বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সঙ্কটগ্রস্ত মার্কিন অর্থনীতিকে কীভাবে সঙ্কটমুক্ত করার কথা ভাবছেন?
কেইনসিয় ঘরানায় কোনও অর্থনীতির স্বাস্থ্য দুটি বিষয়ের সাহায্যে বোঝা হয় — মুদ্রাস্ফীতির হার ও বেকারির হার। সাধারণ ভাবে এই দুটি ‘চালক’এর সম্পর্ক বিপরীত মুখী। একটা বাড়লে অপরটা কমবে। এর তাৎপর্য হল, কোনও অর্থনীতিতে দীর্ঘকালীন পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ও বেকারির হার দুটোই কখনও নিম্নস্তরে থাকে না। এই দুই মানদণ্ডে মার্কিন অর্থনীতিতে ২০২৩-২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৩.৫% ছিল, আর যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারির হার ছিল ১২.১%। বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থায় এই বেকারি হ্রাস করার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তত্ত্ব হল কঠোর অভিবাসন নীতি।
আধুনিক ঘারানায় অর্থনীতির স্বাস্থ্য আরও দুটি চালকের সাহায্যে বোঝা হয়। এই দুটি হল বাণিজ্য ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক অসাম্যের মাত্রা। দীর্ঘকাল ধরে এই দুটি বিষয় মার্কিন অর্থনীতিতে উচ্চস্তরে বিদ্যমান। ২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ঘাটতি ছিল ৩৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ৩.৭ শতাংশ ছিল। ২০২৫ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৬৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলার। বিগত ২৫ বছরে বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক অসাম্যের প্রসঙ্গে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালে জনসমষ্টির উপরের দিকের ১% এর আয় নীচের দিকে ৯০% এর আয়ের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি ছিল। বাণিজ্য ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাম্পের তত্ত্ব হল ‘সংরক্ষণ নীতি’। সংরক্ষণ নীতির অর্থ হল আমদানি নীতি কঠোর করা। অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে বেকারির হার প্রশমনে কঠোর ‘অভিবাসন নীতি’ আর বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে ‘সংরক্ষণ নীতি’অনুসরণ করা। এটাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় ইনিংসের অভিমুখ।
সংরক্ষণবাদ বলতে বোঝায় আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক ও অন্যান্য বাধা তৈরি করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই নীতিটি একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল। স্থানীয় শিল্পকে বিকশিত করার জন্য সংরক্ষণ নীতির চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাওয়া যায় ১৯৩০ সালের স্মুট–হাওলি ট্যারিফ আইনের মধ্যে। এই আইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি আমদানির ওপর প্রায় ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে এবং ২০টি পণ্যে এই শুল্ক প্রযুক্ত হয়। ১৯৩৪ সালে দেখা যায় স্মুট-হাওলি আইনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যুমেরাং হয়ে গেছে। আইনটি ছোট বড় সব দেশকেই প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করতে প্ররোচিত করে। এই দেশগুলি হল কানাডা, ফ্রান্স, স্পেন, সুইৎজারল্যান্ড, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কিউবা। ১৯২৯–৩৪ এই মহামন্দার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ও রপ্তানি ৬৭% হ্রাস পায়। এই আইনের ফলে মহামন্দার প্রভাব আরও খারাপ হয়। ১৯৩৩ সালে মার্কিন দেশে বেকারির হার ছিল ২৫%। শিল্পোৎপাদন ৪৪% হ্রাস পেয়েছিল। মজুরি ৪২.৫ হ্রাস পায়, বহু ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যায়।
১৯৩৬-৩৬ থেকে এই সংরক্ষণবাদী চিন্তাধারা ‘দুর্বল’হয়ে যায়, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুক্ত বাণিজ্যে পরিণত হয়। যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমস্ত পুঁজিবাদী দেশের মধ্যে বাণিজ্য উদারিকরণের জন্য সাধারণ শুল্ক ও বাণিজ্য চুক্তি চালু করে যা ডাঙ্কেল প্রস্তাব নামে প্রসিদ্ধ। ১৯৯৫ সালে ‘গ্যাট’বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় পরিণত হয়। এরপর বিশেষ করে সোভিয়েতের পতনের পর উন্মুক্ত বাজার বা নিম্নশুল্ক মতাদর্শ বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মুক্ত বাণিজ্যের এই আবাহন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তবে ২০১৭ সালে ট্রাম্পের প্রথম ইনিংসে সংরক্ষণ মতাদর্শ আবার ফিরে আসতে শুরু করে। বর্তমানে এই পুরনো চিন্তাধারা আবার সক্রিয়। একইসঙ্গে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন পরিস্থিতিতে পুরনো চিন্তাধারা কতটা ফলপ্রসূ হবে তা এখন দেখবো।
২০২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ৩৪.১ কোটি। জনসংখ্যার ১১.১% দারিদ্রসীমার নীচে। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারির হার ১২.১%। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের অবদান হ্রাস ১৯%। শ্রমনিয়োগের ভরকেন্দ্রে রয়েছে সার্ভিসেস সেক্টর, যার অবদান ৮০%। আমেরিকাই বিশ্বের বৃহত্তমআমদানিকারক এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি কারক দেশ। পণ্য আমদানির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে শিল্পজাত পণ্য। ২০২৪ সালে প্রায় ৭৮.৪% শিল্পজাত দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি হয়। এই বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশীদার হল কানাডা, মেক্সিকো, জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ভারত, তাইওয়ান ও চীন। অর্থাৎ মহামন্দার সময়কার দেশ এবং নতুন দেশ, সবই আছে। রপ্তানি থেকে আমদানি বেশি হওয়ার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি সুবিপুল, ৯৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপির ৩.১ শতাংশ। এই বিসদৃশ অভ্যন্তরীণ অবস্থানের সুরাহার জন্য চটজলদি সমাধান হিসেবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় ইনিংসের ‘সংরক্ষণ নীতি’।
