বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

ইউক্রেন সংঘাত: কে কোথায় দাঁড়িয়ে

ইউক্রেন সংঘাত: কে কোথায় দাঁড়িয়ে

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

ইউক্রেনকে সামনে রেখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ন্যাটোর ছায়াযুদ্ধ ঠিক কী ভাবে শেষ হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।

ইউক্রেনকে ঘিরে আমেরিকা ও ন্যাটোর ছায়াযুদ্ধের লক্ষ্য দুটো। এক, ইউক্রেনকে সামরিক মদত দিয়ে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়ত করা। তাদের ধারণা, ক্রমাগত যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ধসে পড়বে রাশিয়ার অর্থনীতি। তার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা তো আছেই। এছাড়া যুদ্ধে রুশ নাগরিকদের মৃত্যু সেদেশের জনমানসে পুতিনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেবে। এসবের জেরে একদিন ভেঙে পড়বে রাশিয়া। তাহলে ঠান্ডা যুদ্ধের শেষে যেভাবে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে এসেছিল আমেরিকা, এবারও তাই হবে। আর একটা রক্তপাতময় ছায়াযুদ্ধে জিতবে সাম্রাজ্যবাদ। তারপর লুঠ করা হবে সেদেশের অফুরন্ত জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদের ভাণ্ডার। হিটলারের লক্ষ্য এটাই ছিল। তবে হিটলার চেয়েছিল ব্লিৎসক্রিগে রাশিয়া দখল করতে। এবং স্তালিন ক্রমশ প্রতিরোধের এলাকাকে বিস্তৃততর করে নাৎসিদের গতি একেবারে কমিয়ে এনে তাদের দীর্ঘকালীন অবরোধ-প্রতিরোধের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাতেই হিটলারের সব ছক ভেস্তে যায়। এবার সেই দীর্ঘসূত্রিতার নীতি রাশিয়ার বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করতে চায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ধীরে ধীরে রক্তশূন্য করতে চায় রাশিয়াকে। উল্টোদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ-আয়োজনের মোকাবিলায় সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করেছিল সোভিয়েত রাশিয়া। ছিল দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিকে সহযোগিতা করার তাগিদ। এসবে জোর দিতে গিয়ে অবহেলিত হয়েছিল জনগণের জীবনধারনের মান ক্রমাগত উন্নত করে যাওয়ার দাবি। এই নীতিই সোভিয়েতের অসামরিক অর্থনীতিকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সামরিক ক্ষেত্রে একপেশে জোর সোভিয়েতের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাও প্রথম থেকেই এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং সমস্যার সমাধানও করেছিলেন। এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য তাঁর ‘অন দ্য টেন মেজর রিলেশনশিপ’ রচনাটি।

অতএব, ডলার দিয়ে, সাহায্যের নামে ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিমান, ট্যাঙ্ক ও ড্রোন পাঠিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করেই যাচ্ছে আমেরিকা ও ন্যাটো। সঙ্গে যাচ্ছে ছদ্মবেশে ন্যাটোর ও মার্কিনি সেনারা ও তাদের যুদ্ধ বিশারদেরা। হচ্ছে আসলে মার্কিন ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ। অথচ প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে শুধুই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পাশাপাশি চলছে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলিতে সঞ্চিত রাশিয়ার সম্পদ জোর করে দখল করা। এককথায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুগপৎ আর্থিক ও সামরিক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যাবাদী শক্তিগুলি। জেলেনস্কির ইউক্রেন সেখানে কর্তাদের হাতের তাস মাত্র। আমেরিকা ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের খুঁটির জোরে লড়ে যাচ্ছে জেলেনস্কি।

