বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থার কাজ থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত জর্ডানের এক প্রৌঢ় ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন গাজ়ায়। সেখানকার অভিজ্ঞতা তাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। তিনি বলেছেন “তোমায় একটা ছবি কল্পনা করতে বলছি। ভাবো, বৃষ্টি হচ্ছে। তাঁবুর মধ্যে পশুর মতো গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে কিছু মানুষ। আর এক দল মানুষের মাথার উপরে কোনও ছাউনি নেই। তারা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তার মধ্যেই বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা মেয়ে। তার মাথার উপরে বাবা দু’ হাত মেলে ধরে বৃষ্টি আটকানোর চেষ্টা করছে। আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে।” (২৭ অক্টোবর, ২০২৪, আনন্দবাজার পত্রিকা)
একবছর আগে ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত আক্রমণের পাল্টা জবাব দিতে ইজ়রায়েল গাজ়া আগ্রাসন শুরু করে। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, পণবন্দীদের উদ্ধার এবং হামাসকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
ইজ়রায়েলের বোমারু বিমান ও ট্যাঙ্কের গোলার আঘাতে গাজ়া ভূখণ্ড এখন ধ্বংসস্তূপ। “আত্মরক্ষা করার অধিকারে” গাজ়ার সমস্ত হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানীয় জলের পরিকাঠামো, নিকাশি ব্যবস্থা, ঘর-বাড়ি সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির অস্ত্র ও সমর্থনপুষ্ট ‘গণতান্ত্রিক’ ইজরায়েলের সেনাবাহিনী। গাজ়ার সমগ্র জনসংখ্যা তীব্র খাদ্যাভাব ও প্রায় অনাহারের সামনে। অপুষ্টি ও ওষুধের অভাবে ভয়ানক মহামারি ও সংক্রমণের মুখে। ইজরায়েলি বাহিনীর বজ্রকঠিন অবরোধে গাজ়ায় ত্রাণ পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরছাড়া, আশ্রয়হারা। তাঁবুর নিচে অথবা খোলা আকাশে বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া সংগ্রাম করছেন। এ যুদ্ধ নয়, গণহত্যা। প্যালিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার ভয়ঙ্কর চেষ্টা। আজকের গাজ়া ভূখণ্ডকে তুলনা করা যায় বিগত শতাব্দীতে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সঙ্গে বা এই শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকার নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনীর আগ্রাসনে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ইরাকের সঙ্গে। অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের প্যালিস্তিনিরা প্রায় একই ধরনের হিংসার স্বীকার।
কেন এই নারীঘাতী, শিশুঘাতী অমানবিক বীভৎসা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতিতে পুরনো ঔপনিবেশিক শাসন অচল হয়ে পড়ে। সেই পর্বে পশ্চিম এশিয়ায় আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে ব্রিটিশ-আমেরিকার যৌথ পরিকল্পনার ফসল ইজ়রায়েল রাষ্ট্র। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে ইহুদি নিধনের বিরুদ্ধে সহানুভূতি এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রস্তাবকে কাজ্য লাগিয়ে আরব দেশগুলির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও গড়ে তোলা হয় ইহুদি রাষ্ট্র। ১৯৪৮ এর ১৪ মে যেদিন ইজ়রায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয় সেইদিনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইজ়রায়েলকে স্বীকৃতি দেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইজ়রায়েল আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরব দেশগুলি ও প্যালেস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধে গেছে বারবার। প্যালেস্তাইন, মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবাননের ভূমি দখল করেছে।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সংযোগস্থলে তেল ও মূল্যবান খনিজ সম্পদে ভরপুর ওই এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর দখলদারী এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার দীর্ঘমেয়াদী রণনৈতিক পরিকল্পনায় শক্তিশালী করা হয় ইজ়রায়েলকে। মার্কিন ও পশ্চিমী দেশগুলির ধারাবাহিক মদতে গণতন্ত্রের মোড়কে ইজ়রায়েল হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্র - নয়া ঔপনিবেশিক স্বার্থের উত্তরাধিকার চালিয়ে যাওয়ার জন্য এক উপগ্রহ রাষ্ট্র।
