বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

শুল্ক যুদ্ধ: আমেরিকার বিশাল পশ্চাদপসরণ

শুল্ক যুদ্ধ: আমেরিকার বিশাল পশ্চাদপসরণ

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

আপনি যখন জিততে পারেন না, তখন শত্রুর চারপাশে বিশাল একটা দেওয়াল তুলে দেন। শত্রুর কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। চেষ্টা করেন শত্রু দেশগুলিও যেন একই কাজ করে। এমনই লিখেছে গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা। তাদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতি আসলে এই রকমই একটি বিষয়। ওই পত্রিকার নিবন্ধকারের ভাষায়, ‘ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে ‘মেকিং আমেরিকা গ্রেট আগেইন।’ অথচ শুল্কের নামে তারা যা করছে সেটা হল গ্রেট আমেরিকান রিট্রিট। এটা আসলে পরাজয়ের স্বীকৃতি। গত আট দশকে বিকাশশীল বিশ্বের উন্নতি হয়েছে। এই দেশগুলিতেই বিশ্বের অধিকাংশ লোক বাস করেন। বিশ্বমঞ্চে উত্থান হয়েছে ভারত ও চীনের। এবং বিশ্বায়নের প্রসার ঘটেছে। এই বিশ্বের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করতে চাইছেন ট্রাম্প। এটা আসলে প্রতিবিপ্লব এবং এই প্রতিবিপ্লব উন্নয়ন বিরোধী (উন্নয়নশীল দেশের বিরুদ্ধে উঁচু হারে শুল্ক আরোপ), দেশে ও বিদেশে বৈচিত্রের বিরোধী, বিশ্বায়ন বিরোধী, বিজ্ঞান বিরোধী (কোভিড ১৯ ও জলবায়ু পরিবর্তন) এবং শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী। গত আট দশকের যে উন্নয়ন তার সামনে দরজা বন্ধ করে দিতে চায় এই শুল্কনীতি।’ (দ্য ‘ট্যারিফ আর্মাগেডন’ উইল ওনলি আইসোলেট ইউ এস, গ্লোবাল টাইমস, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫)।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির লক্ষ্য কী? শুল্ক বাড়িয়ে কোটি কোটি ডলার আয় করতে চান ট্রাম্প। শুল্ক বাড়ানো মানে আসলে এই টাকাটা গুনতে হবে মার্কিন কোম্পানিগুলিকে এবং তারা সেই বোঝাটা চাপিয়ে দেবে উপভোক্তাদের ঘাড়ে। মানে শেষ পর্যন্ত পকেট কাটা যাবে সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের। বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দিতেই এই পদক্ষেপ। লক্ষ্য বাড়তি শুল্কের বোঝা চাপিয়ে বিশেষ করে আমেরিকার প্রতিযোগী চীনকে কোণঠাসা করা। কর্পোরেটকে বিপুল করছাড় জমিত ঘাটতি শুল্ক ও মূল্যবৃদ্ধির টাকায় মেটাতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। এই টাকায় বাড়াতে চায় মার্কিন সামরিক ক্ষমতা, যাতে বাড়তি শুল্ক মেনে নিতে এবং আমেরিকাতেই শিল্প গড়তে দেশি বিদেশি কোম্পানিকে বাধ্য করা যায়। চাকরির জন্য নয়, মার্কিন সামরিক শিল্পের স্বার্থেই আমেরিকায় উৎপাদন সরিয়ে আনতে চান ট্রাম্প। এব্যাপারে তাঁর যুক্তি অসাধারণ। “বহু দশক ধরে আমাদের দেশকে লুঠ করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে। বন্ধু ও শত্রু দেশ সবাই মিলে এটা করেছে।” অথচ একথাটা ট্রাম্প উচ্চারণ করছেনই না যে, এতদিন গোটা দুনিয়াকে শোষণ করে বড়লোকী চাল মেরেছে আমেরিকা। ভুলে গেছেন, আমেরিকার মদতে গাজায় চলছে গণহত্যা, চলছে ইরানকে বশ্যতা স্বীকার করানোর চেষ্টা। আজ যখন অন্যরা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের অর্থনীতিকে উন্নত করছে, তখন মার্কিন অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। তাদের লুঠের বাজার ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বহুপাক্ষিক বিশ্বের উত্থানই এর অন্যতম প্রধান কারণ। আর সেটাকে কোণঠাসা করতেই নিজেদের তৈরি করা বিশ্বায়নের পথের উল্টোপথে হেঁটে শুল্কের সংরক্ষণবাদের পাঁচিল তুলে ফের বিশ্বে একাধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করছে ট্রাম্পের আমেরিকা।
দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস জানাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধির হার এখন সবচেয়ে কম। এর ফলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১৪০ লক্ষ কোটি ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফান্ডের কর্তা ল্যারি ফিঙ্ক সম্প্রতি বলেছেন, সংরক্ষণবাদ পুরো দমে ফিরে এসেছে। লোকেরা এখন অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত। কারণ ২০০৮ সালের সাব প্রাইম সঙ্কট এবং ২০২০ সালে মার্কিন ফিনান্সের সঙ্কটের কথা লোকের মনে আছে। এর জেরে ২০২০ সালে আমেরিকার ট্রেজারি বন্ড মার্কেটে লেনদেন বন্ধ পর্যন্ত করে দিতে হয়েছিল। ট্রাম্পের এই আক্রমণাত্মক শুল্ক নীতির পিছনে রয়েছে মার্কিন অর্থনীতির বিপুল ঘাটতি। ২০২৪ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯১,৮০০ কোটি ডলার, যা ২০২৩-এর তুলনায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
ট্রাম্প বলছেন, তাঁর শুল্ক নীতি ঘাটতি মেটাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করবে। অথচ ক্যাপিটাল ইকনমিকস সংস্থা জানাচ্ছে, বাড়তি শুল্কে আমেরিকার বড় জোর ৮০,০০০ কোটি ডলার আয় হবে। আর আমেরিকার ঋণের বোঝা এখনই দাঁড়িয়েছে ৩৬ লক্ষ কোটি ডলার এবং প্রতি বছর এটা বাড়ছে ১ লক্ষ কোটি ডলার করে। একদিকে মার্কিন ডলারের মূল্য কমিয়ে নিজেদের রপ্তানি বাড়াতে চায় আমেরিকা। ফলে বিশ্ব বাজারে সস্তা হচ্ছে মার্কিন পণ্য। অন্যদিকে, সঞ্চয়ের মুদ্রা হিসাবে ডলারের মান কমছে। এবং ট্রাম্প হুমকি দিচ্ছেন যে কোনও মূল্যে ডলারকে সঞ্চয়ের মুদ্রা রাখতেই হবে। সেকারণে ব্রিকস যখন বি-ডলারিকারণের কথা তোলে তখন ব্রাজিল ও ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন ট্রাম্প। এমন স্ববিরোধী নীতি দিয়ে ডলারের মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা হাস্যকর প্রয়াস মাত্র। আমেরিকা তার আধিপত্যে একমাত্র রাখার চেষ্টা করতে পারে সামরিক আগ্রাসনের হুমকি দিয়ে। তবে পৃথিবী যেদিকে এগোচ্ছে তাতে কতদিন সাম্রাজ্যবাদী হুমকিতে কাজ হবে বলা যায় না। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ প্রমাণ করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে কিছুই করতে পারেনি আমেরিকা। বরং, এখন পুতিনকেই লাল কার্পেটে অভ্যর্থনা করতে হচ্ছে ট্রাম্পকে। আর ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি ইউরোপের সাবেক উপনিবেশবাদী দেশগুলিকে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত করেছে। ইউরোপ ও ন্যাটো-র নেতারা জেলেনস্কির পিছু পিছু ট্রাম্পের দরবারে গিয়ে কার্যত জো হুজুর হয়ে দাঁড়ালেন। প্রায় জোড়হস্ত হয়ে ইউক্রেনের স্বার্থ রক্ষা করে যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানালেন, তাতে তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে গেল।