সাম্রাজ্যাবাদীদের এই কৌশল প্রথম থেকেই বুঝে ফেলেছিল রাশিয়া। তাই সঞ্চিত ডলার ও সম্পদ ফ্রিজ করে, সুইফটএর মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্টস সিস্টেম থেকে বের করে দিয়ে, এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে সামরিক হস্তক্ষেপের যে ত্রিমুখী কৌশল রচনা করেছিল আমেরিকা ও ন্যাটো, গত দু’ বছর ধরে সেই পরিকল্পনাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে আসছে রাশিয়া। নীপার নদীর এক পাড়ে শক্তপোক্ত ব্যূহ তৈরি করে, ক্রিমিয়া দখলে এনে এবং ইউক্রেন বাহিনীকে ক্রমাগত কিয়েভের দিকে পিছু হঠিয়ে সামরিক ক্ষেত্রে সুবিদাজনক অবস্থান জারি রেখেছে রাশিয়া। এরই পাল্টা, হঠাৎ করে কুরস্ক অঞ্চলে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলে ফেলে ইউক্রেন। তাদের হিসাব ছিল, দ্বিতীয় রণাঙ্গনে বেশি সেনা সরিয়ে দেবে রাশিয়া। সেই সুযোগে প্রথম রণাঙ্গনে তাদের কাবু করে নীপার নদীর ধার পর্যন্ত পৌঁছে ক্রিমিয়া পুনর্দখল করা যাবে। তারপর চলবে মূল রুশ ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান। তবে এই ফাঁদে পা দেয়নি রুশ বাহিনী। কিয়েভমুখী অভিযানে তারা সমান তীব্রতা বজায় রেখে একের পর এক শহর দখল করে যাচ্ছে। অন্যদিকে, কুরস্কে অধিকৃত অনেকটা এলাকা পুনর্দখল করেছে তারা। আপাতত দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলার কৌশল ব্যর্থ।

এরই পাশাপাশি, পুতিনের রাশিয়া অর্থনৈতিক ভাবে দুটি পদক্ষেপ নিয়েছে। এক চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ক্রমাগত বাড়িয়েছে। এবং সমগ্র ইউরেশীয় এলাকার বিশাল, বিস্তৃত বাজারের দিকে নিজেদের অর্থনীতিকে মোড় ফিরিয়েছে। নর্ড স্ট্রিম ২ এ অন্তর্ঘাত চালিয়ে ইউরোপে রাশিয়ার জ্বালানি তেল বিক্রি বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছে বাইডেন প্রশাসন। লক্ষ্য, ইউরোপের রুশ তেলের নির্ভরতা কমানো। দুর্বল ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি আমেরিকার এই ফাঁদে পা দেওয়ায়, রাশিয়া ইউরোপ থেকে মুখ ঘুরিয়েছে এশিয়া ও ইউরেশিয়ার দিকে। এভাবে বিকল্প বাজারের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেছে রাশিয়া। আর্থিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তার আর্থিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত। এই প্রথম রাশিয়া প্রমাণ করে দিল, তাদের মতো বড় দেশকে কাবু করার ক্ষমতা নেই মার্কিনিদের জারি করা আর্থিক নিষেধাজ্ঞার। ইউরোপ থেকে মুখ ফেরানোর পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে রাশিয়া। ব্রিকসের মাধ্যমে বিশ্বজোড়া ডলার বাণিজ্যকে দুর্বল করার প্রয়াসও শুরু হয়েছে। ফলে চীন ও রাশিয়া, তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশকে নিয়ে মার্কিন ডলারের সাম্রাজের বাইরে তৈরি হচ্ছে এক বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এবং এর জেরে ক্রমশ বিশ্ব হয়ে উঠছে বহু মেরুবিশিষ্ট। চীন ও ইউরেশিয়ার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা যদি রাশিয়ার দিক থেকে হয় রক্ষণাত্মক পদক্ষেপ, তবে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ হল ব্রিকসকে ডলারমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মঞ্চ হিসাবে কাজে লাগানো।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এখনই কোনও বড়সড় অসুবিধায় নেই। ওদিকে আমেরিকা ও ন্যাটোর সরাসরি এই যুদ্ধে জড়ানোর ইচ্ছে ও ক্ষমতা কোনওটাই নেই। কারণ, ইউরোপের সাধারণ মানুষ আরও একটা যুদ্ধ চায় না। পশ্চিম এশিয়া নিয়ে মার্কিন প্রশাসন এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে, তারা ইউক্রেনে সরাসরি দ্বিতীয় রণাঙ্গন খুলতে চায় না। এখন আমেরিকা ও ন্যাটোকে সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে হলে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য দেশ করে নিতে হবে। সেটা হলে ইউরোপের দোরগোড়ায় পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র বসানো হবে বলে রাশিয়া আগাম হুমকি দিয়ে রেখেছে। এই হুমকিকে আমেরিকা ও ন্যাটো উভয়ই ভয় পায়। পুতিন জানিয়েই রেখেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম শর্তই হবে ইউক্রেনকে হতে হবে নিরপেক্ষ দেশ, তাদের ন্যাটো সদস্য করা যাবে না। রাশিয়ার ঘাড়ের ওপর ন্যাটোকে নিঃশ্বাস ফেলতে দেওয়া হবে না। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানে আমেরিকা কথা দিয়েছিল তারা পূবের দিকে আর এক পাও এগোবে না। এখন দেখা যাচ্ছে সেই শর্ত ভেঙে তারা পূবের দিকে ইউক্রেন পর্যন্ত এগিয়ে এসে মস্কোকে ঘিরতে চাইছে। ইউরোপ এটা করতেও সাহস পায় না, কারণ তাতে ন্যাটো বনাম রাশিয়া, যুদ্ধ এভাবে আরও ছড়িয়ে পড়বে। যদিও যুদ্ধকে দীর্ঘস্থায়ী করে শত্রুকে দুর্বল করে ফেলার সবরকম উপাদানই রাশিয়ায় মজুত রয়েছে। অতএব, আমেরিকার উদ্দেশে রাশিয়ার বার্তা হল, ‘বৃহন্নলা, এবার ছিন্ন করো তোমার ছদ্মবেশ।’

