বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
সীমান্ত হত্যা পৃথিবীর নানা জায়গায় হয়। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম দেশের সীমান্তে এমন করে মানুষ হত্যা হয়তো আর কোথাও হয় না, যেমন ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হয়। ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, অনেকে হয়তো ঠিকঠাক জানেনই না, ঠিক কতজন মারা যায় সীমান্তে! এই নীরবতা আমাদের কষ্ট দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতা একটা বড় অস্ত্র। এখানে একটা পক্ষ যত্ন করে ভারত বিরোধিতা জিইয়ে রাখতে চায়। অহেতুক ভারত বিরোধিতার বিরুদ্ধে আমরা যখন আওয়াজ তুলতে চাই তখন আমাদের কিছু জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। তার মধ্যে একটা হল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী এ বছরের অর্ধেক যেতে না যেতেই ১৫ জন মারা গেছে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে! কেন এই প্রাণহানি? ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরা সব চোরাকারবারি! মুশকিল হচ্ছে, চোরাকারবারিকেও গুলি করে মারা যাবে না, সীমান্তে তো যাবেই না, এই সিদ্ধান্ত ভারত আর বাংলাদেশ মিলেই নিয়েছিল। একমাত্র যদি সীমান্তরক্ষীদের মনে হয় যে কেউ তাদের মারবার হুমকি দিচ্ছে, অস্ত্র বহন করছে, তখন আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে পারে। তবে আগ্নেয়স্ত্র ব্যবহার না করাই উত্তম। এ কথাগুলো বলা হয়েছে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত প্রটোকলে। এ রকম দ্বিপক্ষীয় দুটি প্রটোকল হল- ‘জয়েন্ট ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইনস ফর বর্ডার অথোরিটিজ অব দ্য টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫’, এবং ‘দ্য ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, ২০১১’। এই দুই প্রটোকলে স্পষ্ট করেই বলা আছে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। কিন্তু কতটুকু মানা হচ্ছে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০, এই ১১ বছরে সীমান্তে ৫২২ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। ২০২১, ২০২২, ২০২৩ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ১৮, ২৩ ও ৩১ জন! এটা জেনে কি গা শিউরে উঠে না? প্রশ্ন ওঠে, ভারত সরকার কি এই হত্যাগুলোর তদন্ত করে দেখেছে, যে এগুলো অবধারিত ছিল কিনা? আমরা তার উত্তর জানি না।
৪,১৫৬ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে। পৃথিবীর বুকে পঞ্চম বৃহত্তম সীমান্ত আমাদের এই সীমান্ত। এই দীর্ঘ সীমান্তে চাইলেও নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব নয়। দুই দেশের রয়েছে এক থাকার ইতিহাস। দুই পাশের মানুষ কথা বলে এক ভাষায়। এমন ভাবে সীমান্ত ভাগ করা হয়েছে যে মানুষের জীবন দুই ভাগ হয়ে গেছে। বাড়ি সীমান্তের এক দিকে, রান্নাঘর আরেক দিকে, ক্ষেত খামার আরেকদিকে, বহু জায়গায় এই হচ্ছে পরিস্থিতি। গ্রামের মানুষের গরু চলে যায় হেঁটে হেঁটে ওই পাশে, ধান চাষ করে এই পাশে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে। শেরপুর সীমান্তে ছোট থেকে দেখে আসছি, সীমান্ত পিলারের ওই পাশে মানুষ আসছে-যাচ্ছে! আমরা দুঃসাহসিক কাজ করছি দেখানোর জন্য সীমান্ত পিলারের দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, কেউ একটু হেঁটে আসছে ওই পাশ থেকে! কী ভাবে সম্ভব? কারণ পিলার পড়েছে নদীর এই পাশে। ঐতিহাসিক ভাগের সময় এগুলো হিসাব করেনি র্যাডক্লিফ। তাই এ দিকে সব বাংলাদেশর অংশ, কিন্তু পিলার পড়েছে এখানে! এখন পিলারে উঠলে গুলি মেরে দিলে কী হতো? সিলেটের বেশ কিছু জায়গায় এমন। দু’দেশের মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে যাচ্ছে। জাফলং গেলে দেখা যায় বিজিবি আর বিএসএফ এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ও পাশ থেকে কেউ ‘একটু বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসি’ বলে এ দিকে আসতে চাইছে, বিএসএফ ধমক দিয়ে ঠেকাচ্ছে, এ দিকে বিজিবিও তাই করছে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য বলে, এমনই হওয়ার কথা আমাদের সীমান্তে। কিন্তু তা আর হয় কই?
