বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন সাইবার যুদ্ধ

কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন সাইবার যুদ্ধ

শান্তনু দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১—

#SOSCuba!
কিউবায় খাদ্যসংকট, কোভিড সংক্রমণ মোকাবিলায় সমাজমাধ্যমে ‘মানবিক সহায়তা’র আর্তি।

৫ জুলাই, যেদিন প্রথম এই ‘হ্যাসট্যাগ’ ব্যবহার করা হয়, সেদিন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত টুইটের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৫,০০০। তারপরেই বিস্ফোরণ! ৯ জুলাই: একলাফে ১,০০,০০০ টুইট। ১০ তারিখ ৫,০০,০০০। পরের দিন ১৫,০০,০০০। ১২ তারিখ একেবারে ২০,০০,০০০।

এসওএস কিউবা! এভাবেই মুহূর্তে ভাইরাল হয় সমাজমাধ্যমে। কিউবায় ‘জমনা বদলের’ এক নতুন ছক। সাইবার হামলা। দ্বীপরাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরিতে সরাসরি মার্কিন-মদত।

এই হ্যাসট্যাগ ব্যবহার করেই কিউবা-বিরোধী সমস্ত ‘টুইট করা হয় বিভিন্ন প্রান্ত থেকে’ জানিয়েছেন স্পেনের সমাজমাধ্যম বিশেষজ্ঞ জুলিয়ান মাসিয়াস ত্রোভার। ‘যেমন কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে আক্রমণ করা হয় মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতিকে, কিছু অ্যাকাউন্ট থেকে আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতিকে।’ স্পেনের পোডেমস পার্টির সদস্য ত্রোভার প্যানডেমিয়া ডিজিটাল সাইটের স্রষ্টা। ডিজিটালমাধ্যমে ভুয়ো তথ্য-সংবাদের বিরুদ্ধে একজন অ্যাক্টিভিস্ট। এসওএস কিউবার মার্কিন ছক বেআব্রু করে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এজন্য ছিল (টুইটার) অ্যাকাউন্টগুলির একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, যা জুড়ে ছিল কিউবা-বিরোধী মতাদর্শে।’ অধিকাংশই সদ্য খোলা অ্যাকাউন্ট, অথবা খোলা হয়েছিল একবছরের মধ্যে।

ইন্টারনেটে এই ‘বেনজির প্রচারাভিযানের অধিকাংশই যে মার্কিনমুলুক থেকে করা হয়েছিল, তার অকাট্য প্রমান আছে কিউবার কাছে। এবং টুইটারের কোনওরকম জরিমানা ছাড়াই ওরা এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে বিষয়টিকে ভাইরাল করতে।’ বলেন কিউবার বিদেশমন্ত্রী ব্রুনো রডরিগুয়েজ। ‘মিয়ামি-কেন্দ্রিক যে সংস্থা এই লেবেলটি তৈরি করেছিল, তাতে টাকা ঢেলেছিল খোদ ফ্লোরিডা সরকার।’ জানায় হাভানায় চীনের দূতাবাস।

খাদ্যসংকট, করোনা চিকিৎসা এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি নিয়ে রবিবার, ১১ জুলাই হাভানাসহ কিউবার বেশকিছু এলাকায় বিক্ষোভে নামেন মানুষ। নিউ ইয়র্ক টাইমসের শব্দবন্ধে ‘হাজারো’! লাখো নয়। একইসঙ্গে বিক্ষোভ হয় মিয়ামি-সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। এবং অন্য কয়েকটি দেশেও। বিক্ষোভের ধরনেই স্পষ্ট, স্বতস্ফূর্ততার থেকে এটি অনেক বেশি সংগঠিত।