ফ্রেডি ট্রুম্যান থেকে জর্জ বুশ, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন সকলেই বিপুল পরিমাণ সামরিক সাহায্য ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে গেছেন ইজ়রায়েলকে। ইজ়রায়েলে ৬৯% যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে আমেরিকা - ৮০% অস্ত্র আসে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি থেকে। মাত্র ২০% অস্ত্র ইজ়রায়েল নিজে তৈরি করে। আমেরিকার ইজ়রায়েল লবি হোয়াইট হাউসকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে - মার্কিন সামরিক সাহায্য যেন অব্যাহত থাকে। নির্বাচনের সময় তাদের তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। যাতে যেই জয়ী হোন না কেন, ইজ়রায়েল মার্কিন সামরিক সাহায্য পেতেই থাকে। সেকারণে আমেরিকা ও বিশ্ব জুড়ে ইজ়রায়েলে মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবি উঠলেও বাইডেন প্রশাসন তা উপেক্ষা করে।
সর্বোপরি, যখন নিছক অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিকভাবে আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলির ধনতন্ত্র আর তার সংকট মোকাবিলা করতে পারছে না - অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মন্দা থেকে বের হতে পারছে না। তাদের হাতে একটি মাত্র অস্ত্র আছে এবং তা হল যুদ্ধ- যুদ্ধ অর্থনীতি। সেই সুযোগে লকহিড মার্টিন, জেনারেল ডায়নামিক্স, নরথ্রপ গ্রুম্যান, বোয়িংয়ের মতো প্রতিরক্ষা শিল্পের লবি হোয়াইট হাউসকে প্রভাবিত করে দুনিয়াজুড়ে যুদ্ধ নীতি গ্রহণ করার জন্য। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান যে দলের প্রেসিডেণ্ট ক্ষমতায় থাকুক বা আসুক না কেন, বিশ্বজোড়া আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য এবং অর্থনীতিকে সচল রাখতে ইজ়রায়েল, ইউক্রেন, তাইওয়ানকে অস্ত্রসজ্জিত করে চলে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ও অর্থনীতিবিদ, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকার তীব্র সমালোচক জেফরি শ্যাক্সের মতে, গাজা-লেবাননে ইজ়রায়েলের গণহত্যা বন্ধ করা, যুদ্ধ বিরতি, প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং শান্তির বাধা অন্য কেউ নয়, স্বয়ং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
আমেরিকার বলে বলীয়ান ইজ়রায়েল গাজ়া আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় এক বৃহত্তর যুদ্ধ শুরু করেছে। ইরানের প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ে। তেহরানে বোমা বিস্ফোরণে তাঁকে হত্যা করে ইজ়রায়েল। তার আগে সিরিয়ার দামাস্কাসে ইরানের দূতাবাসে আক্রমণ চালিয়ে ইজ়রায়েল হত্যা করে ইরানের কমান্ডারকে। লেবাননে পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হতাহত করে কয়েক হাজার মানুষকে। রাজধানী বেইরুটে ইজ়রায়েল বিমান হামলা করে আমেরিকান ব্লাস্টার বোমা দিয়ে হত্যা করে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে। এ আক্রমণগুলি সরাসরি ইরান, সিরিয়া, লেবাননের সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ। ইরান ইজ়রায়েলে মিসাইল আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে সতর্ক করে। পাল্টা ইজ়রায়েল ইরানের ওপর মিসাইল আক্রমণ চালায়। ইজ়রায়েল এই যুদ্ধে আমেরিকাকে সরাসরি টেনে আনতে চায়। তারা জানে এই যুদ্ধে তারা একক ভাবে জয়ী হতে পারবে না বা সম্মানজনক আপোষ রফাও সম্ভব নয়।