প্রশ্ন হল, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প যদি জিতে আসেন তাহলে ইউক্রেন নিয়ে আমেরিকার নীতি বদলাবে কি? ইউক্রেনের আশঙ্কা, ভোটে জিতলে রাশিয়ার অনুকূলে যুদ্ধ চুক্তি মেনে নিতে পারেন ট্রাম্প। তবে পুতিনের ধারণা, কমলা হ্যারিস কিংবা ট্রাম্প, আমেরিকার ইউক্রেন নীতি কেউই বদলাবেন না।
তবে যুদ্ধ তো অনন্ত কাল চলতে পারে না। এবছরের আগস্ট মাসে কাতারের উদ্যোগে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরের কাজ অনেকটা এগিয়েছিল। রাশিয়ার শর্ত ছিল, ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য হতে পারবে না। এবং রাশিয়ার দখল করা সব এলাকা থেকে ইউক্রেনকে সরে যেতে হবে। এই সব এলাকাগুলি হল ডনেৎস্ক ও লুগানস্ক পিপলস রিপাবলিক এবং খেরসন ও ঝাপোরোঝিয়ে। চুক্তি প্রায় হয়েই গিয়েছিল। তবে শেষ মুহুর্তে বেঁকে বসেন জেলিনস্কি। ফলে সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এবারও জেলনস্কি একটা ভিক্ট্রি প্ল্যান ছকে ফেলেছেন। সেটা দেখিয়ে তিনি আমেরিকার কাছ থেকে শক্তিশালী টোমাহক মিসাইল চেয়েছেন। তাঁর লক্ষ্য, উন্নত পশ্চিমী অস্ত্র কাজে লাগিয়ে এই যুদ্ধে ন্যাটো ও আমেরিকাকে সরসরি জড়িয়ে ফেলা। আগেই বলেছি, এই যুদ্ধ সরাসরি জড়াতে চায় না আমেরিকা ও ন্যাটো। তাই হয় মার খেতে খেতে পরাজিত নায়কের ভূমিকা পালন করে যেতে হবে জেলেনস্কিকে। নয়ত পশ্চিমী চাপে রুশ শর্ত মেনেই যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে সই করতে হবে। দুটি ক্ষেত্রেই করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে পেশায় প্রাক্তন কমেডিয়ান তথা পশ্চিমের দাবার ঘুঁটি জেলেনস্কির জন্য। যদিও দ্বিতীয় সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার আশা কম। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে আরও বেশি ঋণফাঁদে ডুবে যাবে ইউক্রেন। ইউক্রেনের বাস্তুহারারা ধনী পশ্চিম ইউরোপে শহরগুলিতে শস্তা শ্রমিকের জোগানকে আরও জোরদার করবেন। অন্যদিকে ঋণের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ইউরোপের ব্যাঙ্কগুলিতে থাকা জেলেনস্কি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের অ্যাকাউন্ট আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। শস্য সম্পদ ও খনিজে সমৃদ্ধ, একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ, স্বাবলম্বী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ইউক্রেনকে এভাবেই ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে আমেরিকা, ন্যাটো এবং তাদের দোসর জেলেনস্কি। কীভাবে নিজেরই তৈরি করা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসবেন জেলেনস্কি, এবিষয়ে কী বলেন তাঁর ওয়াশিংটন ও লন্ডনের কর্তারা, সেটাই এখন দেখার।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.