বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[বিশ্ব]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ জুলাই ২০২২—
২০২১ সালে বিশ্বে একজন প্রাপ্ত বয়স্কের বছরে গড় আয় ছিল ২৩,৩৮০ ডলার। ওই বছরেই একজন প্রাপ্তবয়স্কের গড় মালিকানাধীন সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১,০২,৬০০ ডলার। এই হিসাব কষা হয়েছে পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি সূত্র মেনে। এর মানে হল কোনও দেশের মুদ্রার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতাকে হিসাবে ধরে নিয়ে। তবে গড়পরতার আড়ালটুকু সরিয়ে নিলেই আসল বৈষম্যের ছবিটা প্রকট হয়ে পড়ে। দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় ছিল বিশ্বের মোট আয়ের ৫২ শতাংশ। অন্যদিকে, বিশ্বের জনসংখ্যার সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের আয় বিশ্বের মোট আয়ের মাত্র ৮ শতাংশ। অর্থাৎ সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ এবং সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশ মানুষের আয়ের ফারাক হল ৪৪ শতাংশ। অন্যভাবে বললে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশভুক্ত একজনের গড় আয় বছরে ১,২২,১০০ ডলার। এবং বিশ্বের সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের একজনের গড় আয় বছরে ৩৯২০ ডলার। ফারাকটা হল ১,১৮,১৮০ ডলার। মাসিক ফারাকটা হল প্রায় ১০ হাজার ডলার বনাম প্রায় ৩২৭ ডলারের।
বিশ্বে গরিব মানুষ যত আছেন তাঁদের নীচের দিকের ৫০ শতাংশ বিশ্বের মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশের মালিক। আর বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ বিশ্বের মোট সম্পদের ৭৬ শতাংশের মালিক। টাকার হিসেবে বিচার করলে বিশ্বের গরিব জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের গড় সম্পত্তির মূল্য ৪১০০ ডলার। আর সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্কের সম্পত্তির পরিমাণ গড়ে ৭,৭১,৩০০ ডলার। ফারাকটা ৭,৬৭, ২০০ ডলারের।
এই ছবিটি যদি আরও বিশদে দেখলে দেখা যাবে, বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ধনী–দরিদ্রের গড় আয় ও গড় সম্পত্তির মধ্যে ফারাকটা এক রকম নয়। যেমন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য। ইউরোপে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় ওই মহাদেশের মোট আয়ের ৩৬ শতাংশ। আবার মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় হল ৫৮ শতাংশ। এই দুই বিপরীত মেরুর মাঝখানে রয়েছে একাধিক অঞ্চল। যেমন পূর্ব এশিয়া (যার মধ্যে পড়ে চীন, হংকং, জাপান, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ম্যাকাও দ্বীপ)। এই অঞ্চলে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় ওই সব দেশের মোট আয়ের ৪৩ শতাংশ। আবার লাতিন আমেরিকায় এই অনুপাত ৫৫ শতাংশ।
এর মানে তুলনায় ধন বৈষম্য সবচেয়ে কম ইউরোপে, সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রাচ্যে এবং তারপরেই অবস্থান লাতিন আমেরিকার। পূর্ব এশিয়ায় ধন বৈষম্যের ছবিটা এ দুয়ের মাঝামাঝি। মনে রাখতে হবে, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে রয়েছে চীন ও উত্তর কোরিয়া যেখানে শাসনক্ষমতায় রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। মঙ্গোলিয়াও একদা ছিল সোভিয়েত শাসনে। এই দেশগুলিতে ধনী–দরিদ্রের বৈষম্য ইউরোপের চেয়ে বেশি ঠিকই, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা লাতিন আমেরিকার চেয়ে কম। এপ্রসঙ্গে পরে আসতে হবে আমাদের।
ধনবৈষম্যে আঞ্চলিক ফারাকের ছবিটা একটু স্পষ্ট করা যাক। ইউরোপ মহাদেশে জনসংখ্যার মোট যা আয়, তার মাত্র ২০ শতাংশেরও কম অংশের মালিক সমাজের একেবারে নীচুতলার ৫০ শতাংশ। মোট আয়ে মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের ভাগ ৪৫ শতাংশ। মোট আয়ে সর্বোচ্চ ধনী ১০ শতাংশের ভাগ হল ৩৫ শতাংশ। এর মানে এই মহাদেশে ধনীদের চেয়ে মধ্যবিত্তের আয়ের শতাংশ বেশি। পূর্ব এশিয়ায় মোট আয়ে একেবারে নীচুতলার ৫০ শতাংশ, মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশ এবং সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয়ের ভাগটা হল যথাক্রমে ১৩, ৪২ ও ৪৩ শতাংশ। উত্তর আমেরিকায় ১২, ৪১ ও ৪৫ শতাংশ। রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় ১৪, ৩৮ ও ৪৭ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ১২, ৩২ এবং ৫৫ শতাংশ। লাতিন আমেরিকায় ১০, ৩৩ ও ৫৫ শতাংশ। সাব–সাহার আফ্রিকায় ৮, ৩৫ ও ৫৫ শতাংশ। এবং মেনাভুক্ত দেশে ৮, ৩২ ও ৫৮ শতাংশ। এখানে সাব সাহারা আফ্রিকা বলতে বোঝানো হয়েছে সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলিকে। MENA–ভুক্ত দেশ বলতে বোঝায় Middle East ও North Africaর দেশগুলিকে।