এরই মধ্যে বিমান আক্রমণ ও স্থল অভিযান চালিয়ে লেবাননের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নেমেছে ইজ়রায়েল। স্থল অভিযান প্রায় ৫০ হাজার সেনা নামিয়েও লেবানিজ প্রতিরোধ অগ্রগতি ঘটাতে ব্যর্থ হচ্ছে আইডিএফ। বরং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে।
প্যালেস্তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের সংহতিতে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের প্রতিরোধকে বানচাল করতে লোহিত সাগরে আমেরিকার নেতৃত্বে যৌথ নৌ-অভিযান চলছে। ইয়েমেনে ইঙ্গ-মার্কিন বিমান বাহিনী নিয়মিত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইয়েমেনের প্রতিরোধকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরাকের প্রতিরোধ যোদ্ধারা নিয়মিত ইজ়রায়েল ও ইরাকে আমেরিকার ঘাঁটিতে চালাচ্ছে। তার প্রত্যুত্তরে মার্কিন বিমান বাহিনীও তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী প্রবল পরাক্রান্ত সাদ্দাম হুসেনের ইরাক আগ্রাসনের মাত্র মাত্র এক মাসের মধ্যে বাগদাদ দখল করে। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ বহুজাতিক বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে এবং ১ মে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ঘোষণা করেন প্রধান যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সাদ্দাম হুসেন বন্দী হন ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩।
কিন্তু এবারের পরিস্থিতি আলাদা। গাজ়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে মানুষ ইজ়রায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। দুনিয়া জুড়ে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমী দেশগুলির আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। গড়ে উঠেছে ব্রিকস। আর্থিক-বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতিতে ইরান, সৌদি আরব, ইউএই, মিশর, কাতারের মতো দেশগুলির কাছে বিকল্প হয়ে উঠছে চীন। চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে বৈরীতার অবসান ঘটেছে। ব্রিকসের সদস্য হয়েছে ইরান, সৌদি আরব, ইউএই, মিশর। এমনকি, ন্যাটোর সদস্য তুরস্ক ব্রিকসের সহযোগী সদস্য হচ্ছে। সৌদি আরব, কাতার, জর্ডান, ইরাক, কুয়েত, ওমান, তুরস্ক আমেরিকার উপর চাপ দিচ্ছে ইজ়রায়েলকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ ও গাজ়া ও লেবাননে সার্বিক যুদ্ধ বিরতির জন্য।
ইজ়রায়েলি বাহিনী হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ে এবং তারপরে ইয়াহিয়া সানোয়ারকে হত্যা করেছে। তবুও গাজ়ার ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে জাবালিয়া থেকে রাফায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর প্রত্যাঘাত হানছে। বিপরীতে রণক্লান্ত ইজ়রায়েলি বাহিনীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। ১৩৮ জন ইজ়রায়েলি সেনা প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও আইডিএফ প্রধানকে চিঠি দিয়ে, হামাসের সঙ্গে পণবন্দী প্রত্যার্পণ ছাড়া যুদ্ধ করতে অস্বীকার করছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিহাহু তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন।
শেষ করা যাক, লেবাননের মহিলা সাংবাদিক ঘাদি ফ্রান্সিসের কথা দিয়ে, ইজ়রায়েল ও আমেরিকার ওয়ার-মেশিনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই নিজেদের স্বাধীনতা ও নিজেদের ভূমির জন্য। প্যালেস্তিনিদের লড়াইয়ের সঙ্গে লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরানের লড়াই একাকার হয়ে গেছে। … শিয়া, সুন্নি, খ্রিস্টান, ধার্মিক, অধার্মিক, কমিউনিস্ট, সোস্যালিস্ট, ন্যাশনালিস্ট, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, প্রাচীনপন্থী - সকলের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে আমরা ২০০৬ সালে ইজ়রায়েলকে পরাজিত করেছি। আবার আমরা জিতব।