বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২২— আমাদের দেশে বেতন বা মজুরি বৃদ্ধি মালিক ও সরকারের দয়ার দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপের দেশের দেশে শ্রমিকেরা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষতি পূরণের জন্য মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে বার বার ধর্মঘট ও আন্দোলনে নামছেন।
একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘটে কেঁপে উঠছে ফ্রান্স। রেল শ্রমিক থেকে বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড স্টাফ, তেল শোধনাগারের শ্রমিক, ছোট-মাঝারি সংস্থা থেকে বহুজাতিক কোম্পানির শ্রমিকেরা, ট্রাক ড্রাইভাররা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে সামিল হচ্ছেন।
মে মাসে ফ্রান্সে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৫.২%। এই হার ফ্রান্সে ৩৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুন মাসে খাদ্য ও জ্বালানির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতির দাঁড়ায় ৬.৫%। জ্বালানির মুদ্রাস্ফীতির হার ৩৩.১%, খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৭%, সতেজ খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতির হার ৬.২%। গত ৪০ বছরে এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতির মুখে ফ্রান্স পড়েনি।
৪০ বছরে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির জন্য ফ্রান্সের জনসাধারণের একটা বড় অংশ তাদের কোমরের বেল্ট শক্ত করে বাঁধছেন। ঊর্ধ্বমুখী দাম তাদের দৈনন্দিন জীবনে, আবাসন থেকে পরিবহন, খাদ্য, কেনাকাটা এবং বাইরে যাওয়ার অভ্যাসকে প্রভাবিত করছে। ক্লদ ডি হারো, পমিয়ারের অ্যাসেম্বলির কর্মী এবং একজন ডিভোর্সি, তিন সন্তানের মা। তিনি জানান, “আমি আর বিউটিশিয়ান বা হেয়ারড্রেসারের কাছে যাই না। আমি দুই বছর ধরে সমুদ্র তীরের বালিতে পা রাখিনি।” তিনি আরও জানান, “আমি মোট ১৪০০ ইউরো উপার্জন করি, সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাকে আমার বাবা-মায়ের বাগান থেকে সবজি তুলতে হবে। আমরা এখন কম উপার্জনের জন্য বেশি কাজ করি।”
জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস (INSEE) জানাচ্ছে, মার্চ মাসে ফ্রান্সে গৃহস্থালি দ্রব্যের ব্যবহার কমেছে ১.৪% এবং এপ্রিলে কমেছে ০.৪%। স্বাস্থ্য ও সংহতি মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অফিস (DREES) সূত্রে জানা যাচ্ছে, মার্চ মাসে ২৬,৯৮,৬০০ জন অভাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক-ইউরো খাবার বিতরণ করা হয়। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারি কল্যাণ সহায়তা প্রকল্পে কেবল মাত্র হাউট-গারোন শাখায় জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ১,৫২১টি আর্থিক সহায়তার আবেদন জমা পড়েছে, যা বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। গত বছর একই সময় পর্বে ৭৬৯টি আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। আবেদনগুলির বেশিরভাগই বাড়ি ভাড়া বা গ্যাসের জন্য।
৬ জুলাই ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেলওয়ে কোম্পানি, এসএনসিএফ-এর চারটি প্রধান ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি ইউনিয়ন— সিজিটি চেমিনটস, এসইউডি রেল এবং সিএফডিটি চেমিনটস মুদ্রাস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষতি পূরণের জন্য মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। তার ফলে ব্যাহত হয় ট্রেন পরিষেবা। এক তৃতীয়াংশ ট্রেন বাতিল করা হয়।
ধর্মঘটের দিন রেল ইউনিয়নগুলির সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রীয় রেলওয়ে অপারেটর কর্তৃপক্ষ ৩.৭% বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়। রেল ইউনিয়নগুলি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ‘অপ্রতুল’ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করেছে এবং আগামী দিনগুলিতে আবার ধর্মঘটের জন্য সতর্ক করেছে। এই বিষয়ে তারা ইউনিয়ন সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করবে যে তারা আরও ধর্মঘট করবেন কিনা।
রেল শ্রমিকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধর্মঘট করেন প্যারিসের রয়সি চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড স্টাফরা। ধর্মঘট করেন টোটাল এনার্জি ফ্রেঞ্চ তেল শোধনাগারের শ্রমিকরা, ট্রাক ড্রাইভাররা। রিটেল ও ফুড চেন পোমিয়ার থেকে ফ্লোর কভারিং বিশেষজ্ঞ গারফ্লোর, পারফিউম কোম্পানি মেরিয়নড, শক্তি কোম্পানি আরটিই, রাস্তার কাজে বিশেষজ্ঞ ইউরোভিয়ার শ্রমিকেরা ধর্মঘটে অংশ নেন।
৮ জুলাই দক্ষিণ ফ্রান্সের এক্সন মবিল শোধনাগারের শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন। এই শোধনাগার ফ্রান্সের প্রায় দশ শতাংশ তেল শোধন করে। শোধনাগারের শ্রমিকরা মুদ্রাস্ফীতির ফলে ক্ষতি পূরণের জন্য মজুরি বৃদ্ধি দাবি জানাচ্ছিলেন।
তার আগে ১৭ মার্চ জেনারেল কনফেডারেশন অফ লেবার (সিজিটি), ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ অটোনোমাস ট্রেড ইউনিয়নস (ইউএনএসএ) এবং অন্যান্য কয়েকটি প্রধান ফরাসি ইউনিয়ন ফ্রান্স জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় বৃদ্ধির জন্য মজুরি বৃদ্ধি। এই ধর্মঘটর ফলে দেশব্যাপী ব্যবসা ও পরিবহন ব্যাঘাত ঘটে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অপারেটরদের ধর্মঘটে দেশব্যাপী বাস, ট্রাম এবং মেট্রো পরিষেবা ব্যাহত হয়। সরকারি কর্মচারী এবং শিক্ষা কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নগুলি এই ধর্মঘটে অংশ নেয়। স্কুল ও সরকারি দপ্তরের পরিষেবা প্রায় ব্যাহত হয়। শ্রমিকরা বিভিন্ন শহর ও জায়গায় জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
২৭ জানুয়ারী, ২০২০ ফ্রান্স জুড়ে ধর্মঘট সংঘটিত হয়েছিল, যার ফলে সরকারি পরিষেবাগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হয়েছিল৷ প্রায় ১,৫০,০০০ শ্রমিক ১৭০টিরও বেশি জায়গায় বিক্ষোভগুলিতে অংশ নিয়েছিল।
২০০৮ সালের মহা মন্দার অভিঘাত থেকে ফ্রান্স সহ ইউরোপের দেশগুলি বার হয়ে আসতে পারেনি। কোভিড অতিমারি অর্থনৈতিক সংকটকে তীব্রতর করেছে। তার উপর, ইউক্রেনকে সামনে রেখে আমেরিকা ও ন্যাটোর রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ইউরোপের দেশগুলির অর্থনীতিকে খাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাশিয়ার উপর বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা ফ্রান্সের মতো দেশগুলির মুদ্রাস্ফীতির হার ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলছে। কারণ তারা রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস কিনতো। এখন তাদের চড়া দামে আমেরিকার কাছ থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস কিনতে হচ্ছে। সেই বোঝাটা নেমে আসছে শ্রমজীবী মানুষের উপর। তাই ফ্রান্সের মতো দেশগুলির শ্রমিকেরা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সঙ্গে সামঞ্জস্য আনতে মজুরি ও বেতন বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছেন এবং বার বার ধর্মঘটে নামছেন।