ওপরের তথ্যগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের সব অঞ্চলেই মোট আয়ে সবচেয়ে নীচুতলার গরিব ৫০ শতাংশের আয়ের অনুপাত ২০ শতাংশের বেশি তো নয়ই, আবার ৯ বা ১০ শতাংশের নীচে নয়। মোট আয়ে সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের ভাগ সবচেয়ে কম যে সব অঞ্চলে, সেগুলি হল লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সাব সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। এসব অঞ্চলে জাতীয় আয়ে সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের অনুপাত মাত্র ৯ থেকে ১২ শতাংশ। এই সব এলাকায় অসাম্যের স্তর বিশ্বপরিসরে অসাম্যের সমান স্তরের। আবার যারা এসব অঞ্চলে সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের মধ্য পড়েন, দেশবিশেষে তাঁদের দারিদ্রের স্তরে ফারাক আছে। তার মানে এসব অঞ্চলে দু’ ধরনের সমাজ রয়েছে। একদিকে, অত্যন্ত সম্পন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এলিট যাদের আয় খুবই বেশি। অন্যদিকে, বাকিরা থাকেন চরম দারিদ্রে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশ, আপেক্ষিক বা চরম অর্থে, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সাব সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মতো গরিব নয়। এই সব অঞ্চলের মধ্যে পড়ে উত্তর আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া। এই সব অঞ্চলে সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের আয় মোট জাতীয় আয়ের ১৩ শতাংশের কাছাকাছি। ইউরোপের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি প্রায় ২০ শতাংশ।
ইউরোপে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মোট জাতীয় আয়ের ৩৬ শতাংশের মালিক। আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অসাম্য যে অঞ্চলে সেখানে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয় মোট জাতীয় আয়ের ৫৫ থেকে ৫৮ শতাংশ। এর মানে যে অঞ্চলে গরিব বেশি সেখানে বড়লোকও বেশি। তুলনায় ইউরোপ অনেকটাই সমতার অঞ্চল, যেখানে মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের আয় মোট আয়ের ৪৫ শতাংশ যা সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। এর মানে গোটা ইউরোপ মহাদেশে আর্থিকভাবে প্রভাবশালী শ্রেণীটি হল মধ্যবিত্ত। বিশ্ব পরিসরে বিভিন্ন অঞ্চলে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ এবং সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের মধ্যে আয়ের ফারাকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইউরোপে এই দুই অংশের আয়ের ফারাক ১০ গুণ। পূর্ব এশিয়া, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় এই ফারাক ১৬ গুণ, উত্তর আমেরিকায় ১৭ গুণ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ২২ গুণ, লাতিন আমেরিকায় ২৭ গুণ, সাব সাহারা আফ্রিকায় ৩১ গুণ এবং মেনাভুক্ত দেশে ৩২ গুণ।
আমরা যদি আয়ের ফারাকের বদলে ব্যক্তি মালিকানাধীন গৃহস্থালির সম্পদকে মানদণ্ড হিসাবে বিচার করি তাহলে, দেখা যাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে সেই সব অঞ্চলের গৃহস্থালির নীট সম্পদের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ। গৃহস্থালির নীট সম্পদ বলতে বোঝানো হচ্ছে আর্থিক সম্পদ (ইকুইটি কিংবা বন্ড)এবং আর্থিক নয় এমন সম্পদের (বাড়ি কিংবা জমির) যোগ ফল। এক্ষেত্রে যদি বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা উত্তর আমেরিকার কথা ধরি, তাহলে দেখা যাচ্ছে সেখানে সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ৭০ শতাংশের মালিকানা এবং সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ২ শতাংশের মালিকানা। মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট সম্পদের ২৮ শতাংশের মালিকানা। সম্পদের মালিকানার এই ফারাক ইউরোপে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়, পূর্ব এশিয়ায় এবং রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় অনেক কম। তুলনায় ফারাক বেশি সাব সাহারা আফ্রিকা, মেনা–ভুক্ত দেশ ও লাতিন আমেরিকায়। লাতিন আমেরিকায় মোট গৃহস্থালির সম্পদের ৭৭ শতাংশের মালিক সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ। আর সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মোট গৃহস্থালির সম্পদের মাত্র ১ শতাংশ।
