বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
করোনা বিপর্যয়ে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে ভারত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ সারা দুনিয়ার বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি আগাম সতর্কতা জারি করেছিল ২০২১ সালের এপ্রিল-মে মাসে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়বে যা ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া করোনার প্রথম ঢেউ থেকেও মারাত্মক সংক্রামক ও মৃত্যুবাহী হবে। সতর্ক হয়নি সরকার— প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি হয়নি কোভিড-১৯এর এই সুনামী সামলানোর জন্য।
এদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে না পড়তে দেশজুড়ে হাহাকার। হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই, প্রয়োজনীয় ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন নেই। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ অকাতরে মারা যাচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি করানোর জন্য আত্মীয়-পরিজনরা হন্যে হয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হাসপাতালে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছেন ভ্যাকসিনের জন্য— ভ্যাকসিন যদি নাও মেলে অন্তত রেজিস্ট্রেশন করার জন্য। রাত থেকে লাইন দিয়ে ভ্যাকসিন না পেয়ে কোথাও বয়স্ক মানুষেরা পথ অবরোধে নামতে বাধ্য হয়েছেন। শ্মশানে-কবরস্থানে পড়ে থাকছে সারি দিয়ে মৃতদেহ— পরিজনরা শোকস্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। দেশের নানান প্রান্তে জ্বলছে গণচিতা, খোঁড়া হচ্ছে গণকবর। ১৯৪৩ সালে বাংলায় মন্বন্তরের পর এই দৃশ্য দেখা যায়নি। সারা দেশ যেন আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে।
এদেশ জুড়ে যে মর্মান্তিক ছবি প্রতি দিন উঠে আসছে তা কি অনিবার্য ছিল— তা কি কোনওভাবেই প্রতিরোধ করা যেত না।
অতিমারির প্রথম ঢেউ যখন এদেশে আছড়ে পড়ে তখন ভারত সরকার অতিথি ট্রাম্পকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত ছিল। যে ট্রাম্পের হঠকারিতা ও অবৈজ্ঞানিক ঔদ্ধত্যের কারণে আমেরিকার নাগরিকদেরই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু গুণাগার দিতে হয়েছে। তারপর অতিথি বিদায় নিলে আচমকা যেন জেগে উঠে মোদি সরকার। ‘জনতা কার্ফু’ আর থালা বাজিয়ে সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করেন। লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারকে ঠেলে দেওয়া হয় কর্মহীন অনিশ্চিয়তার মধ্যে। ঘরে ফেরার মরিয়া তাগিদে দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক যাত্রা সভ্যতার ইতিহাসে কালো দাগ রেখে যায়। পৃথিবীর দীর্ঘতম লকডাউনের পরিণতিতে দেশের প্রায় ১৪ কোটি শ্রমজীবী কাজ হারান। অতিমারির এই কর্মহীন সময়ে সরকার তথা রাষ্ট্র এই অগণিত শ্রমিক সাধারণ ও দেশবাসীকে কার্যত ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিল। অসাম্য পীড়িত এই সমাজ কতটা অমানবিক হতে পারে লকডাউন তা উলঙ্গ করে দিয়েছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে ঘোষণা করেছে, করোনা প্রতিরোধের চাবিকাঠি হলো “টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট”। পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সংক্রমিতকে চিহ্নিত করো, সংক্রমিতকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন করে দ্রুত চিকিৎসা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করো।
গত বছরই কোভিড-১৯ প্রতিরোধে দেশ ও রাজ্যের অপ্রতুল স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর দৈন্যতা প্রকট ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল— প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষার সরঞ্জাম, কিট, ভাইরাস প্রতিরোধক মাস্ক, গ্লাভস, পোষাক, স্যানিটাইজার, আইসোলেশন ওয়ার্ড, ভেন্টিলেটর, হাসপাতাল, চিকিৎসক ও চিকিৎসা-কর্মীর অভাব করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কঠিন করে তোলে। উদারনীতির রাস্তায় সরকারি বা গণ-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেটুকুও ছিল তার সর্বনাশ করা হয়েছিল আগেই। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা পরিষেবার বৃহদাংশকে তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের অবাধ লুঠের জন্য। অতিমারির প্রথম পর্বেই দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন— দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কাছে আধুনিক চিকিৎসা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আদালত কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করেছেন, গত ১৪ মাস সরকার কী করছিল। আসলে অতিমারির এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সরকার সুযোগের সদব্যবহার করছিলেন। সরকার এই লম্বা সময়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন দেশের প্রাকৃতিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদগুলি দেশি-বিদেশি কর্পোরেট ও ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের কাছে বেচে দেওয়ার জন্য, ব্যস্ত ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধিকার কেড়ে নিয়ে ত্রিখন্ডিত করার কাজে, ব্যস্ত ছিলেন অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করে মন্দির তৈরির জন্য কোটি কোটি অর্থ সংগ্রহের জন্য।