একইসঙ্গে, ‘এসওএস কিউবা’ লেবেলকে ব্যবহার করে মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় মার্কিন শীর্ষ কর্তাদের টুইট।
যেমন অ্যান্থনি সাবাতিনি। যে সে লোক নন সাবাতিনি। ফ্লোরিডা প্রদেশের প্রতিনিধিসভার রিপাবলিকান প্রতিনিধি। কিউবায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের খোয়াব দেখে ১২ জুলাই সাতসকালে তাঁর টুইট, ‘কিউবার শীর্ষস্তরের কমিউনিস্ট কর্তাদের এখন চরমপত্র দেওয়া উচিত: হয় এখনই, কমিউনিজম থেকে সরকারের রূপান্তরে সহযোগিতা করুন, নাহলে পরে মামলা, ফাঁসির মুখোমুখি হতে হবে।
#এসওএসকিউবা’
মিয়ামি শহরের মেয়র ফ্রান্সিসকো সুয়ারেজ টুইট করে বলেন, ‘কিউবার সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে এয়ার স্ট্রাইকের কথা ভাবা যেতে পারে!’ পরে মার্কিন উগ্র দক্ষিণপন্থী চ্যানেল ফক্স নিউজে তিনি কিউবায় সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে সরাসরি সওয়াল করেন। পানামা অভিযান, কসভো যুদ্ধ থেকে পাকিস্তানে ঢুকে ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা তুলে ধরেন।
উচ্ছ্বাস চেপে না রেখে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন দাবি করেন, এ তো দেখছি কিউবার জনগণের ‘স্বাধীনতার জন্য এক জোরালো দাবি’। দৃশ্যতই আপ্লুত বাইডেন বলেন, সত্যিই ‘অসাধারণ’! কিউবার ‘স্বৈরাচারী জমানা থেকে স্বাধীনতার জোরালো দাবি শুনিয়েছেন জনগণ। এরকম প্রতিবাদ বহুদিন আমরা দেখিনি।’ ওয়াশিংটনের তরফে তাঁর আশ্বাস, আমরা থাকব ‘কিউবার জনগণ ও তাঁদের স্বাধীনতার’ দাবির সঙ্গে।

কিউবার বিদেশমন্ত্রী রডরিগুয়েজের কথায়, এটি আসলেই কিউবার বিরুদ্ধে এক ‘তথ্য যুদ্ধ’।
শুধু ভুয়ো সংবাদ, গুজব ছড়ানোই নয়। সঙ্গে ছিল কিউবার সরকারি ওয়েবসাইটের ওপর হামলা।
১১ জুলাইয়ের রাত। প্রতিবাদীদের প্ররোচিত করতে টুইটারে ছড়ানো হয় ‘রাত ১১:৩৭, বেসরকারি বিমানে রাউল কাস্ত্রো গোপনে পালিয়ে গিয়েছেন ভেনেজুয়েলার কারাকাসে।’ সঙ্গে ২০১৭ সালে রাউলের বিমান থেকে নামার ছবি। প্রতিবাদের তুফান বোঝাতে ছড়ানো হয় প্রতিবাদীরা অপহরণ করেছে কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রাদেশিক কমিটির প্রধানকে। দ্বীপরাষ্ট্রের পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছে ভেনেজুয়েলা।

আবার কোথাও কোথাও প্রতিবাদের ব্যাপকতা দেখাতে ব্যবহার করা হয় ২০১৮-তে কিউবার মে দিনের সমাবেশের ছবি, কিংবা ২০১১’র মিশরের ছবি।

‘কী ভয়ঙ্কর কুৎসা প্রচার, কী মারাত্মক মিথ্যা প্রচার!’ বলেন রাষ্ট্রপতি দিয়াজ ক্যানেল। ‘যেভাবে ওরা সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করছে, তা রীতিমতো বিষাক্ত এবং বিভেদকামী।’