আবার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের সম্পদের মালিকানা বিচার করলে দেখা যাবে, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় মোট গৃহস্থালি সম্পদের ৪৬ শতাংশই এদের হাতে। লাতিন আমেরিকায় ৪৫ শতাংশ, মেনাভুক্ত দেশে ৪৪ শতাংশ, সাব সাহারা আফ্রিকায় ৩৮ শতাংশ, উত্তর আমেরিকায় ৩৫ শতাংশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ৩৪ শতাংশ, পূর্ব এশিয়ায় ৩০ শতাংশ ও ইউরোপে ২৫ শতাংশ গৃহস্থালির সম্পদের মালিক শীর্ষে থাকা ১ শতাংশ ধনী। অন্য একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশের গৃহস্থালির মোট সম্পদের মালিকানার পরিমাণ সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের চেয়ে ৬৩০ গুণ কম। সাব সাহারা আফ্রিকার ক্ষেত্রে ৩৫১ গুণ, মেনাভুক্ত দেশে ৩০৬ গুণ, উত্তর আমেরিকায় ১৯৭ গুণ, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় ১২৭ গুণ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ৭২ গুণ, পূর্ব এশিয়ায় ৭০ ও ইউরোপে ৬৬ গুণ কম। এর মানে, সমাজতন্ত্র ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ায় একদল লোক বিপুল পরিমাণে সরকারি সম্পত্তি লুঠপাট করে ধনকুবেরে পরিণত হয়েছে। অসাম্যের এই ছবিটা ১৯৯০ সালের আগে কেমন ছিল তা জানা যায় না। কারণ কোনও অর্থনীতিবিদই সাহস করে সোভিয়েত আমলের (যখন সেখানে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না)সম্পদের সু্ষ্ঠু পুনর্বণ্টনের ছবিটা সামনে আনতে চান না। আবার রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় ১ শতাংশ ধনীদের হাতে যখন কুক্ষিগত গরিবের তুলনায় ১২৭ গুণ বেশি সম্পদের মালিকানা, পূর্ব এশিয়ায় তা কমে হয়েছে ৭০ গুণ। এর মানে পূর্ব এশিয়ার ১ শতাংশ ধনীদের সঙ্গে নীচুতলার গরিবদের সম্পদের মালিকানার ফারাক রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার তুলনায় ৫৭ গুণ কম। এখানে আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই যে পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে জনবহপল দেশ চীন এবং ছোট দেশ উত্তর কোরিয়া কমিউনিস্ট পার্টির শাসনাধীন। এই দুই দেশে সামাজিক সম্পদের পুনর্বণ্টনের ছবিটা ততটা হতাশাজনক নয়।
প্রশ্ন হল, কেন বিশ্বের সব এলাকার মধ্যে একমাত্র ইউরোপে সর্বোচ্চ ধনীদের চেয়ে মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশের আয় বেশি। এর কারণটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। মনে রাখা দরকার যে, পরিণত পুঁজিবাদী ইউরোপ থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র সহ নানা ধরনের সমাজতান্ত্রিক ও সমাজগণতান্ত্রিক মতাদর্শের উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। এই মতবাদ ১৮৪৮ এর কমিউনিস্ট ইস্তাহার, প্যারী কমিউন এবং ১৮৮০র দশকে জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সমাজের সর্বস্তরে প্রসার লাভ করে। এরপর রুশ বিপ্লব সফল হওয়ায় বিপ্লবকে ঠেকাতে গিয়ে পুঁজিবাদী ইউরোপ লেনিনের বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বদলে কাউটস্কি–বার্নস্তেইনদের সমাজ গণতন্ত্রকে (সোশাল ডেমোক্রেসি)ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে। ইতিহাস বলছে, সংস্কারপন্থী জনমুখী সমাজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি আঁকড়ে থেকেছে গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে। এবং সেখানকার অভিজ্ঞ বুর্জোয়ারা নয়া উদারবাদের যুগেও সেই ব্যবস্থা কম বেশি অক্ষুন্ন রেখেছে। ফলে ইউরোপ রয়ে গেছে একটা শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী যাদের মোট আয় ওপরের ১০ শতাংশ ধনীদের মোট আয়ের চেয়েও বেশি। এক কথায়, রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মতাদর্শের অভিঘাত ইউরোপ এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। এটাই সামাজিক সম্পদ পুনর্বণ্টনের মতাদর্শের সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা।
রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগলিতে চালু ছিল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। যদি আয়ের ফারাকের দিক থেকে আমরা ওই অঞ্চলের দিকে তাকাই তাহলে এখন দেখা যাবে ওই অঞ্চলে ৫০ শতাংশ গরিব, মধ্যস্তরের ৪০ শতাংশ ও সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশের আয়ের ভাগ যথাক্রমে ১৪, ৩৮ ও ৪৭ শতাংশ। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির ক্ষেত্রে এই শতাংশ যথাক্রমে ১৩, ৪২ ও ৪৩ শতাংশ। এবং উত্তর আমেরিকায় ১২, ৪১ ও ৪৫ শতাংশ।
অর্থাৎ একেবারে ইউরোপের মতো না হলেও রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকায় মোট আয়ে মধ্যবিত্তদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে। এর মধ্যে পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে ফারাক খুব কম। তুলনায় রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় ধনীদের আয় বেশি। আবার এই চারটি অঞ্চলকে যদি বিশ্বের বাকি অঞ্চলগুলির সঙ্গে তুলনা করা যায় তাহলে একটা ফারাক স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, সাব সাহারা আফ্রিকা ও দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ধনীদের প্রাধান্য বেশি এবং মধ্যবিত্তরা দুর্বল।
মনে রাখা দরকার, বিশ্বের যে সব অঞ্চলে গরিবদের আয় তুলনায় সামান্য বেশি এবং ধনী ও মধ্যবিত্তদের ফারাক কম, সেই সব অঞ্চলে পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্ট দু’ ধরনের শাসনই চালু রয়েছে। এদের মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকা নিজেদের অর্থনীতিতে মধ্যবিত্তের প্রভাব তৈরি করে তা ধরে রাখতে পেরেছে কয়েক শতাব্দীব্যাপী ঔপনিবেশিক লুঠের মাধ্যমে এবং যা এখনও টিকে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি ও যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি মারফৎ। কিন্তু চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা কিংবা ভিয়েতনামের আয়ে মধ্যবিত্তের ভালরকম প্রভাবের উৎস হল এসব দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক সম্পদের পুনর্বণ্টন। সেই প্রক্রিয়াতেই একদা পিছিয়ে পড়া এসব দেশে একটা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে এবং টিকে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন ছাড়াই। এমনকী সমাজতন্ত্রের পতনের পরেও রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া আদি পুঁজিবাদী ছাঁচে ফিরে যায়নি। পুঁজিবাদ ও একধরনের সমাজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সম্মিলন ঘটিয়ে এমন একটা ব্যবস্থা এই দেশগুলি তৈরি করেছে যা পুরোপুরি পুঁজিবাদী শিবিরের মতো নয়। সেকারণেই সমাজতন্ত্রের আমলে গড়ে ওঠা স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের প্রভাব এখনও সেই সব দেশে বিদ্যমান। এই দেশগুলির অর্থনীতিতে এখনও বিদ্যমান সামাজিক সম্পদ পুনর্বণ্টনের প্রভাব।
বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক সম্পদের পুনর্বণ্টন না কোনওভাবেই হওয়াতেই লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরশাসকদের এত প্রভাব এবং সেকারণেই এই এলাকা রাজনৈতিক ভাবে এত অস্থির যেখানে বামপন্থীরা নির্বাচনগুলিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাফল্য পাচ্ছেন। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজ পরিবর্তনের ক্রমাগত লড়াইয়ের একটা অভিজ্ঞান। অন্যদিকে ধর্মীয় মতান্ধতা এবং মার্কিনসহ পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের মদত মধ্য প্রাচ্যে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে জিইয়ে রেখেছে।
আসলে বিশ্বব্যাপী অসাম্যে ছবির আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে সনাতন পশ্চিমী পুঁজিবাদ মডেল বনাম পুঁজিবাদের বিকল্প পথে উন্নয়নের মডেলের একটা দীর্ঘকালীন লড়াই। এবং এ লড়াইয়ে ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে সাবেকি পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ। যাঁরা বলেন সমাজতন্ত্র মৃত, আমরা তাঁদের বিশ্ব অসাম্যের সংখ্যাতত্ত্বগুলির আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলির অনুসন্ধানে নামার পরামর্শ দেব। সূত্র: ওয়ার্লড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট, ২০২২।