দেশের বিভিন্ন আদালত এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির জন্য সরকারের অসংবেদনশীল ঔদাসিন্য, নিস্ক্রিয়তাকেই দায়ী করেছেন এবং সরকারকে অতি দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কোভিড প্রতিরোধে সরকারের নীতিসমূহকে প্রশ্ন করেছেন। সরকারের স্বাস্থ্য নীতি, ভ্যাকসিন নীতি, অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ চালু রাখা, জীবনদায়ী ওষুধ উৎপাদন ও সরবরাহ চালু রাখা— সব কিছুই আজ চ্যালেঞ্জের মুখে।
জর্ডনে অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় সেখানকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এদেশে সেসব লাজলজ্জার বালাই নেই। দেশে অক্সিজেনের আকাল। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টে রোগীরা ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে যত অক্সিজেন দরকার দেশে তার মজুত নেই। সরকার বলেছিল, ১৬২টি হাসপাতালে নিজস্ব অক্সিজেন উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। হয়েছে মাত্র ৩২টিতে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারে বারেই আশ্বস্ত করেছিলেন, ভারতে যত অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, তার তুলনায় চিকিৎসার প্রয়োজনে অক্সিজেনের ব্যবহার অনেক কম। সুতরাং শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। এখন উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, শিল্পে ব্যবহারের অক্সিজেন চিকিৎসায় ব্যবহারের কথা হচ্ছে— কিন্তু অক্সিজেন ভর্তি করার জন্য প্রয়োজনীয় সিলিন্ডারের জোগান নেই, অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবহনের জন্য পর্যাপ্ত ট্রাকের ব্যবস্থাও সরকারের ব্যবস্থাপনায় নেই। এতদিন তো সরকার অন্য জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিল। একটা সরকার কতটা দায়িত্বজ্ঞান হলে অতিমারির সময় দেশের মানুষের কথা না ভেবে বিদেশে অক্সিজেন রপ্তানি করতে পারে। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্র ৯৩০০ টন অক্সিজেন বিদেশে রপ্তানি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ল্যাবরেটরি এবং উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে বঞ্চিত করে সরকার ভ্যাকসিন উৎপাদনের দায়িত্ব মাত্র দুটি বেসরকারি সংস্থা— সিরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেকের হাতে তুলে দিয়ে একচেটিয়া মুনাফা কামানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওই বেসরকারি সংস্থা দুটি নাকি ‘‘কেন্দ্রের নির্দেশিকা অনুযায়ী’’ ভ্যাকসিনের দাম ধার্য করছে। সিরাম যেখানে কেন্দ্রকে ১৫০ টাকা দামে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রি করছে— সেখানে রাজ্যগুলির জন্য তারা ঠিক দ্বিগুণ দাম ৩০০ টাকা ধার্য করেছে। কেন্দ্র সিরামকে ১১০ মিলিয়ন ডোজ অর্ডার দিয়েছে। সিরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদর পুনাওয়ালাও এক উচ্ছ্বসিত টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘‘কেন্দ্রের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের জন্য নরেন্দ্র মোদিজী এবং এন সীতারমণজীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’’
একইভাবে, ভারত বায়োটেক কেন্দ্রকে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন বিক্রি করছে ১৫০ টাকা দামে, রাজ্যগুলিকে ৪০০ টাকা দামে। উল্লেখ্য প্রত্যেককে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির ভ্যাকসিনের চাহিদার সামান্য একাংশই সরবরাহ করছে। সুতরাং ভ্যাকসিনের দুটি ডোজের জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে কেন্দ্রের তুলনায় দ্বিগুণ ব্যয়ভার বইতে হবে। দুটি সংস্থাই আরও চড়া দামে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে ভ্যাকসিন বিক্রি করছে।
ভ্যাকসিনের দামে কেন্দ্র ও রাজ্যের এই পার্থক্যের জন্য রাজ্যগুলির ঘাড়ে বিপুল বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপবে। ফলে অধিকাংশ রাজ্যই সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার দায় থেকে হাত গুটিয়ে নেবে। মোদি সরকারের অনুভূতিহীন ভ্যাকসিন-নীতির জেরে অধিকাংশ মানুষই করোনা ভ্যাকসিন নিতে সক্ষম হবেন না বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, করোনা অতিমারির এই ভয়াল সময়ে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে কি মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে চাইছে মোদি সরকার?
