বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
মাস চারেক আগে মজদুল খেজুরের প্যাকেট নিয়ে এল সজীব। হাসিমাখা মুখে বলল, দিদি খাবেন। সাতসকালে মিষ্টিমুখ? ‘হাসিনা পালিয়েছে। এবার আমরা দেশে যেতে পারব।’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কেন তোমরা এত দিন দেশে যেতে পারতে না? উত্তরে সজীব যা জানাল, শুনে আমি থ! ওর নামে থানায় তিনটে অভিযোগ। ওর দাদার নামে নয়টা। সবই রাজনৈতিক অভিযোগ। তাতেই ওরা দেশান্তরি। গত সাত বছরে সজীব এক বারও বাড়ি যেতে পারেনি।
দুবাইতে সজীব আমার গৃহসহায়ক। বছর পঁচিশের মৃদুভাষী যুবক সজীব সকালে আরও কয়েকটি পরিবারে কাজ করে। বাকি দিনটা খালাতুতো দাদার সঙ্গে মেকানিকের কাজ করে। অথচ বাংলাদেশের কুমিল্লায় সজীবদের পরিবার অবস্থাপন্ন। দুই পুরুষের পরিবহণ ব্যবসা। পুকুর বিল মিলিয়ে স্থাবর সম্পত্তি ১৫ একর। বচ্ছরকার ধান সবজি উঠে আসে চাষ থেকে। ইন্টারমিডিয়েট পড়া শেষেই পারিবারিক ব্যবসায় লেগে পড়েছিল সজীব। পড়াশুনো আর এগোয়নি।
২০১৭-য় হঠাৎ নোটিশ আসে থানায় দেখা করতে হবে। পুলিশের খাতায় ওর নামে অভিযোগ জমা পড়েছে। থানায় যাওয়া মানেই গারদে আটক। তাড়াতাড়ি পরিচিত একে ওকে ধরাধরি করে দিন সাতেকের মধ্যে পাসপোর্ট তৈরি ও পিঠটান। প্রথমে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই। তিন মাসের ভিসা শেষ হওয়ার আগেই গ্রামতুতো দাদার মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি জোগাড়। পরে নিজেই ভিসার ব্যবস্থা করে। নিজস্ব ভিসা থাকলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সহজেই মেলে পরিচারকের কাজ। তাই বহু শিক্ষিত বাংলাদেশি যুবক পরিচারকের কাজ নিয়ে দুবাই, আবু ধাবি, শারজায় টিকে থাকতে চায়।
সজীব একা নয়। অনেক বাংলাদেশি যুবক বছরের পর বছর ঘর ছাড়া রাজনৈতিক আগ্রাসনে। সজীবের খালাতুতো দাদা আহাদ ঘর ছেড়েছিল বছর দশেক আগে। আহাদের নামে নয়টি কেস। ওদের পরিবার কয়েক পুরুষ বিএনপি-র সমর্থক। দেশে থাকতে আহাদ অনলাইন সংবাদপত্রে লেখালিখি করতেন। আহাদের কথায়, দেশকে বিরোধীশূন্য করতে যে সব পরিবার বিরোধী পার্টির সমর্থক, সেই পরিবারের ছেলেদের নামে সমন জারি হয়। এসব ক্ষেত্রে থানায় হাজিরা দিলেই জেলবাস অবধারিত। তাই সঙ্গতি থাকলে রাতারাতি দেশ ছেড়ে দেন বহু যুবক। প্রথমে টুরিস্ট ভিসায় দেশ ছাড়া। তারপর কোনও একটা কাজ জুটিয়ে বিদেশেই থেকে যেতে হয়।
একটু ভাল জীবন, পরিবারকে সামান্য সচ্ছলতার মুখ দেখাতে ও নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় গত দুই দশকে বহু বাংলাদেশি দেশ ছেড়েছেন। গত বছর রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশি ইউরোপে শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানান। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রিফিউজি এজেন্সির পরিসংখ্যান বলছে ২০২৩-এ ৪০,৩৩২ জন নরওয়ে ও সুইৎজারল্যান্ডে শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। যা বিগত দশ বছরে সবচেয়ে বেশি। ২০১৫-তে আবেদন করেছিলেন ১৭২১৭ জন। অর্থাৎ কয়েক বছরে সংখ্যাটা প্রায় দ্বিগুণ।
