বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

জলবায়ু সঙ্কট সমাধান করতে হলে

জলবায়ু সঙ্কট সমাধান করতে হলে

সমুদ্র দত্ত

photo

উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন আজ বিশ্বজোড়া চ্যালেঞ্জ হিসেবে মানব সভ্যতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। মেরু এলাকা এবং হিমালয় ও সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গে তুষারস্তর ও হিমবাহ গলে যাচ্ছে। সমুদ্রের জলস্তর স্ফীত হচ্ছে। যথেচ্ছ অরণ্য ধ্বংস, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন পরিষেবায় নিয়ন্ত্রণহীন জীবাশ্ম জ্বলানির ব্যবহার বিশ্বের প্রাণের অস্তিত্ব এবং প্রকৃতিকে প্রায় ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে।
দিল্লি সহ ভারত ও পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরের বিষাক্ত বাতাস, ফিলিপাইন্স এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে একের পর এক টাইফুন, ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা সংলগ্ন উপকূল জলের তলায় ডুবে যাওয়ার বিপদ, দুবাইয়ে রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি, ইউরোপে তাপ-প্রবাহ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অ্যালবার্টো ও হেলেনার মতো অসংখ্য সামুদ্রিক ঝড়, স্পেনের বন্যা, ব্রাজিল, কেনিয়া, চীনে বন্যা, বাংলাদেশ এবং ভারতের পূর্ব উপকূলে বার বার সাইক্লোন, সাহারা মরুভূমিতে বৃষ্টি, কেরালায় ওয়াইনাড এবং পাপুয়া নিউ গিনিতে ভূমিধ্বস সমস্যার গভীরতা বুঝিয়ে দেয়। প্রতিটি ঘটনা অসংখ্য প্রাণ ও বিপুল সম্পত্তির ধ্বংস ডেকে আনছে। জলবায়ু সঙ্কট কোনও দেশের সীমানা মানে না। এক একটা জলবায়ু সম্মেলন হয়ে চলেছে -সময়ের ঘড়িটা এগিয়ে চলেছে আর আমরা সর্বনাশের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলেছি।
জলবায়ু সঙ্কট আচম্বিতে তৈরি হয়নি। কয়েক দশক ধরে নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী, শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে ধরলে সাড়ে তিন শতাব্দী ধনতান্ত্রিক আধিপত্যবাদীদের প্রকৃতির সঙ্গে বৈরীমূলক আচরণের পরিণতিতে প্রকৃতির এই ভয়াল রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। পুঁজির আদি সঞ্চয় হয়েছিল এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলি লুঠ করে। সেই আদি সঞ্চয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল ধনতন্ত্র। শ্রমজীবীদের শ্রম শোষণ ও প্রকৃতির সম্পদ লুঠ করে টিকে থাকতে তারা উপনিবেশগুলি দখল করেছিল -নিঃস্ব করেছে সেই সব দেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে। আজ উপনিবেশবাদ ইতিহাস হয়ে গেলেও ঐতিহাসিকভাবে বাতিল হয়ে যাওয়া ধনতন্ত্র টিকে থাকতে চেষ্টা করছে মানুষের শ্রম ও প্রকৃতিকে লুঠ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান দায় উন্নত ও ধনী দেশগুলির। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা সারা পৃথিবীর প্রকৃতিকে ধর্ষণ করে চলেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর গড়ে ওঠা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপদেশ দিচ্ছে, তোমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। উন্নত ও ধনী দেশগুলির মূল বক্তব্য জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলার দায়িত্ব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির সবার সমানভাবে নিতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের দায় তারা সারা বিশ্বের উপর চাপাতে চাইছে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে যে, ২৩টি শিল্পোন্নত ধনী দেশ ঐতিহাসিক কার্বন নিঃসরণের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী। ইতিমধ্যে যে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরবর্তী ৫০ থেকে ১০০ বছরে যে উষ্ণায়ন ঘটবে তার জন্য ধনী দেশগুলি বেশিরভাগই দায়ী। আমেরিকা ও ট্রাম্প তো জলবায়ু সঙ্কটকে সরাসরি অস্বীকার করেছে।
