বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
“গর্ভে সন্তান এসেছে, জানার পর আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। কিন্তু আঠারো সপ্তাহের মাথায় জল ভেঙে গেল। জানতে পারলাম যে গর্ভের শিশুকে জীবন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে আনার সম্ভাবনা নেই। সেই শোকের সময়েও বড় হয়ে উঠল ভয়। ডাক্তার বললেন, নতুন আইন অনুসারে তিনি গর্ভপাত করাতে পারবেন না। ক্রমশ অসুস্থ হতে হতে শেষে সেপটিক শক-এ যখন প্রায় মরণাপন্ন হয়ে পড়ি, তখন ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করলেন।” কথাগুলো বলছিলেন আমান্ডা জ়ুরাওস্কি। তাঁর মতো কুড়িজন ভুক্তভোগী মহিলা আদালতে গর্ভপাত-বিরোধী আইন খারিজের আবেদন করেন। ২০২৪ সালে টেক্সাসের সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। বহাল রয়েছে গর্ভপাতে কঠোর বিধিনিষেধ।
আমান্ডা অস্টিনের মেয়ে, কথা বলছিলেন সেই শহরে মিছিল শুরুর আগে এক জমায়েতে। ‘জ়ুরাওস্কি বনাম টেক্সাস’ মামলা নিয়ে এখন একটি তথ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে, যার প্রযোজক হিলারি ক্লিন্টন এবং হলিউড তারকা জেনিফার লরেন্স। কিন্তু সে দিন মিছিলে তেমন লোকজন হয়নি। ক’দিন আগেই বিপুল ভোটে জিতেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নারী-অবমাননায় অভিযুক্ত, গর্ভপাত-বিরোধী ট্রাম্পকে জয়ী করতে অধিকাংশ নাগরিকের আপত্তি নেই, এই বার্তা বহু মেয়েকে নাড়িয়ে দিয়েছে। পাঁচ দশকের নারী আন্দোলনের পর কোথায় নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা?
অর্ধেক বিশ্ব দূরে ভারতের দিকে তাকালেও একই প্রশ্ন মনে জাগে। নিজের পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার অধিকার নস্যাৎ হচ্ছে আদালতে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের বরেলির একটি আদালত তার রায়ে লিখেছে, ‘লাভ জিহাদ’ হল হিন্দু মেয়েদের ‘ব্রেনওয়াশ’ করা, ভারতকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা। এই মন্তব্য সরানোর আবেদন শুনতে রাজিই হয়নি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ‘লাভ জিহাদ’-এর তত্ত্ব নারীর প্রতি অনাস্থা, তার মতামতের প্রতি অসম্মানকেও প্রতিষ্ঠা করে। দেশের কোনও আদালত ‘লাভ জিহাদ’-এর তত্ত্বকে মান্যতা দিলে মুসলিম পুরুষ ও হিন্দু মেয়ে সমান বিপন্ন হয়।
বিপন্ন মুসলিম মেয়েরাও। তাঁদের প্রগতিশীল অংশ চেয়েছিলেন, মুসলিম পারিবারিক আইনের ‘কোডিফিকেশন’ হোক, তাকে সংশোধন করে নারী-পুরুষ সাম্য আনা হোক। অথচ, উত্তরাখণ্ড ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ পাশ করল, অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যও তা পাশ করার তোড়জোড় করছে। যা মেয়েদের ফেলবে আতান্তরে — আদালতের কাছে ন্যায় চাইতে গেলে ধর্মীয় অনুশাসনকে অস্বীকার করতে হবে। ক’জন মেয়ের অন্তর তাতে সায় দেবে?
আইনসভা, আদালত, পুলিশ-প্রশাসনের বাইরে যে প্রতিষ্ঠানের উপর মানুষ সর্বাধিক নির্ভর করে, তা হল বাজার। বাজার থেকে মেয়েদের বাদ দিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা সারা বিশ্বে দেখা যাচ্ছে। অকারণে অতি-দীর্ঘ সময় কাজ, ছুটির দিনেও তলব, অফিসে হাজিরাকে আবশ্যক করা, এ সব তারই কৌশল। কোভিডের সময়ে দেখা গিয়েছিল যে সপ্তাহে দু’তিন দিন দফতরে গিয়ে কাজ করা সব চাইতে লাভজনক। তা সত্ত্বেও সপ্তাহে পাঁচ-ছ’দিন অফিস-যাওয়া ফের দস্তুর করা হয়েছে। ‘পেশাদারিত্ব’ দাবি করা হচ্ছে এমন ভাবে, যাতে কাজের সঙ্গে সংসারের সামঞ্জস্য অসম্ভব হয়ে যায়। ভারতে অগণিত মেয়ে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে, কিংবা প্রবেশই করছে না কাজের জগতে। দু’একজন ‘সেলিব্রিটি’ মহিলা বিজ্ঞানী, শিল্পপতি, সাহিত্যিক বা ক্রীড়া-তারকাকে সম্বর্ধনা দিয়ে এই সার্বিক পরাভবকে ঢাকার চেষ্টা করা অনর্থক।
হিসেব গুলিয়ে দিতে কেন্দ্র যতই পরিসংখ্যানে কারচুপি করুক, আসলে ভারতে দশজন মেয়ের সাত-আটজন রোজগারহীন। অনুদানের রাজনীতি মেয়েদের কাজের দাবিকে আরও দুর্বল করছে। প্রবল-প্রতাপী পুরুষ নেতার অনুগত কিছু মহিলাকে ‘নারী সক্ষমতার মুখ’ বলে ঘোষণা করছে দলগুলো। এই নেতা-নির্ভরতা বস্তুত মেয়েদের পরাজয়।
এ পরাজয়ে রবে কে? আর কে, মেয়েরাই আছে, থাকবে। যারা হারতেই জন্মেছে, তবু হার মানে না। প্যালেস্তাইনে, ইউক্রেনে, মণিপুরে, বাংলাদেশে নিজেদের দেহের উপরে যুদ্ধের পরেও যারা রাঁধছে-বাড়ছে, সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছে, নিজেও উঠে দাঁড়াচ্ছে। এ খেলায় বিপক্ষে দ্বিগুণ খেলোয়াড়, রেফারিও বিপক্ষের, নিয়মগুলোও ও পক্ষই ঠিক করেছে, জেনেও মেয়েরা মাঠ ছাড়ে না। অ্যালিস ওয়াকারের ‘দ্য কালার পার্পল’-এর নায়িকা সিলিয়ে বলেছিল, ‘আমি গরিব, কালো, কুচ্ছিৎ, কিন্তু আমি আছি।’ আর সে দিন মিছিলে এক শিশুকন্যা হাতের প্ল্যাকার্ডে লিখে এনেছে, ‘আই অ্যাম আ গার্ল। হোয়াট ইজ় ইয়োর সুপারপাওয়ার?’ পরাজয় অবধারিত, সাম্য এক অসম্ভব প্রত্যাশা, জেনেও লড়াই করার এই ‘সুপারপাওয়ার’ যারা নিজের মধ্যে খুঁজে পায়, অপরের চোখে দেখতে পায়, আদালতে খারিজ হওয়ার পরেও যারা বিচার চেয়ে নামে অস্টিন কিংবা কলকাতার পথে, নারী দিবস তাদের জন্য।