প্রাথমিক ভাবে ভারত, চীন, কানাডা, মেক্সিকো থেকে আমদানিকৃত সমস্ত পণ্যের ওপর ২৫% বা তার বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। একই ভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানিকৃত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫% বা তার বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এক কথায় ট্রাম্প প্রশাসনের সুর হল ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’। তবে সবকিছু একরতফা হবে না। ইতিমধ্যে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন পাল্টা আমেরিকা থেকে আসা পণ্যের ওপর শুল্ক চড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে পাল্টা পদক্ষেপ। যার ফলে ইউরোপে রপ্তানি করা মার্কিন পণ্যের ওপর ২৬ বিলিয়ন ইউরো শুল্ক আরোপিত হবে। অন্যদিকে, মার্কিন বাজারে রপ্তানি করা ইউরোপের পণ্যগুলির ওপর শুল্ক চাপবে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল। এই প্রসঙ্গে ভূতপূর্ব মার্কিন ট্রেজারি সচিব লরেন্স সামার্স বলেছেন, খেলার মাঠে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ধমকালে সময়ের সঙ্গে কেউ জয়লাভ করে না। তিনি এটাও বলেছেন, বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে কানাডা ও মেক্সিকো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাবে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর এর প্রভাব পড়বে। চীনের জন্য একটি কৌশলগত উপহার হবে।
বাণিজ্যযুদ্ধের ফলাফল সঠিক ভাবে অনুধাবন করার জন্য মার্কিন অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর সঙ্গে বর্হিজগতের পরিবর্তন লক্ষ্য করা দরকার। প্রথমত, ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন এবং দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ধারা। একথা সুবিদিত যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রতিহত ক্ষমতা কিছুটা স্তিমিত। অর্থাৎ বিশ্ব বর্তমানে একাধিক মেরুতে রয়েছে। যার উদাহরণ হল ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন’ও ‘ব্রিকস’। এছাড়াও পুরনো ‘আসিয়ান’ আছে। এই দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বাইরে থাকতে চাইছে। কাজেই দেখা দরকার, এই সব গোষ্ঠীবদ্ধ দেশগুলিতে, যা মহামন্দার সময়ে অনুপস্থিত ছিল, মার্কিন রপ্তানি বাণিজ্যের গুরুত্ব কতটা? কারণ রপ্তানি বাণিজ্যে কোন দেশের কোমরের জোর কতটা তা যুদ্ধে জয়–পরাজয়ের নির্ধারক।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরোপিত বাণিজ্যযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। সামগ্রিক ভাবে এই দেশগুলো একত্রে ২০২৩ সালে সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্যের ২৩% অংশীদার ছিল। এই দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ২০২২ সালে ৬১৪.৮ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য করেছে। বিশ্ব বাণিজ্যে ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। এটা দেখা গেছে ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো থেকে ৬৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর মাত্র ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য এই সব দেশে রপ্তানি করতে সমর্থ হয়েছে। অর্থাৎ ব্রিকস দেশগুলোর নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যে ঘাটতিতে রয়েছে।
ব্রিকসভুক্ত দেশগুলির মধ্যে চীনের গুরুত্ব সর্বাধিক। এখানে চীন সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক, আবার আমদানি কারকও। একইরকম ভাবে চীন ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে। আমেরিকার সাপেক্ষে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তের ধারা ২০০১ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান। কাজেই মার্কিন অর্থনীতির বহিঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীনা অর্থনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যেই ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে চীন পাল্টা হিসাবে মার্কিন পণ্যের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে। তবে আগেই বলা হয়েছে এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করবে রপ্তানি বাজারে কোমরের জোরের ওপর। বলা বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে নেই।
বাণিজ্য যুদ্ধের ফলাফল অন্বেষণে উপরোক্ত নয়া ভূরাজনৈতিক বিন্যাস ছাড়া অপর যে বিষয়টা আসে তা হল প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। ম্যাকিনসের একটা সম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গেছে বিশ্ব বাণিজ্য ক্রমশই পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এর অর্থ পণ্যের বাজারে জন্য ‘সাত সমুদ্র’অতিক্রম করতে হবে না। পাশের দেশেই তার বাজার তৈরি হয়েছে। এই বিষয়টাকে ডি–গ্লোবালাইজেন বলা যায়। উদাহরণ হিসেবে, মেক্সিকোর সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য, ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়। একথা বলা হচ্ছে যে, ২০১৭ পর থেকে ডি–গ্লোবালাইজেশনের ধারা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। এই ধারার বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখা যাচ্ছে বাণিজ্যের জন্য দূর–দূরান্তের দেশের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যা প্রকারান্তরে বাণিজ্যের খরচ বাড়িয়ে তুলছে।
শুল্ক আরোপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের ভাবনা যে অবাস্তব, তার উদাহরণ স্মুট–হাওলির ট্যারিফ আইন। বিষয়টা হল, শতবর্ষ আগের যে নীতিকে হেনরি ফোর্ড ‘অর্থনৈতিক মুর্খামি’বলেছিলেন, বর্তমানে তাকেই অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা বলে গণ্য করা হচ্ছে।