ভারত, চীন সহ দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি বাতাসে যে কার্বন ছাড়ে তা শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর -৭৫ থেকে ৭৭ বছর ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তারা যতটা দায়ী তা সমাধানের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে -বিশেষ করে ভারত, চীনের মতো বড় অর্থনীতির দেশ এবং কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মতো জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ ধনী দেশগুলিকে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলির মতো সমানুপাতিক হারে নয়।
আজ়ারবাইজানে জলবায়ু সম্মেলনের পর রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাক্তন ডেপুটি সেক্রেটারি-জেনারেল এরিক সোলহেইম বলেছেন, জলবায়ু সঙ্কটে কোনও দেশ যদি সব থেকে বেশি অবদান রাখে, তবে তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজ অবধি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণ চীনের প্রায় ৮ গুণ এবং আফ্রিকান দেশগুলির তুলনায় ২৫ গুণ। অতএব, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলা এবং সমাধান করতে যদি কোনও দেশের আরও বেশি বাধ্য হওয়া উচিত, তা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এই সঙ্কটের দায় তারা নিচ্ছে না। ট্রাম্পের আমেরিকা সম্পর্কে একথা আরও বেশি সত্য। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলার কার্যক্রমে অংশ না নেয়, তবে তারাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। পৃথিবীর সমস্ত দেশকে জলবায়ু সমস্যার সমাধান করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
২০০৯ সালেই বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় পশ্চিমের ধনী ও উন্নত দেশগুলি নামমাত্র দায় নিয়েছিল। তারা জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় বছরে মাত্র ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডের দায়িত্ব নেয়।
জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড কোনওভাবেই যুক্তিসঙ্গত ছিল না। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলি নিজেরা একক ও যুক্তিহীনভাবে ওই পরিমাণ ঠিক করেছিল।
এরপর অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা দীর্ঘ গবেষণা ও হিসেব কষে দেখেছেন, গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃস্বরণ কমানোর জন্য এবং বিশ্ব উষ্ণয়নের পরিণতিকে প্রতিহত করার জন্য, বছরে ২.৪ ট্রিলিয়ন ডলার দরকার। তার মধ্যে বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হবে উন্নত দেশগুলিকে। বাকিটা সংগ্রহ করবে উন্নয়নশীল দেশগুলি নিজেরা। ব্রাজিল প্রস্তাব করেছে, বিলিয়নারদের উপর ২% জলবায়ু ট্যাক্স ধার্য করার, যে ট্যাক্সের মাধ্যমে একমাত্র ব্রাজিলেই বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব। ব্রাজিলের প্রস্তাব মতো সারা পৃথিবীর ধনকুবেরদের উপর জলবায়ু ট্যাক্স আদায় এবং দুষণ সৃষ্টিকারী শিল্পগুলির উপর জরিমানা আদায় করে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব।
কেন উন্নত দেশগুলিকে বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার দিতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নয়। এটি জলবায়ু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
