বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে ভারতে তথা এই বাংলায় লেখালেখি তো কম হল না। গণঅভ্যুত্থানের কাহিনী, ভারতবন্ধু শেখ হাসিনার পলায়ন ও ভারতে আশ্রয়, দ্বিতীয় স্বাধীনতার মুক্তির সাময়িক আনন্দ থেকে মৌলবাদী শক্তির কর্তৃত্ব দখল নিয়ে দুশ্চিন্তা, হিন্দু নিপীড়নের প্রতিবাদ থেকে ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের নস্টালজিয়া — এই বাংলায় সাম্প্রতিক কালে অন্য কোনও দেশ নিয়ে এত উন্মাদনা দেখা যায় নি। কিন্তু এর মধ্যে বাংলাদেশের অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর কি হাল তার খবর আমরা রাখিনি। কারণ আমাদের বাংলাদেশ চেতনার মূলে রয়েছে, বাংলা ভাষাভিত্তিক উপজাতীয়তাবাদের চেতনা, সেই চেতনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের রুটির রুজির খবরের স্থান নেই।
বাংলাদেশের শ্রমিকের অন্যতম অংশ প্রায় ৪৫ লক্ষ বস্ত্র শ্রমিক যার আশি ভাগ মহিলা। বস্ত্রশিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি রোজগারের মুল ভিত্তি, ৩৫০০টি ফ্যাক্টরি থেকে উৎপন্ন বস্ত্র সামগ্রীর প্রায় সবটাই রপ্তানি হয়। বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ ভাগ রপ্তানি রোজগার এই বস্ত্র রপ্তানি থেকেই আসে। চীন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরেই বিশ্বে বস্ত্র রপ্তানিতে বাংলাদেশের স্থান। পৃথিবীর তাবড় তাবড় বস্ত্রপ্রস্তুতকারী সংস্থার ফ্যাক্টরি আছে বাংলাদেশের আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, গাজীপুর অঞ্চলে। গত ৫ই আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের মধ্যেই বাংলাদেশ বাংলাদেশ গারমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়শন অনির্দিষ্টকালের জন্য ফ্যাক্টরিগুলি বন্ধ রাখার ডাক দিয়েছিল। কিছু ফ্যাক্টরি তা সত্ত্বেও সকালে কাজ শুরু করে, কিন্তু বেলা গড়ানোর আগেই লুটতরাজ ও খুনোখুনি শুরু হয়ে যাওয়ায় ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তারই মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক বেশ কিছু ফ্যাক্টরি মালিকের কারখানায় লুটতরাজ ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের অন্যতম বস্ত্র রপ্তানি সংস্থা বেক্সিমকো-র কর্ণধার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্বতন শিল্প উপদেষ্টা সলমান রহমান গ্রেপ্তার হন, এবং তাঁর আটটির মধ্যে তিনটি কারখানায় অগ্নিসংযোগ হয়। অন্য দিকে একাধিক আন্তর্জাতিক ব্রান্ড বাংলাদেশ থেকে তাদের ক্রিসমাস অর্ডার সরিয়ে নিতে শুরু করে। শুধু বস্ত্র শিল্প নয় বাংলাদেশের চর্মশিল্পও একই রকম ধাক্কা খায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা যত ব্যাপক ও গভীর হতে থাকে, ততই রপ্তানি ব্যবসা মার খেতে থাকে আর শ্রমিকেরা কাজ হারাতে থাকে।
আগস্ট মাসের শেষ থেকেই শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়, মূলত বকেয়া মজুরি ও অন্যান্য দাবিতে। আন্তর্জাতিক স্তরের ইউনিয়নগুলিও এই সব আন্তর্জাতিক ব্রান্ডগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে তারা বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সরিয়ে না নেয়। শ্রমিক আন্দোলনের দাবিগুলি নতুন নয় – নাইট শিফট এর মজুরি বাড়ানো, দুপরের খাবারের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা শ্রমিকদের কাজের ভার কমানো, বকেয়া মজুরি মেটানো ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন চলছিল। কিন্তু আন্দোলনের দোহাই দিয়ে প্রায় ২০০টি ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার সঙ্গে লুটতরাজ, আগুন লাগানো, ইত্যাদি গণ্ডগোলের জেরে কিছু শিল্প তালুকে মিলিটারি নামাতে হয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে এই আন্দোলন চলতে থাকে, মালিক পক্ষের হুশিয়ারিকে পরোয়া না করেই। আন্দোলনের প্রভাবে শ্রম মন্ত্রক থেকে শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং ২৪শে সেপ্টেম্বর মালিকপক্ষ সরকার ও শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে একটা চুক্তি হয়, শ্রমিকদের অনেকগুলি দাবিই সরকার মেনে নেয়। আশুলিয়া শিল্প অঞ্চলে সেই রফাসুত্রগুলি পালিত হলেও অন্য শিল্পাঞ্চলগুলিতে শ্রমিকদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। শ্রমিকদের আন্দোলনের জেরে ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পুলিশের গুলিতে একজন শ্রমিক নিহত হন, ২০ জনের বেশি শ্রমিক আহত হন। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। অক্টোবর ও নভেম্বর মাস জুড়ে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের আন্দোলন চলতেই থাকে। নভেম্বরের শেষে এসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বস্ত্র শিল্পের গ্রুপ বেক্সিমকো ৪০ হাজার শ্রমিককে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের মালিকের গ্রেপ্তারির পর থেকেই ওই কোম্পানিটি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল, কিন্তু তবু উৎপাদন চালু ছিল। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ থেকে ছাঁটাই কার্যকরি হয়। শুধু বেক্সিমকো নয় অনেক রপ্তানিকারক সংস্থাই এখন ক্রমশ ছাঁটাই এর পথে হাঁটছে কারণ ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্রান্ডগুলির একাংশ, বাংলাদেশ থেকে তাদের আমদানি প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বস্ত্র শ্রমিকদের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।