চীন সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব থেকেই তাদের নিজেদের আশঙ্কাটা স্পষ্ট। হোয়াইট হাউজ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, চীন শুধু প্রতিযোগিতাতেই আমেরিকাকে পিছনে ফেলে দেয়নি, একই সঙ্গে মার্কিন অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের জন্য বিদেশি সাপ্লাই চেনের ওপর দেশের নির্ভরতা বাড়িয়ে তুলে। একই ভাবে প্রতিদিনের প্রয়োজন মেটাতেও ভরসা করতে হচ্ছে বিদেশের ওপর। তার মানে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে আমেরিকা ধরে রাখতে চাইছে সামরিক অধিপত্যকে। শুল্কের সংরক্ষণবাদ আসলে তারই প্রস্তুতি। শুল্ক যুদ্ধ তাই আসল যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। আগেকার দিন হলে এই প্রশ্নেই যুদ্ধ বেধে যেত। পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে যুদ্ধে পদানত করে উপনিবেশ দখল করেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি। আর এখন যুদ্ধের সীমারেখাটাই ঝাপসা হয়ে গেছে। অনেক সময় অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রকৃত যুদ্ধ। [ট্রাম্প’স রেসিপ্রোকাল ট্যারিফস এসকালেট ইকনমিক ওয়র এগেনস্ট দ্য ওয়ার্লড, ওয়ার্লড সোশালিস্ট ওয়েবসাইট (ডব্লিউএসডব্লিউএস), ৩ এপ্রিল, ২২৫, নিক বিমস]
শুল্ক বৃদ্ধি উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় বর্গের দেশগুলির অর্থনীতিতেই সমস্যা তৈরি করে। শুল্ক বাড়লে দেশের বাজারে জিনিসের দাম বাড়বে। আমদানি শুল্ক বাড়লে তার বোঝা শেষ বিচারে গিয়ে পড়বে শ্রমজীবী মানুষের ঘাড়ে। দেশে ও বিদেশে তৈরি জিনিসের ক্রেতা হলেন সাধারণ শ্রমজীবী বা মধ্যবিত্ত মানুষ। তার মানে শুল্ক থেকে আয় হয় সরকারের, কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় সাধারণ মানুষের।
শ্রমজীবী মানুষের আয় যেহেতু কম, তাই তাদের আয়ের বেশির ভাগ টাকা খরচ হয় খাওয়া-পরা, বাড়ি ভাড়া ও যাতায়াতে। তার মানে শুল্কের কারণে জিনিসের দাম বাড়লে আয়ের
বেশি অংশ শ্রমজীবীদের খরচ করতে হবে ওই তিনটি খাতে। কারণ বাড়তি দামে আগের মতো কেনাকাটা করা সম্ভব হবে না। তাদের জীবনযাত্রর মান আরও কমবে। কিন্তু বিপুল কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের। তাতে সরকারি ঘাটতি বাড়বে — তা পূরণ হবে শুল্কের টাকায়। মানে বাড়তি দাম চাপিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কেটে ঘাটতি মেটাবে সরকার।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে জিনিসের চাহিদা কমবে। আবার বেশি শুল্কের কারণে বহু দেশের রপ্তানি কমছে। ফলে সেই সব দেশে বাড়বে মজুরি হ্রাস ও বেকারি। যেহেতু বেশির ভাগ দেশই আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভরশীল, তাই সেখানে চাহিদা সংকোচন মানে গোটা বিশ্বে চাহিদার সংকোচন। মানে আরও মজুরি ছাঁটাই এবং আরও বেকারি। এই ভাবেই বাড়তি শুল্কের চাপ গোটা বিশ্বে মোট চাহিদা কমাবে এবং মজুরি হ্রাস ও কর্মসংকোচন বাড়াবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চাহিদার সংকোচন থেকে মন্দার সৃষ্টি হবে। যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ফান্ডের কর্তা ল্যারি ফিঙ্ক সম্প্রতি বলেছেন, “লোকেরা এখন অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা চিন্তিত, ইদানীং কালে তা দেখা যায়নি।” এক্ষেত্রে লিবারাল বুর্জোয়ারা যা বলে থাকে, অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিরই উচিত বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটমোচনে এগিয়ে এসে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে চাহিদার সৃষ্টি করা এবং মোট চাহিদা বাড়িয়ে তোলা। ১৯৩০ সালে মহামন্দার সময় কেইনসীয় অ্রর্থনীতি এই সমাধান সূত্রই দিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের চাপে পড়ে সেই পখ ধরতে হয়েছিল পুঁজিবাদী দেশগুলিকেও।
