বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[বিশ্ব]

[বিশ্ব]

ফ্যাসিবাদ কাকে বলে

ফ্যাসিবাদ কাকে বলে

রামিল আচার্য্য

photo

দেশ কাল সময় ভাষা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্ব জনগণ আসলে দুটি মেরুতে ভাগ হয়ে আছে।
একদিকে মুষ্টিমেয় কতিপয় ঐশ্বর্য গর্বে গৌরবান্বিত উদ্ধত ধনাঢ্য ভূস্বামী, ছোটবড় শিল্পপতি, পুঁজিপতি ধনবান শ্রেণী। তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে ধন্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, তাবৎ আমলা, দালাল চক্র, মাফিয়া লুম্পেনের দল, পুলিশ প্রশাসন, এবং পরিশেষে আছে সরকার পোষিত সামরিক বাহিনী। সমাজের তাবৎ সম্পদের সিংহভাগ ওনারা ভোগ করবেন প্রায় বিনা কায়িক পরিশ্রমে। উৎকোচজীবী আমলাতন্ত্র, আইন-আদালত, প্রশ্রয়-লালিত আইন রক্ষক পুলিশ বাহিনী আছে ওনাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্বে। তাছাড়াও আছে সপ্ত বর্ণের নানান মিশেলে নতজানু রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধি বেচে সুখী গৃহকোণে জীবন যাপনে লালায়িত শিক্ষিতের দল যাদের এক কোথায় বলা হয় বুদ্ধিজীবী। এরা কেউ শিক্ষক, কেউ শিল্পী, কেউ সাহিত্যিক, কেউ নট-নটি, কিছু কিছু মধ্যবিত্ত মানুষও আছেন যাঁরা সারমেয়বৎ আনুগত্যে উচ্ছিষ্ট-ভিক্ষু হয়ে ওনাদের আসে-পাশে গায়ে গা ঘেঁষে থাকতে উন্মুখ।
আর অন্য দলে আছেন তাবৎ শ্রমজীবী শ্রেণী— চাষী, মজুর, আনুগত্য বিক্রি করতে নারাজ মধ্যবিত্তের দল এবং প্রান্তিক আদিবাসী দলিত পরিচয়ে অবমানিত কষ্ট ক্লিষ্ট জীবন নিয়ে নেঁচে থাকা শোষিত শাসিত মানুষের দল।
শোষণ এবং শাসনের হাতিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র। ছলে এবং কৌশলে রাষ্ট্রযন্ত্র শিক্ষাহীন, স্বাস্থ্যহীন, বাস্তুহীন, শ্রমজীবী প্রান্তিক চাষী আর দলিতদের ধর্মের নামে, আইনের নামে, নরকের ভয় দেখিয়ে, গারদের আতঙ্ক ছড়িয়ে বশীভূত বশ্য করে রাখে।
তবুও সময় আসে যখন অতিষ্ঠ মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয় শুধু বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবি জানিয়ে তখন তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র শেখায় শান্ত থাকতে, ভবিতব্যকে মেনে নিতে, অন্যথায় অকারণ নিপীড়ণ, অত্যাচার সইতে হবে - সেটাই সমাজের এবং ঈশ্বরের বিধান বলে বুদ্ধিজীবীরা আসরে নেমে পড়ে গদ্যে, পদ্যে, প্রবন্ধে, নাটকে, সংবাদ মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াতে, নট-নটীরা মোহাচ্ছন্ন করে রাখে স্বপ্নময় জগতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন করে।
তবুও সময় আসে যখন ছল কৌশল দিয়ে আর প্রতিবাদ দাবিয়ে রাখা যায় না। কিছু মানুষকে চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যায়, কিছু মানুষকে কয়েক দিনের জন্যে বোকা বানিয়ে রাখা যায়, কিন্তু সব মানুষকে চিরকালের জন্যে বোকা বানিয়ে দাবিয়ে রাখা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে শেখে, চিনতে শেখে কে কেন তাদের বোকা বানিয়ে রাখার চেষ্টায় তৎপর। ছল কৌশল ব্যর্থ হলে সময় আসে বল প্রয়োগের।
বল প্রয়োগের পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ আছে: প্রথমে গুন্ডা, মাফিয়া, ছুরি, বোমা, পিস্তল নিয়ে মাঠে নামে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছুদিন পরে সেই ভয় কাটিয়ে উঠলে আসরে নামে পুলিশি। তারাও যখন ব্যর্থ হয় তখন মোকাবিলায় নামে সেনাবাহিনী। আমাদের আজকের আলোচনা সেই শেষ পর্যায়ের শাসকীয় রীতি পদ্ধতি নিয়ে - যে পদ্ধতিকে রাজনীতির পরিভাষায় বলা হয় ফ্যাসিবাদ।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বেনিতো মুসোলিনি ইতালিতে সংগঠিত করেন এক উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ইতালিয় ভাষায় ‘ফ্যাসি’ শব্দের অর্থ বান্ডিল বা আঁটি। মুসোলিনির আন্দোলনের প্রতীক ছিল এক বান্ডিল লাঠি আর একটা কুড়ুল। ওই এক বান্ডিল লাঠি বা ডান্ডার প্রতীক চিহ্নকে ভিত্তি করে আন্দোলনের নামকরণ হয় ফ্যাসিবাদী-আন্দোলন। আর আন্দোলনের আদর্শ হল ফ্যাসিবাদ।
কি সেই আদর্শ? রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় জোটবদ্ধ হবে সরকার - শ্রমজীবী জনগণ - কর্পোরেট পুঁজিপতি গোষ্ঠী। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে সরকারে প্রতিনিধি, পুঁজিপতি কারখানার মালিক আর শ্রমিকদের প্রতিনিধি।
