বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

নয়া উপনিবেশবাদ মুক্ত আফ্রিকা গড়ার সংগ্রাম

নয়া উপনিবেশবাদ মুক্ত আফ্রিকা গড়ার সংগ্রাম

রতন গায়েন

photo

শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তির আফ্রিকাকে তাদের লুণ্ঠনের মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত করার সূচনা করে পঞ্চদশ শতক থেকেই। আফ্রিকার সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের তীব্র আকাঙ্খায় ১৮৮৪ সালের পরবর্তী সময়ে সরাসরি উপনিবেশ স্থাপনে ইউরোপীয় শক্তিগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রায় চার হাজার ভাষা ও পাঁচশো ধর্মে বিভাজিত মহাদেশটিতে ছিল আঞ্চলিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এমন একটি বিভাজিত মহাদেশকে করায়ত্ত করতে উপনিবেশবাদীদের খুব একটা চ্যলঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সর্দারদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়ে ১৯১২ সালের মধ্যে প্রায় সমগ্র আফ্রিকা ভূখণ্ডকে উপনিবেশবাদীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেয়। উপনিবেশ-উত্তর আফ্রিকাতে ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি ও অন্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি অবাধ লুণ্ঠন চালাতে থাকে। জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্টরি’ বইতে আফ্রিকার কৃষকদের বিপুল লুন্ঠনের কথা লিখেছেন। ১৯৩৬ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) আক্রমণ করে দেশটির দখল নিয়ে অসহনীয় অত্যাচার নামিয়ে আনলে ব্যথিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আফ্রিকা কবিতায় তাঁর মনোবেদনা প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘সভ্যের বর্বর লোভ/ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।’
শোষণ, লুণ্ঠন ও নৃশংসতার ইতিহাস যতই দীর্ঘ হোক না কেন, মানুষের অধিকারের আকাঙ্খাকে চূর্ণ করতে সাম্রাজ্যবাদীদের মরিয়া চেষ্টাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে তা স্পষ্ট হতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের ফলে উপনিবেশগুলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পক্ষে। বিশেষত সমাজতন্ত্রের প্রসার আটকানোর লক্ষ্যে আটলান্টিক চার্টার নামে খ্যাত সনদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ঔপনিবেশিক দেশগুলিকে স্বাধীনতা প্রদানে সহমত হন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভারত সহ অনেক দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও আফ্রিকার দেশগুলিকে আরো কিছু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোয়ামে নক্রুমার নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা পায় গোল্ড কোস্ট, যা পরে ঘানা হিসাবে পরিচিত হয়। নক্রুমা সমগ্র আফ্রিকার ঐক্য ও নয়া উপনিবেশবাদের বিপদ সম্পর্কে মহাদেশজুড়ে জোরালো সওয়াল করেন। স্বাধীন ঘানায় স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবিচল থাকার খেসারত হিসেবে তাঁকে মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ১৯৬৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। গিনিতে অবস্থানের সময়েও তিনি তাঁর ভাবনা একাধিক বইয়ে বিশ্লেষণ করে সমগ্র আফ্রিকার মানুষের কাছে স্পষ্ট করেছেন। ১৯৬০ এর দশকে প্রায় সমস্ত আফ্রিকা স্বাধীনতা লাভ করে। নক্রুমা নয়া উপনিবেশবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে সারা আফ্রিকার ঐক্যের উপর জোর দিয়েছিলেন। পূর্বতন ফরাসি উপনিবেশ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলির বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।
ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বড় ঘাঁটি ছিল পশ্চিম আফ্রিকা। আনুষ্ঠানিকভাবে উপনিবেশ মুক্ত হলেও সমগ্র এলাকায় ফরাসি নিয়ন্ত্রণ আজও অব্যাহত। এই নিয়ন্ত্রণকেই পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলি যে নয়া উপনিবেশবাদ হিসাবে চিহ্ণিত করে তার কয়েকটি যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
এক, সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশগুলির মুদ্রাব্যবস্থা এখনো ফরাসি ফ্রাঁএর সঙ্গে যুক্ত-এক নির্দিষ্ট বিনিময় হারে বাঁধা। এই দেশগুলি কোনও পছন্দসই আর্থিক (Fiscal) ও মুদ্রা নীতির (Monetary) সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ফ্রান্সেই মজুত থাকে। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্সই এদের আর্থিক ও মুদ্রানীতির নিয়ন্ত্রক। এছাড়া সব প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণও ওই সব দেশের কর্পোরেট সংস্থার করায়ত্ত।
দুই, এইসব দেশে পশ্চিমা ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও তা কার্যত নিয়ন্ত্রিত হয় মূল ফ্রান্সের নির্দেশে। এই অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণের কাজটি করে থাকে ‘ইকনমিক কমিউনিটি অব ওয়েষ্ট আফ্রিকান স্টেটস (ECOWAS)।’ ১৫টি সাবেক ফরাসি ঔপনিবেশিক দেশগুলির অর্থনৈতিক সহযোগিতার লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম হলেও এর প্রধান কাজ হল সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করা। মসৃণ গণতন্ত্রের আড়ালে মেরুদণ্ডহীন সরকারগুলি দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছে।
তিন, জেহদি হামলা থেকে দেশগুলোকে রক্ষার অজুহাতে এইসব দেশে ফরাসি সেনা মোতায়েন রাখা হয়েছে। সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এটি চরম অপমান।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলি এই নয়া উপনিবেশবাদের অবসানে সোচ্চার হয়েছে। এই লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে মালি, নাইজার ও বারকিনা ফাসো। গণতন্ত্রের মুখোশে কার্যত ফরাসি এজেন্ডা পূরণ করা এই তিন দেশের মেরুদণ্ডহীন সরকার মানুষের প্রতিবাদে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক শাসন। এই তিন দেশ ফ্রান্স ও পশ্চিমী নির্দেশে চালিত ইকোয়াসের (ECOWAS) ত্যাগ করেছে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। গঠন করেছে ‘অ্যালায়েন্স অব সাহেল স্টেটস’ (AES)। তিনটি দেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করে অভিন্ন মুদ্রার রূপরেখা তৈরি করে ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনের পটভূমি নির্মাণ করার সক্ষমতা দেখিয়েছে। ফরাসি সেনা প্রত্যাহারে অনড় ও ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনের লক্ষ্যে অবিচল বারকিনা ফাসোর মার্কসবাদী নেতা টমাস শঙ্করার ফ্রান্সের মদতে খুন হয়ে যাওয়ার কথা এই তিনটি দেশ বিস্মৃত হয়নি। তাই জনগণকে সংগঠিত করে তাদের দেশ থেকে অবশিষ্ট ফরাসি সেনা প্রত্যাহারের যে সংকল্প তারা নিয়েছিল তা সফল করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। এই প্রত্যাহার নয়া উপনিবেশবাদ নির্মুল করার এক বড় মাইল ফলক। এই তিন দেশের পথ ধরে আইভরি কোস্ট, সেনেগাল প্রভৃতি দেশ একই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। ২০২৫এর মধ্যে অধিকাংশ দেশ থেকে অবশিষ্ট ফরাসি সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফরাসি সরকার। নয়া উপনিবেশবাদ অবসানের লক্ষ্যে এটি একটি বড়সড় সাফল্য।