এখন আমেরিকা ও উন্নত বিশ্ব সেই কাজটা করার বদলে সংরক্ষণের পাঁচিল তুলে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে আর তার ফলে গোটা বিশ্বে অর্থনীতির সঙ্কট আরও ঘনিয়ে তুলছে। ট্রাম্প যা করছেন সেটাই পুঁজিবাদের ধর্ম। পুঁজিবাদ পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করে না। ফলে পুঁজিবাদ নিজে থেকে কোনও সঙ্কটের সমাধান করতে পারে না। ট্রাম্পের এখনকার নীতি হল আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তাই ট্রাম্প শুরু করছেন চড়া শুল্ক হেঁকে। পরে কিছুটা কমিয়ে দিয়ে ঢালাও মার্কিন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশে বিনা শুল্কে বিক্রির ব্যবস্থা করছেন। এভাবে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে বাকি বিশ্বকে ডুবিয়ে দেওয়ার যে ট্রাম্পোনমিকস, তাতে পুঁজিবাদী বিশ্ব তো বটেই, বিশেষ করে ডুববে দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়নশীল দেশগুলি। (প্রভাত পট্টনায়েক, আ লেস নোটিসড ইমপ্লিকেশন অব ট্রাম্পস ট্যারিফস, পিপলস ডেমোক্রেসি, আগস্ট ১৭, ২০২৫)।
ট্রাম্পের এই হুমকির সামনে গোটা দুনিয়া মাথা নত করেনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা জানিয়ে দিয়েছেন, আমেরিকা তাঁদের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপালে তাঁরাও পাল্টা একই হারে শুল্ক চাপাবেন। এর আগে ট্রাম্প যখন বলেছিলেন কানাডাকে দেশের একান্নতম প্রদেশ করে নেবেন, তার প্রতিবাদ করেছিল কানাডা। ট্রাম্প বলেছিলেন, মেক্সিকো উপসাগরের নাম তিনি বদলে দেবেন। তখন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট বলে দেন, উপকূলের ৩৫ কিমি জলসীমার মধ্যে নাম বদলানো যায় না। তাই ওই জলভাগের নাম মেক্সিকো উপসাগরই থাকবে। রাশিয়ার কাছে থেকে তেল কেনার জন্য চীনকে ইচ্ছেমতো শুল্কের শাস্তি দিতে পারেননি ট্রাম্প। কারণ রাশিয়ার শোধন করা তেল চীনের কাছ থেকে কেনে ইউরোপ। সেই সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সঙ্কটে পড়বে ইউরোপ। বিশ্ব বাজারে বাড়বে তেলের দাম। অর্থনীতির এই কারণেই চীনের সঙ্গে পেরে উঠছেন না ট্রাম্প।
অথচ ভারতের মতো দেশ আমেরিকার শুল্ক হুমকির মুখে দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। ট্রাম্পের নির্দেশ মেনে রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করেনি ভারত। মার্কিন হুমকির জেরে কাছাকাছি আসছে চীন ও রাশিয়ার। তবে ২৭ আগস্ট থেকে ৫০ শতাংশ হারে মার্কিন শুল্ক জারি হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। এতদিন পর্যন্ত ভারত তার কৃষি ও ডেয়ারি ক্ষেত্র বিদেশি পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করেনি। সেই ক্ষেত্রটি খোলার জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। সেই জন্যও শুল্কের চাপ দিয়ে রেখেছেন তিনি। মোদী জানেন, কৃষি ও ডেয়ারি ক্ষেত্র খুলে দিলে তিনি ভোটে হারবেন। তবে ট্রাম্পও ছাড়তে রাজি নন। ফলে সমঝাতা করে ‘অসংবেদনশীল’ কৃষি পণ্যের বাজার আমেরিকার কাছে খুলে দিতে চায় ভারত। ‘অসংবেদনশীল’ বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে সেই পথে কৃষকদের সর্বনাশ করা হবে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।