আলোচনার পরবর্তী পর্যায় যাব কর্পোরেট শব্দটির সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করে কর্পোরেট শব্দটির পরিভাষা হল সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এই সংঘবদ্ধ হওয়ার চেতনা থেকে এক বান্ডিল লাঠির প্রতীক গ্রহণ করা হয় মুসোলিনির দলের। আদর্শগত ভাবে ফ্যাসিবাদী সরকারের সংগঠনে থাকার কথা উল্লেখিত তিনটি শ্রেণীর প্রতিনিধিদের শিল্পমালিক, শ্রমিক সংগঠন আর সরকারের যৌথ নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প-পরিকল্পনা— সহমত, সহযোগিতা, সর্বজনীনতার শর্ত মেনে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় যথেষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অনুরূপ শর্তে রাষ্ট্র পরিচালিত হলে আপত্তি কিসের। আপত্তি ইতালিতে মুসোলিনির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পরবর্তী ক্রিয়া কলাপের উদাাহরণ মনে রেখে। তখন মুসোলিনি দ্বৈত ভূমিকায় – যুগপৎ সরকারর এবং শ্রমজীবী শ্রেণীর প্রতিনিধি। শ্রমজীবী শ্রেণী প্রতিবাদ করতেই সাামরিক দমন শুরু হল প্রতিবাদীদের নির্মূল করতে – কর্পোরেটদের প্র্রত্যক্ষ মদতে এবং প্রশ্রয়ে।
আদর্শের বয়ানে যাই থাক না কেন বাস্তবে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাবে বঞ্চিত থাকতেই হয়। শ্রমজীবীদের নাগরিকদের রাষ্ট্র শাসনের অধিকার প্রায় শূন্য। ছেলে ভুলানো খেলনার মতো দলিত/আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরম বিশ্বস্ত কতিপয় বিশিষ্ট মানুষকে শ্রদ্ধার সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করে রেখে অবাধে লুট করে যাওয়ার অভিজাত শ্রেণীর কুট কৌশল এই লুন্ঠন প্রক্রিয়ায় নীচের মহলের কাউকে কচিৎ কখনো উচ্চশিক্ষার চৌকাঠ পেরোতে দেওয়া হয় - অধিকাংশই শিক্ষার দুয়োরে কড়া নাড়ার সুযোগ পায় না। ফাঁদে ফেঁসে থাকে আদর্শের নির্দেশনামায় - নির্দেশনামার পোষাকী নাম সংবিধান। সংবিধানের ভাষ্য বুঝে ওঠার উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা - তারা জানেও না সংবিধানে তাদের জন্য কি অধিকার দেওয়া আছে।
ফ্যাসিবাদ আদতে কর্পোরেট প্রশাসন। দেশি-বিদেশি মূলধনের মালিকদের স্বার্থ রক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক দপ্তর। মার্কসীয় বিশ্লেষণে ফ্যাসিবাদ হল একচেটিয়া মূলধনীদের সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্বে সামরিক প্রশাসন। পুঁজীবাদী সমাজ সবচেয়ে অত্যাচারী, সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াাশীীল রাষ্ট্রশাসন। মূলধনী অর্থনীতির একটা বৈশিষ্ট হল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজারের সংকোচন সৃষ্টি করে ব্যবস্থাটাকেই এমন সংকটে ফেলা যখন অস্তিত্ব কায়েম রাখার জন্যে ফ্যাসিবাদী কায়দায় নাগরিকদের দমন করে রাখতে বাধ্য হয় কর্পোরেটদের প্রশ্রয় পালিত সরকার। গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে ফেলে শুরু হয় ফ্যাসিবাদী দমনের তান্ডব। এক এক দেশে এই সামরিক তান্ডবের এক এক রকম নাম— ইতালিতে ফ্যাসিবাদ, জার্মানিতে নাৎসিবাদ, স্পেনে ফ্যালাঞ্জিবাদ, আমেরিকায় ম্যাকার্থিবাদ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এদের রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি প্রায় এক। সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক অধিকার রদ করে শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রয়োগে স্তব্ধ করে দেওয়া। বাজার-সংকটের অবস্থা কাটিয়ে উঠতে শক্তিমানেরা নেমে পড়ে বাজার দখলের লড়াইতে। যুব-জনগণকে দলে দলে সৈনিক বানিয়ে স্বাদেশিকতার বুলি পড়িয়ে যে কোনও ছুতোয় শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদী সামরিক অভিযান। কর্পোরেটদের দালালদের ছেলে মেয়েরা কেউ যুদ্ধে যায় না, তারা লড়াই করে বিসিসিআই (BCCI) বা আইপিএল (IPL)-এর প্রশাসনিক পদ বাগাতে।
ফাসিজিমের আর একটি রণকৌশল হল জাতিবিদ্বেষের জিগির তুলে দেশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করা। ভারতে এই মুহূর্তে কর্পোরেট স্বার্থে আমলাতান্ত্রিক কৌশল আর বিশেষ ভূমিকা নিতে পারছে না। কৃষি বিল নিয়ে আন্দোলোনই হোক, কিংবা ডিএ নিয়ে প্রাদেশিক আন্দোলনই হোক শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সংকট তৈরি করা। এর সংকেত অচিরেই নির্মম আক্রমণ নেমে আসবে। ভারতে ফ্যাসিবাদের বীজ রোপন করেছিলেন সাভারকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ অগ্রদূতেরা - তাতে ইন্ধন জুগিয়ে অঙ্কুরিত করতে সচেষ্ট বর্তমান রাষ্ট্রীয় প্রশাসন - সৌজন্যে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা আরএসএস। ফ্যাসিবাদী আদর্শকে জনগ্রাহ্য করে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা নেয় একাধিক উপসংগঠন কোথাও তাদের নাম বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা অন্য কিছু।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.