‘মিডিয়া সন্ত্রাসবাদের এক ভয়াবহ প্রকাশ।’ বলেন দিয়াজ ক্যানেল।
হাভানায় ম্যাক্সিমো গোমেজের স্মৃতিসৌধকে ঘিরে ‘সরকারের সমর্থকদের’ সমাবেশ। দাপুটে মার্কিন সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস সেই ছবি তুলে বেমালুম ক্যাপশান করে দেয় ‘সরকার-বিরোধীদের’ প্রতিবাদ। আর ১১ জুলাই হুবহু সেই ক্যাপশানসহ ছবি ছেপে দেয় গার্ডিয়ান, ফক্স নিউজ, ফিনান্সিয়াল টাইমস থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন টাইমস এবং মার্কিন সরকারের আন্তর্জাতিক সম্প্রচারক সংস্থা ভয়েস অব আমেরিকা। সমাবেশের ছবিতে ২৬ জুলাইয়ের পতাকা থাকলেও একইসঙ্গে চলে এই বেপরোয়া মিথ্যাচার। কে না জানেন, ২৬ জুলাই আন্দোলনের পতাকা কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারের সমর্থকদের সাধারণ প্রতীক! অবাক করার মতো ঘটনা হল, এই ছ’টি মিডিয়ার মধ্যে একমাত্র গার্ডিয়ান পরে ভুল স্বীকার করে!

‘খাবার ও ওষুধের অভাবে প্রতিবাদে হাজারো কিউবান’ বলে ইনস্টাগ্রামে সিএনএন যে ছবি পোস্ট করে, তা আসলে ফ্লোরিডার মিয়ামি শহরে। সংবাদ সংস্থা এএফপি’র তোলা ছবির ক্যাপশান থেকে প্রথম অংশটি সিএনএন বিলকুল তুলে দেয়, যাতে স্পষ্ট ছিল প্রতিবাদ হয়েছে মার্কিনমুলুকে। অর্থমন্ত্রকের সামনে বিপ্লবের সমর্থক শ্রমিকদের সমাবেশকে সিএনএন-স্প্যানিশ এমনভাবে দেখায়, যেন সেটা সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ। আর একে আরও বাস্তব চেহারা দিতে নেপথ্যে শোনানো হয় ‘স্বাধীনতা’র গান।

একদিকে যখন এমন বেপরোয়া মিথ্যাচার, তখন অন্যদিকে সত্য যাতে কিছুতেই প্রকাশ না পায়, তার জন্য ‘ব্লক’ করা হয় কিউবার একাধিক সরকারি ওয়েবসাইট। ধারাবাহিকভাবে সাইবার হামলা ডিডিওএসের শিকার হয় কিউবাডিবেটের মুখ্য ওয়েবসাইট। ডিডিওএস মানে ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়াল অব সার্ভিস। যেখানে ট্রাফিক লোড দিয়ে একটি ওয়েবসাইটকে ‘ক্র্যাশ’ করিয়ে দেওয়া হয়। ১৫-১৬ জুলাই, চব্বিশ ঘণ্টায় ৩৫ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী এতে হামলা চালিয়েছে বলে নথিভূক্ত হয়েছে।

ব্রুনো রডরিগুয়েজ বলেছেন, সকলেই ‘জানেন কোন্ একচেটিয়া কারবার একে নিয়ন্ত্রণ করে, কীভাবে তারা কাজ করে, কোন্ দেশ থেকে অপারেট করে এবং এর নেপথ্যের রাজনীতিই বা কী!’

আজ নয়, ২০০৩ সালেই মার্কিন প্রতিরক্ষাদপ্তর ঘোষণা করেছিল, সাইবার দুনিয়া হতে চলেছে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নতুন ক্ষেত্র। ঘোষণা করেছিল নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক যুদ্ধ বা সাইবার যুদ্ধের নীতি।

টানা ৬০-বছর অবরুদ্ধ একরত্তি দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। এই অবরোধে কিউবার অর্থনৈতিক লোকসানের পরিমাণ ৭৫,৪০০ কোটি ডলার। এক ডলার ৭৪ টাকা ধরলে ৫৫ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা! যার প্রভাব পড়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া-সংস্কৃতিসহ অন্যান্য স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের উন্নয়নে।