এই বছর মার্চে ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সীমান্তের বিষয়ে নানা কথা বলা হয়। সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক নীতিন আগরওয়াল বলেন, সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না! তিনি সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা হবে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না হলে এই মানুষগুলো মরলে কী ভাবে? উত্তর নেই! রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কথা দিয়ে কথা না রাখলে কী করা যায়? বিএসএফ মহাপরিচালক থেকে শুরু করে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি সীমান্তে আর কোনও হত্যা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একাধিকবার। মৃত্যুর মিছিল থামে নাই একটুও।
বিএসএফ থেকে সোজা বলে দেওয়া হয় যারা গুলি খেয়ে মারা গেছে তারা সবাই চোরাকারবারি! তাহলে ধরেন, ধরে বিচার করেন। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কবে থেকে ভারতে বৈধ হয়ে গেল? আর চোরাকারবারি ব্যাপারটা আসলে কী ভাবে ঘটে? ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সচিব কিরীটি রায় ‘ডয়েচে ভেলে’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা?- ডয়চে ভেলে, ২৯/১২/২০২২) বলেছিলেন, “এই সীমান্ত হত্যার পিছনে যে গল্প ফাঁদা হয় তাও ঠিক না। তারা বলে সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালনিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এই সব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক, ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হল দুর্নীতি, ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাটোয়ারায় মেলে না তখন বিএসএফ হত্যা করে।” এটাই হচ্ছে চরম কুৎসিত সত্য। যা ভারত সরকার কখনোই স্বীকার করেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ‘ট্রিগার হ্যাপি: এক্সেসিভ ইউজ অব ফোর্স বাই ইন্ডিয়ান ট্রুপস অ্যাট দ্য বাংলাদেশ বর্ডার’ নামের ৯ ডিসেম্বর, ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিহতদের সবাই ছিল নিরস্ত্র, তাদের কাছে বড়জোর লাঠি, কাস্তে, ছুরি থাকে। ভারতের বৈরী সীমান্ত বলে যাকে মনে করা হয়, সেই পাকিস্তান বা চীন সীমান্তে কি এমন করে মানুষ মরে?
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে গুলি খেয়ে মরে ফেলানি খাতুন। ফেলানির বয়স ছিল ১৫ বছর! ফেলানি খাতুন কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বাবার সঙ্গে ভারত থেকে ফিরছিল সেই সময় গুলি খেয়ে প্রাণ হারায়। দীর্ঘ সময় ফেলানির লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে! সেই সময় কাঁটাতারে ফেলানির লাশ খুব আলোড়ন তৈরি করে। দেশ বিদেশের গণমাধ্যমেও বেশ জায়গা পায় এই ছবি। তখন যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশীদের মনে, তা ভারতবাসী কতখানি বুঝেছিল জানি না। আমরা আশা করেছিলাম অন্তত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা প্রতিবাদ করবে এমন একটা হত্যাকাণ্ডের জন্য। কিন্তু কোথাও যে খুব বেশি কিছু হয়নি, তা বুঝতে পারা গেছে। এর ১৩ বছর পরে, এ বছরের ১ সেপ্টেম্বর রাতে ১৪ বছর বয়সই স্বর্ণা দাস মারা গেল গুলি খেয়ে! স্বর্ণা দাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত দিয়ে তার মায়ের সঙ্গে ত্রিপুরায় যাচ্ছিল ওর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। বেচারি মা নিজে বাঁচতে পারলেও বাঁচাতে পারেনি মেয়েকে! স্বর্ণা দাস, ফেলানি খাতুন কেউই অস্ত্র তাক করেনি বিএসএফের দিকে যে তাদের গুলি করে মেরে ফেলতে হবে।