বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— অবশেষে পরাজিত হল পুঁজির বিপুল টাকার থলি। আমেরিকায় ইউনিয়ন করার অধিকার জিতে নিলেন অ্যামাজনের স্ট্যাটেন আইল্যান্ড গুদামের শ্রমিকেরা। আমেরিকায় অ্যামাজন শ্রমিকদের এটা প্রথম জয়। নিউইয়র্কেই রয়েছে অ্যামজনের সবচেয়ে বড় ওয়্যারহাউজ বা মালগুদাম। লক্ষ কোটি ডলারের কোম্পানি অ্যামাজনের কর্তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন এই ইউনিয়ন আটকানোর জন্য। কিন্তু মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহের ভোটাভুটিতে এই প্রথম মার্কিন শ্রমিকেরা অ্যামাজনে ইউনিয়ন করার অধিকার জিতে নিলেন। ইউনিয়ন করার পক্ষে ভোট পড়েছে ২৬৪৫টি, বিপক্ষে ভোট পড়েছে ২১৩১টি। এবার শুধুমাত্র ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ডের সম্মতির অপেক্ষা। তবে ভোটের ফল চ্যালেঞ্জ করার পথে হাঁটতে পারে অ্যামাজন।
স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে অ্যামাজনের ওয়্যারহাউজের নাম জেএফকে এইট। ইউনিয়ন করার পক্ষে যাঁরা লড়েছেন তাঁদের দাবি, আরও ভাল প্রডাক্টিভিটি মজুরি দিতে হবে, সাধারণ মজুরি বাড়াতে হবে, সবেতন সাপ্তাহিক ব্রেক আওয়ার এবং ছুটি আরও বাড়াতে হবে। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য দাবিও।
জেএফকে এইট এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে অ্যামাজনের আরও তিনটি ওয়্যারহাউজে অ্যামাজন লেবার ইউনিয়ন গড়ার চেষ্টা শুরু হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে। একেবারে তৃণমূল স্তরের শ্রমিকেরা ইউনিয়ন গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মূল উদ্যোক্তাদের অন্যতম হলেন ২০২০ সালে ছাঁটাই হওয়া একজন শ্রমিক। তাঁর নাম ক্রিস্টিয়ান স্মলস। নিউ ইয়র্কে কোভিডের প্রকোপ শুরু হওয়ার এক মাস পর ওয়্যারহাউজ ম্যানেজার ক্রিস্টিয়ানকে ছাঁটাই করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অ্যামাজন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল, তিনি সামাজিক দূরত্ববিধি মানছেন না। পাল্টা ক্রিস্টিয়ান দাবি করেন, কোভিড ১৯ সংক্রান্ত নিরাপত্তা বিধি কোম্পানি আদৌ মানছিল না। এর প্রতিবাদ করাতেই তাঁর চাকরি যায়।
স্মলের এই প্রতিবাদ নজর কাড়ে অ্যামাজনের জেনারেল কাউন্সিলের। উনি স্মার্ট নন, কথাও বলতে পারেন না, এই অজুহাতে এরপর তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। এরপরেই তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন স্মলস। শ্রমিকদের জমায়েতে তিনি অভিযোগ করেন কোম্পানি শ্রমিকদের এত কম বেতন দিচ্ছে যাতে ভালভাবে বেঁচে থাকা ও কাজ করা অসম্ভব (ইংরেজিতে এধরনের মজুরিকে বলা হয় Dickensian treatment)। এমনকি শ্রমিকদের মধ্যে সাদা– কালো বিভাজন করার অভিযোগ এনে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করেন তিনি। এপ্রসঙ্গে একজন এগজিকিউটিভের মন্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে হাজির করেন স্মলস।
এদিকে বেসেমার, অ্যালাবামায় অ্যামাজন শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তা দেখে স্মল স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে গড়ে তোলেন অ্যামাজন লেবার ইউনিয়ন। তাঁর যুক্তি ছিল, এই মেগা কর্পোরেট সংস্থার বিরুদ্ধে অ্যামাজন কর্মীদের নতুন একটা ইউনিয়ন গড়ে তুললেই ম্যানেজমেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে।
এর আগে বেসেমারে ইউনিয়ন গড়ার ভোটাভুটি টাকা ঢেলে প্রভাবিত করেছিল অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ। সেই সময় ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ড রায় দিয়েছিল, গত বছর খুচরো, পাইকারি ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ইউনিয়ন গড়ার চেষ্টায় অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ বিধি ভেঙে হস্তক্ষেপ করেছিল। সেই সময় ১০০টি ভোট নিয়ে দুপক্ষই মামলা দায়ের করে।
