বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ অগাস্ট, ২০২১— বায়ুমণ্ডল দেশকালের বেড়াজাল মানে না— পৃথিবীর ফুসফুস যতক্ষণ সচল মানবজাতিও তত দিনই সক্ষম। কথাটা উঠল, অ্যামাজন নদীর অববাহিকার অরণ্য প্রসঙ্গে। গত এক দশকে অ্যামাজনের অরণ্য সবচেয়ে বেশি হারে উজাড় হয়েছে বলে সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীর দুই তীরে বিস্তৃত এই বিশাল অরণ্যভূমি। ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার প্রসারিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। ৯টি দেশ জুড়ে এই অরণ্য বিস্তৃত। অ্যামাজন অরণ্যের ৬০% ব্রাজিলে, ১৩% পেরুতে, কলম্বিয়ায় ১০% এবং বাকি অংশ রয়েছে ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়েনা, ফরাসি গায়েনা, সুরিনাম এবং ভেনেজুয়েলায়।
পৃথিবী জুড়ে চিরহরিৎ অরণ্যের প্রায় অর্ধেকটা এই অরণ্য নিজেই। নানা রকম প্রজাতির বাসস্থান হিসেবে সমৃদ্ধ এই অ্যামাজন অরণ্য। এই অরণ্যে ১৬০০০ প্রজাতির প্রায় ৩৯ হাজার কোটি বৃক্ষ রয়েছে। পৃথিবীর ২০% অক্সিজেন আসে অ্যামাজন থেকে। এর জন্যে একে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়। অ্যামাজন অরণ্য পৃথিবীর প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এবং আন্তর্জাতিক মহল দ্বারা পরিবেশের জন্য সংরক্ষিত। অ্যামাজন অরণ্যে ৪৫ লাখ প্রজাতির কীটপতঙ্গ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর, ৩৭৮ প্রজাতির সরিসৃপ এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। পাশাপাশি অ্যামাজন নদীতে ৩০০০ প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী।
অ্যামাজন নদী পৃথিবীর অন্যতম মিষ্টি জলের উৎস। এই নদী ও তার অসংখ্যউপনদীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য জনজাতির বাসভূমি এই চিরহরিৎ অরণ্য। এই অরণ্যে বড় তিনশ’র বেশি জনজাতি বাস করে। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। তারা বেশির ভাগ ব্রাজিলীয়। তারা পর্তুগীজ, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে। তাদের নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু যাযাবর। এদের বহিঃবিশ্বের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই।
ধনতন্ত্রের সর্বগ্রাসী লোভে বিপন্ন অ্যামাজনের অরণ্য। এই অরণ্যভূমির বেশির ভাগ এলাকা যেহেতু ব্রাজিলের অন্তর্গত তাই প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারোর নীতি অবশ্যই এই অরণ্যহ্রাসের অন্যতম কারণ বলেই মনে করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বোলসোনারো অরণ্যের ধ্বংসের জন্যে জরিমানা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর ক্ষমতাকে করেছিলেন সীমিত। রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সহকারী এমন ঘোষণাও করেছিলেন যে কৃষি ও অরণ্য মন্ত্রণালয়কে একীভূত করা হবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন এই নিবিড় অরণ্যভূমি এসব কারণেই বিপন্ন। সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটির মাতো গ্রসো এবং পারা রাজ্যেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অরণ্যভূমি ধ্বংসের মুখোমুখি। আর এই হ্রাসের হার গত বছরের তুলনায় ১৩.৭ শতাংশ বেশি। এই মাতো গ্রসো হল ব্রাজিলের সবচেয়ে বেশি শস্য উৎপাদনকারী এলাকা।আর সে কারণেই এই এলাকার অরণ্য বিনাশে ধনকুবের ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলি বিশেষ সক্রিয়। এ বিষয়ে ব্রাজিল সরকারের পক্ষে মি. ডুয়ার্ট দোষারোপ করেছেন অবৈধভাবে গাছ কাটার একটি 'সংঘবদ্ধ চক্রের উত্থান'কে। তবে মি. ডুয়ার্ট যেটা বলেননি তা হল গাছকাটা চক্রের মাথায় রয়েছেন তাঁর সরকারেরই লোকজনেরা। মুনাফার সর্বগ্রাসী লোভে ধনতন্ত্র ও তার রাজনৈতিক প্রতিনিধি বলদর্পী শাসকেরা শুধু মানুষের শ্রম ও অধিকারের উপরেই তার থাবা বসায় এমনটা নয়, লোভ ও ক্ষমতার আগ্রাসন জারি রাখে প্রকৃতির ওপরেও। ঠিক যেমন করে ভারতের সমুদ্রবেষ্টিত লাক্ষাদ্বীপে নির্মাণ শিল্পের বিস্তৃতির জন্য কর্পোরেট শক্তি ও বলদর্পী শাসকরা তাদের থাবা বসিয়েছে, তেমনিই অ্যামাজন অরণ্যভূমির উপরেও কর্পোরেট শক্তি ও বলদর্পী শাসকরা আগ্রাসনের থাবা বসিয়ে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রকৃতিকে। সভ্যতাকে। নয়া উদারনীতির জমানায় এই আগ্রাসনের থাবা আরো বিস্তৃত হয়েছে। অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়েছে।
অরণ্যভূমি উজাড় পর্যবেক্ষণ প্রকল্প 'প্রোডাস' স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য জরিপ করেছে। অরণ্যভূমি হ্রাসের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে, হ্রাসের হার তার আগের ১২ মাসের তুলনায় ১৬ শতাংশ। ২০০৪ সাল এই হার কমেছিল ৭২ শতাংশ, সেসময় ব্রাজিলের ফেডারেল সরকার অরণ্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
