মদত দেওয়া সম্ভব হবে না। এনিয়ে ন্যাটোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হলে ইউক্রেন আরও একঘরে হয়ে পড়বে যা রাশিয়ার পক্ষে অ্যাডভান্টেজ। সেকারণেই ব্রিটেনের লেবার নেতা কিয়ের স্টারমার বলেছেন, ট্রাম্প গদিতে বসলে তিনি নিজে ওয়াশিংটন গিয়ে বোঝাবেন কেন ইউক্রেনকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করা দরকার। এখানে কিয়ের স্টারমার লেবার নেতা হলেও আসলে জন মেজরের উত্তরসূরি এবং চলেন ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের কর্তাদের অঙ্গুলিহেলনে।
সব মিলিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতি কী হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্পের নীতির ওপর। ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ না করে এবিষয়ে কিছু মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। কারণ ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এখন সরলরৈখিক নয়। বরং তা জটিল এবং এর মধ্যে বহু স্বার্থের সঙ্ঘাত রয়েছে। বহুপাক্ষিক টানাপড়েনেই ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ তৃতীয় বছরে পড়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শক্তির অবস্থান বদলেছে। ২০২৪ এর গোড়ার দিকে কিয়েভ ও পশ্চিমী জোটের কৌশল ছিল, আত্মরক্ষা চালিয়ে যাওয়া এবং এভাবে শক্তিক্ষয় করে রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল করে তোলা। ইউক্রেন এটা দেখাতে চেয়েছিল যে তাদের প্রতিরোধ গড়ার শক্তি আছে। অতএব আমেরিকা ও পশ্চিমী জোট তাদের সমর্থন করুক। অন্যদিকে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সামরিক ও শক্তি পরিকাঠামো ধ্বংস করা, যাতে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে কিয়েভের কৌশল ধ্বংস হয়।
সামরিক ভাবে বিচার করলে নতুন বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই রাশিয়ার অনুকূলে।
এই যুদ্ধে দু’ পক্ষই দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হানার ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। ইউক্রেনের ভরসা ন্যাটোর সরবরাহ করা মিসাইল যার পাল্লা ১৫০০ কিমি পর্যন্ত এবং যা রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে সক্ষম। এগুলি ব্যবহার করা হয়েছে রুশ সেনার জ্বালানির ভাণ্ডার এবং মজুত গোলাবারুদ ধ্বংস করার জন্য। অন্যদিকে, মস্কোর টার্গেটে ছিল ইউক্রেনের এনার্জি গ্রিড। গত বছর এপ্রিলের মধ্যে ইউক্রেনের সাতটি প্রধান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করে রুশ মিসাইল। এতে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়ে। রাশিয়ার ড্রোন ও সুপারসনিক মিসাইল হানা কিয়েভের বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভেঙে ফেলছে। ফলে নিজেদের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে বেশি ক্ষমতা ব্যয় করতে হচ্ছে কিয়েভের শাসকদের। গত বছরের মাঝামাঝি কিয়েভের ড্রোন হানার মোকাবিলা করার ক্ষমতা জোরদার করে মস্কো। ইলেকট্রিনিক যুদ্ধে রাশিয়ার অনেক বেশি দক্ষতা কিয়েভের ড্রোন হানাকে ভোঁতা করে দেয়। তবে তারপরেও পশ্চিমী মদতে কিয়েভ প্রতিরোধ চালিয়ে যায় এবং এই যুদ্ধ শক্তিক্ষয়কারী যুদ্ধ বা ওয়ার অফ অ্যাট্রিশনে পরিণত হয়।