কেন এত মানুষ দেশ ছাড়ছেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট চৌধুরী রফিকুল আবরার গবেষণা করছেন ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট’ নিয়ে। তিনি জানাচ্ছেন, এর অন্যতম কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগ্রাসন। মানুষ নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে। সবাই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চায়। চায় উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বাংলাদেশে এ সবেরই অভাব। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার প্রথাগত উপায় বড়ই সীমিত। তাই শরণার্থী হওয়ার চেষ্টা করে। ইউরোপের দেশগুলোতে শরণার্থী হওয়ার মধ্যে নিশ্চিত জীবনের সন্ধান করে।
বাংলাদেশিরা ইউরোপের মধ্যে সব থেকে বেশি শরণার্থী হওয়ার চেষ্টা করে ইটালিতে। পরিসংখ্যান বলছে ৫৮%। তার পর প্যারিসে। গত বছর ২৩৪৪৮ জন বাংলাদেশি আবেদন জানিয়েছিল। অন্য যে সব দেশে গত বছরে শরণার্থীর আবেদন জমা পড়েছে তা এ রকম। রোমানিয়া (২৮২২জন), অস্ট্রেলিয়া (১৪০৯ জন), গ্রিস (৬৪০ জন), আয়ারল্যান্ড (৪৪৫ জন), স্পেন (৩৮০ জন), সাইপ্রাস (৩১৪ জন), জার্মানি (১৬৪ জন), মালটা (১১৮ জন)। টুরিস্ট ভিসায় এ সব দেশে ঢুকে শরণার্থী হওয়ার চেষ্টা করে।
নিয়ম মতো, শরণার্থী হতে পারেন যুদ্ধবিধস্ত দেশের নাগরিক। দেশ প্রবল অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হলে অন্য দেশে শরণার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করা যায়। সে দিক থেকে দেখলে বাংলাদেশের অবস্থা তেমনটা নয়। বাংলাদেশিরা অর্থনৈতিক কারণে পরিবারের সুরক্ষার জন্য এ পথ অবলম্বন করেন। বাংলাদেশে কাজ নেই। গত বছর অক্টোবরে বাংলাদেশি ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্স প্রকাশিত লেবার ফোর্স সার্ভে ২০২২-এর হিসেব জানাচ্ছে গত পাঁচ বছরে বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ২০১৯-এর রিপোর্ট বলছে, প্রতি তিন জন শিক্ষিত বাংলাদেশির মধ্যে এক জন বেকার।
রফিকুল জানাচ্ছেন, শরণার্থী হওয়ার ৯০% আবেদন বাতিল হয় উপযুক্ত কারণ দর্শানোর অভাবে। এই কারণে সত্যিই যাদের আশ্রয় দরকার তারা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। আর এটা কমন প্র্যাকটিস, বেআইনি পথে অন্য দেশে প্রবেশ করলে শরণার্থী হওয়ার চেষ্টা করে ব্যাপারটা আইনি করার জন্য। দেশে রাজনৈতিক আগ্রাসন থেকে বাঁচার জন্য এরা কোনও ক্রমে দেশ থেকে পালায়। তাই বিশ্বজুড়ে ইমিগ্রেশন পলিসি আরও কঠিন হচ্ছে।
দেশের এমত অবস্থায় সাধারণ মানুষের মরিয়া অবস্থা। বেআইনি ভাবে ঘুরপথে ইউরোপে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন এমন নজির বহু। ইউরোপিয়ান বর্ডার ও কোস্ট গার্ড এজেন্সি ফ্রনটেক্স জানাচ্ছে, অনেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিতে ঢোকার চেষ্টা করেন। ২০২৩-২৪-এ সংখ্যাটা ১৭৫৩৫!