আসলে আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে চাই রাজনৈতিক ইচ্ছা যা আবার আসে অর্থনীতির শক্তি থেকে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ভারতের অর্থনীতির ভিত ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র। তখন ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে চলত। এই দুই কারণে যুদ্ধজাহাজ পাঠানো সত্ত্বেও আমেরিকার চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সাহায্য করেছিল ভারত। এখন বিজেপি ও মোদীর আমলে জোটনিরপেক্ষতা নীতি বিসর্জন দিয়ে ভারতকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মার্কিন শিবিরের দিকে। আর অর্থনীতিও এমন ভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে যাতে আদানি, আম্বানিদের মতো ধনকুবেরদের সম্পদ বৃদ্ধি হচ্ছে। সম্পদের বৈষম্যকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই ব্রিটিশ আমলের স্তরে। এদেশে আয়হীন, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। চীন আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কারণ সেদেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের জোরালো হস্তক্ষেপে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ে। তাদের অর্থনীতি অনেকটাই দাঁড়িয়ে থাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের শক্তির ওপর। শুল্কের কারণে রপ্তানির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে এখন চীন সরকার দেশের লোকের আয় বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারকে আরও প্রসারিত করছে। এটা পরিকল্পনার একটা অংশ। তাছাড়া বহু ক্ষেত্রে চীন আমেরিকাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে (রেয়ার আর্থ সাপ্লাই চেন, এআই প্রযুক্তি, বিকল্প শক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে)। রাশিয়ার শক্তি তার অঢেল জ্বালানির ভাণ্ডার। সেই জ্বালানি বিক্রি করে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধকে পঙ্গু করে দিয়েছে রাশিয়া। সেই জন্য চীন বা রাশিয়া আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিতে পারে মূলত অর্থনৈতিক শক্তির জোরে, যে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে রাষ্ট্রের। অথচ গত দুটি দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র থেকে সরে এসে এবং দেশি বিদেশি পুঁজির কাছে অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে মোদী সরকার। দেশের অর্থনীতির ভিত একেবারে দিশাহীন। তাই আমেরিকার সঙ্গে সঙ্ঘাতে যাওয়ার জন্য তার একমাত্র হাতিয়ার কূটনেতিক কলাকৌশল। কিন্তু যদি অর্থনীতি দুর্বল হয় তাহলে শুধু কূটনীতি রক্ষা করতে পারে না। সেকারণেই ভারতকে তার বিশাল কৃষিপণ্যের বাজার খোলার জন্য চাপ দিচ্ছেন ট্রাম্প। তিনি বন্ধু মোদিকে চেনেন। এবং জানেন, ধাপে ধাপে মোদী সরকারের কাছ থেকে কীভাবে ছাড় আদায় করতে হয়। আপনার যদি সঙ্ঘাতে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সমঝোতার পথেই হাঁটতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.