যে অবরোধের কারণে আজ মারাত্মক তেলের সংকটে কিউবা। যে কারণে তৈরি করতে পারছে না যথেষ্ট পরিমাণে টিকা। এখনও পর্যন্ত কিউবা নিজেদের গবেষণাগারে পাঁচটি করোনার টিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে একটি আবদালা। এই টিকাটি ৯২.২৮ শতাংশ কার্যকরী বলে কিউবার সরকার জানিয়েছে। অন্যটি সোবেরানা-০২। সোবেরানা মানে সার্বভৌমত্ব। অথচ, এই কিউবাই কোভিড মোকাবিলায় ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের ২৩টি দেশে পাঠিয়েছে তাদের আন্তর্জাতিক মেডিকেল ব্রিগেড। পাঠিয়েছে ১৫০০ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীকে।

এটাই কিউবা। কিউবার সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ। এই কিউবা কখনও আটকে থাকেনি কিউবাতে। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের ভূগোলের মধ্যে। গুয়েতেমালা থেকে ভিয়েতনাম, সিরিয়া থেকে কঙ্গো— কিউবা পাঠিয়েছে ডাক্তার, শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা। ওয়াশিংটন এই গ্রহে রপ্তানি করেছে সমরাস্ত্র। বিপরীতে কিউবা রপ্তানি করে চলেছে জীবনদায়ী স্বাস্থ্য পরিষেবা। ওয়াশিংটন পাঠায় জলপাই পোশাকের ইয়াঙ্কি সেনা। হাভানা পাঠায় সাদা পোশাকের ডাক্তার। ফিদেলের নেতৃত্বেই লাতিন আমেরিকা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে।

১৯৯২ থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ভোট দিয়ে আসছে কিউবার বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধের অবসান চেয়ে। ২০২১, ভোটের ফলাফল ভোটের ফলাফল ১৮৪-২। কিউবার সঙ্গে বিশ্ব। আরও একঘরে বাইডেন। অবরোধের অবসান চেয়ে ভোট দিয়েছে বিশ্বের ১৮৪ টি দেশ। বিপক্ষে মাত্র দু’টি দেশ। ট্রাম্পের উত্তরসূরী বাইডেনের আমেরিকা এবং ইজরায়েল। ভোটদানে বিরত থেকেছে ‘লাতিনের ট্রাম্প’ বোলসোনারোর ব্রাজিল, কলম্বিয়া এবং ইউক্রেন।

যদি টানা ষাট বছর আমেরিকা অবরুদ্ধ থাকত, আজ তাহলে মার্কিনমুলুকের অবস্থা কেমন হতো? পৃথিবীর আর কোনও দেশকে দীর্ঘদিন ধরে এমন বর্বরতার শিকার হতে হয়নি। আজ কিউবার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?

বাইডেন বলেছেন কিউবার জনগণকে ‘ত্রাণ’ দেওয়ার কথা। অথচ, অবরোধ প্রত্যাহারের কথা একবারও বলেননি। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন পিসাকি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘আমরা দেখছি, কীভাবে কিউবার জনগণকে সাহায্য করতে পারি।’ বলেননি অবরোধ তোলার কথা।

জবাবে কিউবার রাষ্ট্রপতি দিয়াজ ক্যানেল বলেন, ‘ওরা (পশ্চিম) যদি কিউবার জন্য কিছু করতেই চায়, ওরা যদি সত্যিই আমাদের জনগণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়, ওরা যদি কিউবার সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে আগে ওরা অবরোধ প্রত্যাহার করুক, তারপর আমরা দেখব।’

হন্যে হয়ে খোঁজার পরে বিবিসি থেকে টাইমস অব ইন্ডিয়া— একজন প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসেবে কমবেশি জখম হয়েছেন ১৪০ জন।

বিক্ষোভ দমনে কিউবার রাষ্ট্রপতি কিন্তু সেনা নামানোর নির্দেশ দেননি। বরং নিজে রাস্তায় নেমেছেন প্রতিবাদীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য। কোথাও চলেনি এক রাউন্ড গুলি। কোথাও ব্যবহার করা হয়নি জলকামান। কিংবা টিয়ার গ্যাস। করা হয়নি অ্যাসিড বৃষ্টি। এমনকি ইলেকট্রিক ব্যাটন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। যাদের আটক করা হয়, তাঁদের অধিকাংশকে ছেড়ে দেওয়া হয় সেদিনই।