সেসময় হাইতি'র সমপরিমাণ অরণ্য যার আয়তন ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। অ্যামাজনের এই অঞ্চলটিতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরহরিৎ অরণ্য অবস্থিত। যেখানে এখনো ১৯৬৫ সালের আইন জারি রয়েছে। যার অধীনে ভূমির মালিকেরা তাদের জমির কিছু অংশে বনসৃজন করতে বাধ্য।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অ্যামাজনের জঙ্গলের ভয়াবহ আগুনের কয়েকটি কারণকে যথার্থ ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত, বিভিন্ন কারণে বৃক্ষচ্ছেদন করে অরণ্যভূমি উজাড়, মনুষ্য প্রজাতির বসতি স্থাপন-সহ বিভিন্ন নির্মাণের উদ্দেশ্যে মানুষ নির্বিচারে এখানকার ঘন চিরহরিৎ বৃক্ষের অরণ্যভূমিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তার পর ছেদন করা বৃক্ষের প্রতিটি অংশ নিশ্চিহ্ন করতে তা শুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের জঙ্গলে। যা রূপ নিচ্ছে ভয়াবহ দাবানলের। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, কৃষির প্রসার। বসতি বাড়ার ফলে কৃষিজাত দ্রব্যের জোগান দেওয়ার জন্য স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী থেকে সাধারণ বাসিন্দারা কোনও বিবেচনা না করেই জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরি করার জন্যও একই পন্থা অবলম্বন করে অরণ্য বিনাশ করছে মানুষ। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’ ইতিমধ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে যে, অরণ্যভূমি ছেদন করতে যেখানে যান্ত্রিক প্রয়োগ ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে অরণ্যভূমি সাফ করতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যার ফল— মনুষ্যসৃষ্ট দাবানল।
লাগাতার খরার ঘটনাকে তৃতীয় কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যথেচ্ছ ভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন খরার তীব্রতাকে বাড়িয়ে তুলছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জমি মাফিয়াদের দুষ্টচক্র।
কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জলের অপ্রতুলতার কারণে জঙ্গল শুষ্ক হয়ে আগুন লেগে খরার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক সময়ে যে অরণ্য ‘ফায়ার প্রুফ’ নামে পরিচিত ছিল, সেই অরণ্যভূমি আজ এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত। যার থেকে রেহাই নেই এই অরণ্যভূমিতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রজাতির জীব এবং নৃ-প্রজাতির আদিম অধিবাসী মুরা, গুয়াত, নামবিকওয়ালা, ম্যাকিগোন জিভারে সিরিয়ানা, সেরিংগুইরো বা ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত অ্যামিরিন্ডিয়ানদেরও।
অ্যামাজনের এই দুর্দিনে আন্তর্জাতিক মহল আজ নড়েচড়ে বসছে। প্রশ্ন ওঠে, কেন তারা অ্যামাজনকে বাঁচাতে আর্থিক ও অন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে? এর একটাই কারণ— অ্যামাজনের এই চিরহরিৎ অরণ্যের প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলির জন্যই নয়। অ্যামাজন অরণ্য বিনাশ হলে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন চিরতরে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শিল্পোন্নত দেশগুলি সব চেয়ে বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করে। অ্যামাজন যে পরিমাণ বাড়তি অক্সিজেন সারা বিশ্বকে সরবরাহ করে থাকে, তার পরিবর্তে উন্নত তথা কার্বন-ডাই-অক্সাইডনিঃসরণকারী দেশগুলির পক্ষ থেকে কোনও প্রকার সহায়তা দান বা অন্য কোনও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে না। বাণিজ্যিক সহায়তা বা কৃষির জন্য অরণ্য উজাড় করা মানুষগুলির পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাও কোনও তরফ থেকে নেই। ফলশ্রুতিতে বিশ্ব উষ্ণায়ন ইতিমধ্যেই যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছি উষ্ণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি, অরণ্য ও জীববৈচিত্র।
বিশ্ব উষ্ণায়ন বৃদ্ধির জন্য যারা দায়ী, দায়বদ্ধতাও সব চেয়ে বেশি তাদেরই নয় কি? তবে ব্রাজিল সরকারের উপরেও নিশ্চিত ভাবেই এই দায় বর্তাবে। কারণ, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারো সরকার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে জঙ্গল উজাড় করে কৃষি ক্ষেত্র, বসতি এবং শিল্পাঞ্চল গড়ায় উৎসাহ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, বোলসোনারো সরকার ক্ষমতায় আসার পর অ্যামাজনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, সন্দেহের তীর ক্রমশই তীব্র হচ্ছে। মানবজাতির অস্তিত্বের স্বার্থে প্রতিটি দেশকে অ্যামাজনের বৃষ্টি বনানীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করতে হবে।