বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
বিনা প্ররোচনায় ইরানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাত এবং ইজ়রায়েলের সরাসরি আক্রমণে নিহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ সেনা প্রধান, ১৪ জন সামনের সারির পরমাণু বিজ্ঞানী এবং বহু সাধারণ মানুষ। এই আক্রমণ ছিল ইরানের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার উপর নির্লজ্জ আক্রমণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইরান যথার্থভাবেই তার সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকদের রক্ষার জন্য ইজ়রায়েলকে কঠিনভাবে প্রত্যাঘাত করে। এত দিন ইজ়রায়েলের আক্রমণে গাজ়া, লেবানন, সিরিয়ায় ধ্বংসযজ্ঞ পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। এবার কঠোর নিষেধাজ্ঞায় থাকা ইরান যে এভাবে শক্তিশালী মিসাইল, ড্রোনের আঘাতে ইজ়রায়েলকে পর্যুদস্ত করবে, সমর বিশারদরাও কল্পনা করতে পারেননি।
স্বঘোষিত শান্তির ফেরিওয়ালা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইজ়রায়েলের ইরান আক্রমণের সমর্থনে দাঁড়ান। বলেছিলেন, ইরানকে পরমাণু বোমা বানাতে দেওয়া যাবে না। ইজ়রায়েল আমাদের বহুদিনের বিশ্বস্ত মিত্র। আমরা একসঙ্গে টিম হিসেবে কাজ করছি। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে আমেরিকা ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্রে বোমা বর্ষণ করে। যদিও বোমা বর্ষণের কার্যকারিতা নিয়ে আমেরিকার গোয়েন্দারাই সন্দেহ করেছেন। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সুরক্ষার অধীনে থাকা ইরানের পরমাণু কেন্দ্রেগুলিতে আক্রমণ করে, ওয়াশিংটন একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করে। ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে বোমা বর্ষণের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমনকী তার দেশের কংগ্রেসের প্রয়োজনীয় অনুমোদন পর্যন্ত নেননি। তার থেকে বড় কথা ইরানের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হেনেছেন।
এই আক্রমণ ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছিল। যুদ্ধ বিরতি ভেঙে ইজ়রায়েল নির্মমভাবে গাজ়ায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ইজ়রায়েলের আগ্রাসনে গাজ়ায় ৫৫ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ আহত। আহত ও নিহতদের ৬৫ শতাংশ শিশু ও নারী। অবরুদ্ধ গাজ়ার মানুষরা বিপজ্জনকভাবে অনাহার ও মহামারির মুখে, কার্যত আশ্রয়হীন। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক ত্রাণ পাঠাবার রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। পৃথিবী জুড়ে গাজ়া গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও ইজ়রায়েল ও তার মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছে। বিশ্ব জনমতের তোয়াক্কা না করে এই দুই রাষ্ট্র রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে এবং নিরাপত্তা পরিষদে বারবার গাজ়ায় যুদ্ধ-বিরতি, ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো এবং স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর নিজের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গাজ়ায় গণহত্যা বন্ধ ও স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিতে প্রতিবাদ নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন।
নেতানিয়াহু বৃহত্তর ইজ়রায়েল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উগ্র বাসনায় গাজ়া এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম পারে প্যালেস্তাইন ভূমিতে কার্যত দখলদারি কায়েম করেছে। প্যালিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বহিষ্কার করাই ইজ়রায়েলের লক্ষ্য। যাতে স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের দাবিকে চিরতরে বাতিল করা যায়। ইজ়রায়েল লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে এবং রাজধানী বেইরুটে বার বার প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে গেছে। এমনকী যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করে এখনও লেবাননে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদের পতনের পর ইজ়রায়েল গোলান মালভূমি সহ বিস্তৃত এলাকা দখল করে নিয়েছে।
আমেরিকা ইজ়রায়েলকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করেছে তাদের নয়া উপনিবেশবাদী অভিলাস পূরণের জন্য। মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ আর নেতানিয়াহুর বৃহত্তর সাম্রাজ্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্য একাকার হয়ে গেছে। আমেরিকার অর্থ, যুদ্ধাস্ত্র, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যকে হাতিয়ার করে ইজ়রায়েল মধ্য প্রাচ্যে আগ্রাসী সামরিক রাষ্ট্র হিসেবে আঞ্চলিক প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলির কাছে ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে ইজ়রায়েলের আগ্রাসন কাজ করল না।
আমেরিকা পোষ-না-মানা দেশগুলির শাসন পরিবর্তনের (রিজ়ম চেঞ্জ) জন্য একের পর এক যুদ্ধে গেছে। কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে। লিবিয়া-ইরাকে প্রকাশ্যে, সিরিয়ায় গোপনে। আমেরিকার ইজ়রায়েল লবি এবং ডিফেন্স লবি এই সমস্ত যুদ্ধে বড় ভূমিকা নিয়েছে। যুদ্ধ চলতে থাকলেই তাদের মুনাফা। জর্জ বুশ থেকে বারাক ওবামা, জো বাইডেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প একই নয়া উপনিবাদী অভিলাসকে চরিতার্থ করতে যুদ্ধগুলি চালিয়ে গেছেন। কিন্তু ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় যত অনায়াসে শাসন পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে, ইরানে তা সম্ভব ছিল না।