যেমন জানিয়েছেন দানিয়েল মনতেরো। ‘ডেমোক্রেসি নাউ!’কে এক সাক্ষাৎকারে। স্বাধীন সাংবাদিক মনতেরোকেও আটক করা হয়েছিল প্রতিবাদের সময়। ছেড়ে দেওয়া হয় সেদিনই। মনতেরো বলেছেন, এই সংকটের জন্য দায়ী অবরোধ। ‘৬০ বছর ধরে অবরোধই ডেকে এনেছে ক্ষুধা, মরিয়া মনোভাব... অবরোধ তোলার জন্য বাইডেন কিছুই করেননি। তাঁর প্রতিক্রিয়ায় ছিল না এনিয়ে কোনও মন্তব্য।’

এটা ঠিক কিউবা কোভিড-মুক্ত নয়। কিউবাতেও কোভিডের সংক্রমণ আছে। মৃত্যুও আছে।

এক কোটি দশ লক্ষের দেশ কিউবায় কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা ২,৪০,০০০। মৃত্যু ১,৫৩৭।

যেখানে মার্কিনমুলুকে একই জনসংখ্যার ওহিও প্রদেশে কোভিডে আক্রান্তের সংখ্যা ১১,০০,০০০। মৃত্যু ২০,০০০।

এজরি ফ্রান্সের সর্বশেষে ১৫ জুলাইয়ের আপডেট কী? প্রতি এক লক্ষে কিউবায় মৃত্যু ১৫.৪৮। এই গোলার্ধে সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতি। মাত্র নব্বই মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কত? প্রতি এক লক্ষে কোভিডে মৃত্যু ১৮৬.২৫। ব্রাজিলে এই হার ২৫৯.১৭। পেরুতে ৬২৭.৪৯। কিউবার পরিস্থিতি এমনকি ফ্রান্স, জার্মানির চেয়েও অনেক ভালো। ফ্রান্সে এই হার ১৬৬.৩৩। জার্মানিতে ১১৩.৩২।

কিউবায় মানবাধিকার নিয়ে লাগাতার অভিযোগ জানিয়ে আসছে ওয়াশিংটন থেকে ব্রাসেলস। কিউবায় না কি শ্রমিকদের মতপ্রকাশ, ইউনিয়ন গঠনের কোনও স্বাধীনতা নেই?

ঘটনা হল, কিউবার শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের বেশি ইউনিয়নের সদস্য। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই হার মাত্র ১১.৩ শতাংশ। ১৯৫৯, কিউবায় বিপ্লব। তার ২০-বছর আগে ১৯৩৯ সালে সমস্ত ইউনিয়নকে নিয়ে তৈরি হয় ফেডারেশন অব কিউবান ওয়ার্কার্স (সিটিসি)। ইউনিয়নগুলি পুরোপুরি স্বাধীন, স্বনির্ভর। সদস্যপদের চাঁদা মজুরির ১ শতাংশ সরাসরি সংগ্রহ করা হয় কর্মস্থল থেকে, কেটে নেওয়া হয় না মজুরি থেকে।

২০১৬’র এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে এর জবাব দেন রাউল কাস্ত্রো।

‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবর দাবি করে কিউবায় না কি মানবাধিকার নেই, আর সেটাই অর্থনৈতিক অবরোধ তোলার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আমাদের কাছে, মানবাধিকারের অর্থ: সমকাজে সমমজুরি, তা সে পুরুষ হোন, আর মহিলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ অন্যান্য দেশে এটা নেই। মহিলারা পান কম মজুরি। অথচ, এনিয়ে কয়েকডজন মানবাধিকারের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিনমূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা— কিউবায় অন্যতম একটি মানবাধিকার। এরকম মানবাধিকার এই বিশ্বে আর ক’টি দেশে আছে? বহু দেশে এটা কোনও মানবাধিকারই নয়। বরং, ব্যবসা। আমাদের দেশে শিক্ষা মেলে বিনামূল্যে। বিশ্বে আর ক’টি দেশ আছে, যেখানে ফ্রি-তে শিক্ষা মেলে? এটাও সব দেশে ব্যবসা।’