দুবাইতে ৩০,০০০ বাংলাদেশি ট্যাক্সি চালক আছেন। চট্টগ্রামের আরিফুল আলি সাত বছর দুবাইতে কাজ করছেন। তাঁর কথায় হতাশা ঝরে পড়ল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক আরিফুল বললেন, “কলেজে পড়ার সময় কখনও ভেবেছি, অন্য দেশে ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করতে হবে? দেশে কাজ থাকলে কি এখানে পড়ে থাকতে হত?” গত বছর দেশে গিয়েছিলেন। মাস দুয়েক কাটিয়ে ফিরে আসেন। বললেন, “ফেরার সময় কী যে মন খারাপ হয়! এখানে মন টেকে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু উপায় তো নেই। বাচ্চাদের কথা ভেবেই এখানে আসতে হয়।”
চট্টগ্রামের মহম্মদ ফারবেজ শারজায় বহু দিন পর্দা সোফার কারবারি। তিনি এই অবস্থার জন্য শেখ হাসিনাকে দোষ দিতে রাজি নন। তাঁর কথায়, “হাসিনা এত দিন দেশটাকে ধরে রেখেছিল। এখন দেখবেন কী অবস্থা হয়।” কিন্তু হাসিনার নামে তো গুচ্ছের অভিযোগ? মহম্মদের মতে, হাসিনার ঘনিষ্ঠ কিছু মন্ত্রীর জন্যই এই অবস্থা। তারাই দেশটাকে রসাতলে পাঠাল।
দমনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে নাগরিকরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রচুর মানুষ বিদেশে মাথা গোজার ঠাঁই খুঁজছে। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম সুলভ। ইউএই-তে ৯০% মানুষ প্রবাসী। বোঝাই যায়, ভিসা পেতে তেমন অসুবিধে হয় না। এদেশে এক বার পৌঁছতে পারলে জুটে যাবে গৃহপরিচারক, মালি, গাড়ি ধোওয়ার মতো রকমারি কাজ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও শ্রমিকের বিশাল চাহিদা। প্রচুর বাংলাদেশি এ কাজ করেন। বাংলাদেশি মেয়েরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। অভাবের তাড়নায় বাংলাদেশের কোন অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা আরব সাগর পেরিয়ে রোজগার করতে চলে আসে। এমন অনেক মেয়ে আছেন, যাঁরা নিজেরা প্রথমে এসে কয়েক বছর রোজগার করে ক্রমে স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। মাসে বাংলাদেশি মুদ্রায় কুড়ি হাজার টাকা এঁরা অনায়াসে রোজগার করে ফেলেন। যা কিনা দেশে রোজগার করা তাঁদের কাছে স্বপ্নসম।
তাই একবার দেশ থেকে বেরোলে ফেরার কথা আর তাঁরা ভাবতেই পারেন না। আহাদ যখন দেশ ছাড়েন, নবজাতক শিশুকন্যার বয়স মাত্র ২ মাস। ৯ বছরে দুই বার দেশে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা অবধি। সেখানেই পরিবার এসে দেখা করে। কুমিল্লার গ্রামে গেলে খবর ঠিক রটে যাবে। তাই সেই সাহস এত দিন করেনি কেউ।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়লে আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল দূর দেশে এই সব ঘরছাড়াদের মধ্যে। জুলাইতে বাংলাদেশে বিক্ষোভ শুরু হলে আবু ধাবির একটি পার্কে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে বেশ কিছু বাংলাদেশি। ইউএই-তে এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন নিষিদ্ধ। পত্রপাঠ ৫৭ জন বাংলাদেশিকে গারদে পুরে দেওয়া হয়। বিচারে ৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ১ জনের ১১ বছর ও ৫৩ জনের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। পরে মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে আবু ধাবির শেখ মহম্মদ বিন আল নাহিয়ান এদের ক্ষমা করে মুক্তি দেন ও একই সঙ্গে বাংলাদেশে ফেরত পাঠান!
আগস্টে আওয়ামি লিগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে রাজনৈতিক আগ্রাসনে দেশান্তরি বাংলাদেশিরা দেশে ফিরছেন, গ্রামে ফিরছেন। দেশে ফিরে তাঁদের প্রথম কাজ নিজেদের দোষমুক্ত করা। আইনজীবী মারফত নিজের নামের সঙ্গে জড়ানো অভিযোগ সরানো। কিন্তু কেউই আর পাকাপাকি দেশে থাকতে চান না। তাঁদের কথায়, দেশে আছেটা কী? তার থেকে বিদেশে শ্রমিকের কাজ এঁদের কাছে অনেক বেশি শ্রেয়। সজীবের কথায়, “আমরা এবার দেশে নির্ভয়ে ফিরতে পারব। এবার পালা আওয়ামি লিগের সদস্যদের। তাদের অবস্থা আরও খারাপ। তারা পালাবার পথ পাচ্ছে না।” তাদের একমাত্র বাঁচার উপায় দেশান্তরি হওয়া। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় বাংলাদেশে নিঃশব্দে নিরন্তর ঘটে চলেছে মাইগ্রেশন।