১৯৯২ সাল থেকে বার বার ইজ়রায়েল অভিযোগ করে আসছে, ইরান পরমাণু বোমা বানানোর সামান্য দূরে আছে। চেষ্টা করেছে আমেরিকাকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে টেনে নামাতে। এবারেও ইজ়রায়েল, ইরান আক্রমণে তিন দশকের পুরোনো অভিযোগকে হাতিয়ার করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথাতেও সেই মিথ্যার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত প্রতিধ্বনি শোনা যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ইরানকে পরমাণু বোমা বানানো বন্ধ করতে হবে। কানাডায় জি-সাতের বৈঠকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির সেই কথার প্রতিধ্বনি। ট্রাম্প রীতিমতো হুমকি দিয়ে ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। পরে ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে আমেরিকার বোমা বর্ষণ করে পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দেন। ন্যাটোর অধিবেশনে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে আমেরিকার বোমা বর্ষণকে সমর্থন জানায়।
যে কটি হাতে গোনা দেশ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেনি তার মধ্যে অন্যতম যুদ্ধবাজ ইজ়রায়েল। এনপিটি-তে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে ইরান অন্যতম। ইরান শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরমাণু শক্তি ব্যবহার করে বলে বার বার ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় ছিল ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলি। আইএইএ প্রধান জানান, ইরান প্রযুক্তিগতভাবে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার থেকে দূরে আছে। আমেরিকার গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গাবার্টও সেই তথ্য জানিয়েছিলেন।
তবে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেবল পরমাণু বোমা তৈরি করার কাজে লাগে এমনটা নয়, পরমাণু বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনেও প্রয়োজন হয়। শান্তিপূর্ণ কাজে ইরানের পরমাণু শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইরানের পাঁচ দফা আলোচনা হয়েছিল। ওই আলোচনাগুলিতে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে আমেরিকার পরিদর্শনেও ইরান সম্মতি জানিয়েছিল। ষষ্ঠ দফা বৈঠকের দিনও স্থির হয়েছিল। সেই আলোচনাকে ভেস্তে দিতে ইজ়রায়েল সরাসরি ইরান আক্রমণ করে।
১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরান আমেরিকার বিরাগের কারণ। আয়াতোল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরান বিপ্লব ওই দেশকে আমেরিকা ও পশ্চিমের বন্ধন থেকে মুক্ত করে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলেন। ১৯৮০র দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধে আমেরিকা ইরাককে সমর্থন করেছিল মূলত ইরানকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে, সেই আমেরিকা ইরাককে ধ্বংস করে। আবার ইরানের বিকাশকে প্রতিহত করতে আমেরিকা আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ট্রাম্পের প্রথম দফায় ৮ মে, ২০১৮ আমেরিকা একতরফাভাবে নিজেকে ইরান পরমাণু চুক্তি নামে খ্যাত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। জেসিপিওএ ছিল ২০১৫ সালে ইরান এবং পি৫+১ (আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি) এর মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি। যার লক্ষ্য ছিল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করা। আমেরিকা ওই চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের ফলে ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আবার কঠোরভাবে আরোপিত হয় এবং অন্যান্য দেশগুলিকেও ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়।
এবারে ইজ়রায়েল তাদের সামরিক আগ্রাসনের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইরানের রাজতন্ত্রের প্রতীক ছিল সিংহ ও উদীয়মান সূর্য। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের পরে ইরান তাদের জাতীয় পতাকায় ওই প্রতীক পরিবর্তন করে। সুতরাং ইঙ্গিতটি স্পষ্ট, ইরানের শাসন পরিবর্তনই ছিল ইজ়রায়েলের লক্ষ্য। ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে ‘প্রতীকী’ বোমা ফেলে বিশ্বস্ত ইজ়রায়েলকে বার্তা দিয়েছিলেন ট্রাম্প, আমরা তোমাদের পাশে আছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ইরাক যুদ্ধের সময়ে নেই, পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। একমেরু বিশ্বে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনীর কাছে দ্রুত সাদ্দাম হুসেনের শাসনের পতন ঘটেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল ভয়াবহ সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য — জন্ম হয়েছিল ভয়ঙ্কর আইসিসের। আমেরিকাকে তার দায়ভার নিতেই হবে।
এখন বহুমেরু বিশ্বের দিকে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে পৃথিবী। আমেরিকা ও পশ্চিমের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে বহুপাক্ষিক মঞ্চ ব্রিকস। যে ব্রিকসে আছে চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মধ্য প্রাচ্যের সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরশাহী, ইরান, মিশরের মতো দেশগুলি। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের বৈরীতার অবসান ঘটেছে। মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলি দ্রুত যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান চাইছিল। ইরানে ইজ়রায়েলে সামরিক আক্রমণ ও সেখানে পরমাণু কেন্দ্রে মার্কিন বোমার বিরুদ্ধে চীন, রাশিয়া কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কাতারে অবস্থিত মধ্য প্রাচ্যে বৃহত্তম মার্কিন বায়ু সেনা ঘাঁটিতে ইরান মিসাইল হামলা চালায়। কাতার কড়া ভাষায় নিন্দা করে। কিন্তু ইরান জানায়, এই হামলা কাতারের বিরুদ্ধে নয়। ট্রাম্প বোঝেন ঘরে-বাইরে অবস্থা বেগতিক। তিনি দ্রুত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন। এইভাবে মধ্য প্রাচ্যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির আপাতত যবনিকা পড়ল। মনে হয়, আপাতত ইরানের শাসন পরিবর্তন হল না।