‘সেকারণেই এনিয়ে আমরা যে কারোর সঙ্গে যে কোনও জায়গায়, যে কোনও সময় আলোচনা করতে প্রস্তুত।’ বলেন রাউল।

এবং, আজ পর্যন্ত কেউ এনিয়ে কিউবার সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ পর্যন্ত করেনি।

কিউবায় প্রতি ১৭০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আমেরিকায় দ্বিগুণেরও বেশি, ৩৯০ জন পিছু একজন ডাক্তার। আর ভারতে, সাড়ে আটগুনেরও বেশি, ১৪৫৭ জন পিছু একজন ডাক্তার।

টানা ছ’দশক অবরোধের মুখেও কিউবা মানব উন্নয়নে গোটা বিশ্বের কাছে এক অনন্য নজির। বর্ণবিদ্বেষের অবসান। মহিলাদের সমানাধিকার, মহিলাদের উত্থান। নিরক্ষরতার হার, শিশুমৃত্যু তলানিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা, ক্রীড়ায় সমানে পাল্লা দিয়ে চলেছে দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে।

মানব উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলির তালিকায় কিউবা। ২০২০, ইউএনডিপি’র মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে কিউবার স্থান ৭০, যেখানে ভারত ১৩১। গড় আয়ু ৭৮.৮, যেখানে আমেরিকায় ৭৮.৯, আর ভারতে প্রায় ৬৯.৭। পাঁচ বছরের কম বয়েসী শিশুর মৃত্যু হার প্রতি এক হাজারে মাত্র ৫, যেখানে আমেরিকায় ৬, আর ভারতে ৩৪।

একরত্তি দেশ কিউবা। আয়তন মেরেকেটে ১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। জম্মু কাশ্মীরের চেয়ে বড়, তেলেঙ্গানার চেয়ে ছোট। জনসংখ্যা সাকুল্যে এক কোটি দশ লক্ষ। উত্তর চব্বিশ পরগণা, দক্ষিণ দিনাজপুর মিলিয়ে এর চেয়ে বেশি মানুষ থাকেন। আমেরিকার জনসংখ্যা কিউবার ৩৩ গুণ। তেত্রিশ কোটি।

এহেন এক ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের লড়াই এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে। মাত্র নব্বই মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় কিউবা। এমন এক দ্বীপ, যা তার শত্রুর চেয়ে ৮৪ গুণ ছোট।

তবু প্রত্যয়ী। যেমন জানিয়ে দিয়েছেন কিউবার রাষ্ট্রপতি, ‘কোনও ভাড়াটে প্রতিবিপ্লবী, যাঁরা অস্থিরতায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ পাচ্ছেন, তাঁদেরকে কোনওভাবেই কিউবা বরদাস্ত করবে না।’

গত এপ্রিলেই হয়েছে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেস। সেখানে রাউল কাস্ত্রোর সতর্কবার্তা ছিল, ‘কেউ কেউ বিদেশী বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের আধিপত্যের সমাজতান্ত্রিক নীতির অবসান চাইছেন। বিদেশী বাণিজ্যে একটি রাষ্ট্র-বহির্ভূত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় বেসরকারি বাণিজ্যিক আমদানির কর্তৃত্ব চাইছেন।’

রাউল বলেছেন, ‘এই পথে হাঁটা মানে, জাতীয় শিক্ষা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা— যা সমস্ত কিউবাবাসীর জন্যই বিনামূল্যে এবং যার সুযোগ সর্বজনীন— তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গুঁড়িয়ে ফেলা।’ আর ‘এটি হবে আমাদের রণনীতিগত বিচ্যুতি। সমাজতন্ত্রের ধ্বংসসাধন, আর সেকারণে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ধ্বংসযজ্ঞ।’

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.