গ্রীষ্মকালে এসে মস্কোকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে কুরস্ক অঞ্চলে ঝটিতি হানা দিয়ে অনেকটা এলাকা দখল করে ফেলে কিয়েভ বাহিনী। তারা ভেবেছিল, কুরস্ক রক্ষা করতে ডনেৎস্ক এলাকা থেকে সেনা সরাবে রাশিয়া। সেই সুযোগে ক্রিমিয়া পুনর্দখল করে একেবার নীপার নদীর তীরে গিয়ে হাজির হবে কিয়েভের সেনা এবং মূল রুশ ভূখণ্ডে হামলা চালাবে। তবে রুশ বাহিনী সেই ফাঁদে পা দেয়নি। উল্টে অন্য জায়গা থেকে বাহিনী এনে কুরস্কে প্রতিরোধ গড়ে এবং ডনেৎস্কে পাল্টা হামলা চালিয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে ফেলে। ওদিকে কুরস্ক দখল করতে গিয়ে বহু এলিট বাহিনীকে সরিয়ে এনেছিল কিয়েভ। ফলে ডনেৎস্কে তাদের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রুশ বাহিনী এগোতে থাকে। ইতিমধ্যে নীপারের ওপর পাড়ের মতোই কুরস্কেও গভীর প্রতিরক্ষা লাইন গড়ে তোলে রুশ বাহিনী। ফলে কুরস্ক দখল করতে গিযে উভয় সঙ্কটে পড়ে যায় পশ্চিমী মদতপুষ্ট জেলেনস্কির বাহিনী।
এরপরেই মূল রণক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক অভিযান চালায় রুশ বাহিনী এবং স্ট্র্যাটেজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর অ্যাভদিভকা সহ ৬টি ছোট শহর এবং ১২টি নগারিক এলাকা দখল করে নেয়। ছোট ছোট মোবাইল হামলাকারী বাহিনীর সাহায্যে পরিকল্পিতভাবে ইউক্রনের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে ফেলে তারা। বছর শেষে দেখা যায় রুশ বাহিনীর অগ্রগতির হার ফিরে গেছে ২০২২ সালের গোড়ার দিকের গতিতে। উন্নততর প্রযুক্তি ও কৌশল, শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনী, উন্নততর মিসাইলের সাহায্যে তারা একাধিক ফ্রন্টে কোণঠাসা করে ফেলেছে জেলেনস্কির বাহিনীকে। তবে এতে রুশ বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে এবং শক্তিও বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। তবে মার্কিনী মদত বন্ধ হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। পরিস্থিতি যে অন্যরকম পতে পারে তার একটা প্রমাণ মার্কিনি সহায়তার জন্য স্টারমারের নিউ ইয়র্কে দৌড়নো। কারণ, ট্রাম্প সরে দাঁড়ালে পশ্চিম ইউরোপকে ফের রাশিয়ার গ্যাস ও অন্য পণ্যের ওপর ভরসা করতে হবে। ওদিকে জার্মানির প্রেসিডেন্ট স্কোলজ শোনা যাচ্ছে গোপনে পুতিনের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমনকী ম্যাক্রঁর সুরও নরম। এই পরিস্থিতিতে যদি জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হয়ে রাজি হন, তবে ডনেৎস্ক ও ক্রিমিয়া সহ বহু এলাকা তাদের হাতছাড়া হবে ও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। রাশিয়া কোনওভাবেই ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যপদ মেনে নেবে না। ফলে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে ওয়াশিংটনে পালিয়ে বাঁচতে হবে জেলেনস্কি ও সাঙ্গোপাঙ্গদের। যদিও বিদেশের ব্যাঙ্কে তাদের যথেষ্ট লুঠের টাকা গচ্ছিত আছে। হেরো জেলেনস্কিকে সম্মানিত করার জন্য ট্রাম্প তাঁকে শান্তির জন্য নোবেল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন পড়ে থাকবে কিছু ভবঘুরে দালালদের হাতে। আর বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ ও ইওরোপিয়ান বুর্জোয়াদের আর্থিক সংস্থাগুলি মোটা সুদে টাকা ধার দিয়ে ইউক্রেনকে আরো শোষণ করে দেশটাকে দেউলিয়া করে তুলবে।
আগে হোক বা পরে, ইউক্রেন এমন পরিণতির হাত থেকে রেহাই পাবে না। পূবের দিকে এক পাও এগোব না, ইয়েলেৎসিনকে দেওয়া এই কথা রাখেনি মার্কিন ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ। এক পা এক পা করে তারা মস্কোর দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছিল। তাই তাদের বাধা না দিয়ে মস্কোর কোনও উপায় ছিল না। ফলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সীমান্ত ঘিরে নতুন এক সামরিক ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের পটভূমি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়েই চলেছে।