শুধুমাত্র রাজনৈতিক সাফল্যে নয়া উপনিবেশবাদকে যে নির্মুল করা যাবে না, সেই শিক্ষা ও জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন টমাস শঙ্করা, কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যট্রিস লুলুম্বা, ঘানার স্বাধীনতা তথা আফ্রিকা ঐক্যের স্থপতি কোয়ামে নক্রুমা প্রমুখ। তাঁদের শিক্ষা হল, ঐক্য বজায় রেখে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন। এই লক্ষ্যে বারকিনা ফাসোর প্রধান ইব্রাহিম ট্রাওরে দুটি বৈপ্লবিক কর্মসূচি রূপায়ণ করছেন। এক, কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার পাশাপাশি শিল্প বিকাশের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে চলেছেন। দুই, প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থানের জন্য ব্রিটিশ মাইনিং কোম্পানিকে হঠিয়ে দুটি সোনার খনি রাষ্ট্রায়ত্ত করেছেন। বুরকানা ফাসোর খনি বিশ্বের ১৩তম বৃহৎ স্বর্ণখনি যা বছরে ১০০ টন সোনা উৎপাদন করে এবং যার বাজার মূল্য ৬০০ কোটি ডলার। এই বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে দেশটিকে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি স্থানীয়ভাবে প্রথম সোনা রিফাইনারি কোম্পানিও গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে জাতীয় উৎপাদন (GNP) ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মালি ও নাইজারও একই পথে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। মালি এখন বিশ্বের দ্রুততম বিকাশশীল দেশ। বহুকাল আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন বলেছিলেন, যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে খনিজ সম্পদ উত্তোলিত হয় তবে তা অর্থনীতির মোড় পরিবর্তনে সক্ষম। এর বিপরীতে দেশটি সর্বনাশের পথে চলে যায়।
জাতীয় সম্পদকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে রাখা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অযোগ্য পরিচালন ব্যবস্থা দেশের বিকাশে আদৌ সহায়ক হবে না। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবস্থা দেশের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত তা মাথায় রেখে ত্রুটিগুলিকে চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আশার কথা আফ্রিকার দেশগুলি এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এগিয়ে চলেছে। আরও উৎসাহব্যঞ্জক তথ্য হল, বারকিনা ফাসো ইতিমধ্যে নিজের ক্ষমতায় ৪৮০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা দেখিয়েছে। মালি এখন সম্পূর্ণভাবে বৈদেশিক ঋণ মুক্ত। দরিদ্র নাইজার এখন আফ্রিকার দ্রুততম অর্থনৈতিক বিকাশের কেন্দ্র।
এমন সাফল্যের সময়ে এটা বলা প্রয়োজন যে সাহেলভূক্ত দেশগুলির জোট (AES) কিন্তু বিপদমুক্ত নয়। নয়া উপনিবেশবাদীরা ঘানা, বেনিন ও আইভরি কোস্টে ড্রোন ঘাঁটি বানিয়ে এই তিন দেশকে নিশানা করার চক্রান্ত করছে। এমন এক ক্রান্তিলগ্নে গত ২০২৪ এর ১৯-২১ নভেম্বরের প্যান-আফ্রিকান মুভমেন্টের মহাসম্মেলন একটা মাইল ফলক হতে পারে। সাহেলভূক্ত দেশগুলির প্রতি সংহতি জানাতে নাইজারের রাজধানী নিয়ামোতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে তিনশোর বেশি প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন ও আফ্রিকার নেতৃবৃন্দ। প্রতিনিধিরা বারকিনা ফাসো, মালি ও নাইজারকে সংহতি জানিয়ে প্যান-আফ্রিকান আন্দোলনের স্থপতি কোয়ামে নক্রুমার সতর্কবার্তাটি স্মরণ করন – ‘আফ্রিকা ঐক্যবদ্ধ না হলে ধ্বংস হবে।’ নাইজেরিয়ার নেতার যুক্তি ছিল আমেরিকার পঞ্চাশটি রাজ্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক রাষ্ট্রের শরিক থাকতে পারলে, আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনে কোনও সমস্যা হবে না। ইতিমধ্যে সাহেল ভুক্ত তিনটি দেশ ২০০০ কিলোমিটার সীমানার ভেদরেখা মুছে দিয়ে যে পথ দেখিয়েছে সেটাই ঐক্যবদ্ধ আফ্রিকা গঠনের ও স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার পথ। ❑
তথ্যসূত্র: ওয়েস্ট আফ্রিকাজ রেজিসট্যান্স এগেন্স্ট ইম্পিরিয়ালিজম, প্রভাত পট্টনায়েক , পিপলস ডেমোক্রেসি। এবং নিকোলাস মোয়াংগি ও পল মেলির লেখা নিবন্ধ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.