স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ওয়্যারহাউজের ভোটের ফল নিয়েও অসন্তুষ্ট অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ। কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, সব সুযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই ভোটে এনএলআরবি, ন্যাশনাল রিটেল ফেডারেশন এবং ইউএস চেম্বার অফ কমার্স অকারণ প্রভাব খাটিয়েছে। এনিয়ে আপত্তি জানানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
শ্রমিকদের পাল্টা অভিযোগ, ভোটের আগে ওয়্যারহাউজে ‘ভোট নো’পোস্টার লাগানো হয়েছিল তাদের প্রভাবিত করার জন্য। সাপ্তাহিক ইউনিয়ন–বিরোধী সভায় যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল, এবং ডেমোক্রেটিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত পোলিং ফার্ম গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি গ্রুপ তাদের মনোবল ধ্বস্ত করার চেষ্টা করেছিল। নিজেদের ওয়েবসাইটে কোম্পানি প্রচার করেছিল যে ইউনিয়ন যেসব সুযোগ দিতে চাইছে তার চেয়ে কোম্পানির দেওয়া সুযোগ আরও লোভনীয়। যদিও এটা স্পষ্ট নয় কোন ইউনিয়নের সঙ্গে কোম্পানি নিজেদের তুলনা করেছে, কারণ কোনও আমেরিকান অ্যামাজন কর্মীই কোনও ইউনিয়নেরই সদস্য নন।
প্রসঙ্গত জানা গেছে, গত বছর নভেম্বরে অ্যালাবামার বেসেমারে অ্যামাজনের মালগুদামে পর পর দু’জন কর্মীর মৃত্যু হয়। শ্রমিক অধিকার সংগঠন মোর পারফেক্ট ইউনিয়ন তখন অভিযোগ করেছিল, সিক লিভ না দেওয়ার কারণেই ওই দু’জন অসুস্থ শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছিল। গত বছর ২৮ ও ২৯ নভেম্বরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাঁদের মৃত্যু হয়। একজনের অফিসের ফেসিলিটি বিভাগেই মৃত্যু হয়। চিকিৎসার সুযোগই তিনি পাননি। আরেকজন চিকিৎসা পাওয়ার পর মারা যান। তখন অ্যামাজনের শ্রমিক ইসাইয়া থমাস জানিয়েছিলেন, একজন শ্রমিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কাজ করতে করতেই মারা যান। তাঁকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয়নি এইচ আর দপ্তর। মোর পারফেক্ট ইউনিয়নের একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করা হয়েছে, ‘ওই শ্রমিককে বলা হয়েছিল যদি বাড়ি যান চলে যান তাহলে চাকরি থাকবে না, আর চাকরি রাখতে হলে এখানেই থেকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’অ্যামাজনের শ্রমিক পেরি কোনেলি জানিয়েছিলেন, আরেকজন শ্রমিক ট্রেলারের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন। ২০ মিনিট বাদে সেটা জানা গিয়েছিল। মোর পারফেক্ট ইউনিয়নের দাবি, এই দুই শ্রমিকের মৃত্যুর পরেও অন্য শ্রমিকদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়। ফলে শ্রমিকদের প্রতি অ্যামাজনের ব্যবহার নিয়েই প্রশ্ন উঠে যায়।
গত বছর বেসেমার ওয়্যারহাউজের শ্রমিকেরা বিপজ্জনক কাজের পরিবেশের ইস্যুতে ইউনিয়ন গড়ার চেষ্ট করেন। কিন্তু ভোটে তাঁরা হেরে যান। তখন ইউনিয়নের পক্ষে ভোট পড়ে ৭৩৮টি, বিপক্ষে ১৭৯৮টি। তখনই ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ড জানতে পেরেছিল যে, অ্যামাজন অবৈধভাবে ভোটে হস্তক্ষেপ করে এবং ২৯ নভেম্বর পুনর্নির্বাচনের আদেশ দেয়। মোর পারফেক্ট ইউনিয়নের আরও অভিযোগ, শুধুমাত্র ২০২১ সালেই বেসেমারে অ্যামাজনের ফেসিলিটিতে ৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এবং এই খবর চেপে যাওয়ারও চেষ্টা করেছে কর্তৃপক্ষ। মোর পারফেক্ট ইউনিয়নের তরফে এজন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা হলেও কোনও সাড়াই দেয়নি এই ই–কমার্স কোম্পানি। এবং ইউনিয়নের অভিযোগের কোনও জবাবও দেয়নি।