উন্নত দেশগুলির আর্থিক সঙ্গতি আছে তেল ও গ্যাসের বদলে গ্রীন এনার্জির জন্য পুঁজি বিনিয়োগের। তার সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তি তাদের আছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির, বিশেষ করে তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও ছোট দেশগুলির উন্নত প্রযুক্তি ও আর্থিক সঙ্গতি নেই। সেকারণেই উন্নত ও ধনী দেশগুলির ঐতিহাসিক কৃতকর্মের জন্য বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার জন্য দিতে হবে। তার সঙ্গে প্রতিটি দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির কাছ থেকে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় জলবায়ু ট্যাক্স সংগ্রহ করা আজকের সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আফ্রিকায় সারা পৃথিবীর ৬০ শতাংশ সূর্যালোকের প্রাচুর্য থাকলেও প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতি ও প্রযুক্তি না থাকায় আফ্রিকার দেশগুলি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশগুলির সেভাবে প্রাকৃতিক সূর্যালোকের প্রাচুর্য নেই তবুও অর্থ বিনিয়োগ করার সঙ্গতি থাকায় তারা সাব সাহারা দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি সোলার প্যানেল বসাতে সক্ষম হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের জলস্তর স্ফীত হওয়ায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কার মুখে। অথচ নিজেদের রক্ষা করার মতো তাদের প্রয়োজনীয় পুঁজি ও প্রযুক্তি নেই। সুতরাং উন্নত দেশগুলিকে একাজে এগিয়ে আসতে হবে। ২১ শতকে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। আর্থিক সঙ্গতি ও প্রযুক্তির উদ্ভাবনের কারণে চীন তাদের মরুভূমি এলাকায় সবুজ ক্ষেত্র গড়ে তুলছে -সৌদি আরবের আর্থিক সঙ্গতি থাকায় প্রযুক্তি কিনে তাদের মরুভূমি এলাকায় সবুজ ক্ষেত্র গড়ে তোলার কর্মসূচি নিতে পেরেছে।
১ ট্রিলিয়ন ডলার বাস্তবে পৃথিবীর বছরে মোট জিডিপি’র মাত্র ১ শতাংশ। আবার গত ৫০ বছর ধরে তেল ও গ্যাসের শিল্প থেকে প্রতি বছর ১ ট্রিলিয়ন ডলার মুনাফা করে ধনকুবের কর্পোরেটরা। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় ধনী দেশগুলির পক্ষে বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার দেওয়া সম্ভব। এবং এটি একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
আজ়ারবাইজানের রাজধানী বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি ছিল, কার্বন নিঃসরণের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের যে ক্ষয় হচ্ছে তার মোকাবিলার জন্য উন্নত দেশগুলিকে বছরে অন্তত ১.৩ লক্ষ কোটি ডলার দিতে হবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো কোনওভাবেই ওই পরিমাণ অর্থ দিতে রাজি হয়নি। চাপ দিয়ে তারা মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ডে জন্য সিদ্ধান্ত করিয়েছে। প্রয়োজনের এক-চতুর্থাংশেরও কম। এই সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনেক প্রতিনিধি প্রতিবাদে সম্মেলন কক্ষ সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করে।
জলবায়ু সঙ্কট আজকের পৃথিবীর কাছে আশু বিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। তা সমাধানের চেষ্টা ধনতন্ত্রের প্রতিভূদের নেই। ধনতন্ত্র প্রকৃতি ও পরিবেশকে কাঁচামাল ও শক্তির উৎস হিসেবেই দেখে যা সহজেই লুঠ করা যায়। প্রকৃতিকে লুঠ করা ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হয় এবং লক্ষ কোটি মানুষ যে জীবন-জীবিকা ও অস্তিত্ব থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় তার ক্ষতিপূরণ ধনতন্ত্রে পণ্যের দামের মধ্যে ধার্য হয় না। তাই ধনতন্ত্র জলবায়ু সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারে না।
জলবায়ু সঙ্কটের সমাধান করতে হলে প্রকৃতি এবং মানব সম্পদের যে ক্ষতি পণ্য উৎপাদনের কারণে হয়ে চলেছে তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক মূল্য উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়। ধনতন্ত্র কোনওভাবেই তাতে রাজি নয়। তাহলে তাদের মুনাফার হার কমে যাবে। শ্রমজীবীর শ্রম ও প্রকৃতিকে লুঠ করেই ধনতন্ত্র তার মুনাফার হার ধরে রাখতে ও বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করে। ধনতন্ত্র-উত্তর আগামী পৃথিবী সমষ্টিগত যৌথভাবে হয়ত জলবায়ু সমস্যার সমাধন করতে সক্ষম হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.