সরকারের দায়িত্ব দেশের সমস্ত নাগরিককে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা। বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তাদের নাগরিকদের ভ্যাকসিনের জন্য কোনও অর্থ নিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার অভিযান চলছে। আত্মনির্ভর ভারতে কিন্তু অন্য ব্যবস্থা। এদেশে সরকার ভ্যাকসিনের দায়িত্ব না নেওয়ায় সাধারণ মানুষের আতঙ্ক বহুগুণ চেপে বসেছে।
দেশের মানুষের কথা না ভেবেই সাড়ে ছয় কোটি ভ্যাকসিন বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। এখন ভারত করোনা সংক্রমণে বিশ্বরেকর্ড গড়লেও ভ্যাকসিনের জোগান নেই। বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে বহু ভ্যাকসিন কেন্দ্র। যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন তারা দ্বিতীয় ডোজ পাবেন কিনা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ব্যবস্থা মেনে নেওয়া যায় না— কেন্দ্রীয় সরকারকেই রাজ্যগুলিকে ভ্যাকসিন বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে।
যে নরেন্দ্র মোদির সরকার গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণের জন্য দিল্লিতে তবলিগি জামাতের সমাবেশকে দায়ী করেছিল, সেই সরকারই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাক্কালে সাড়ম্বরে কুম্ভমেলার আয়োজন করতে দিতে গিয়ে একটি বারের জন্য দ্বিধা করেনি। যে কুম্ভমেলা বিপুল সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদমাধ্যম পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে করোনা বিধিকে তোয়াক্কা না করে নির্বাচনী সভাগুলিতে বিপুল জনসমাগমকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলিকে একহাত নিয়েছে। কিন্তু সারা দেশে যেখানে নির্বাচন হয়নি সেখানেও কেন অতিমারি প্রাণঘাতক হিসাবে ফিরে এল। এই উপলক্ষে একথা বলা যায়, নির্বাচন কমিশন যদি নির্বাচনী প্রচারের জন্য ভার্চুয়াল সভার বিধান দিত, তাহলে পশ্চিমবাংলা সহ পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনী সভার কারণে অতিরিক্ত সংক্রমণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। কিন্তু সংক্রমণের কারণ দেখিয়ে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনকেই স্থগিত রাখার যে সুর সামনে এসেছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। করোনা পরিস্থিতেই আমেরিকাতে গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নাগরিকদের রায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিদায় নিতে হয়েছে। একথা ঠিক যে করোনার এই প্রাণঘাতী পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় আট দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই দ্বিমত উত্থাপিত হয়েছে। আট দফার সুযোগ নিয়ে প্রায় ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ করে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা বাংলা দখলের স্বপ্ন দেখেছেন। তাতে ‘যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান’। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের আট দফায় নির্বাচন করার তুঘলকি সিদ্ধান্তও বাংলার ভোটারদের বড় অংশের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। কারণ বিগত পঞ্চায়েত ও বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে নির্বাচকদের একটা বড় অংশ রাজ্যের শাসক দলের তান্ডবে নিজেদের পছন্দ মতো ভোট দিতে পারেননি।
আসলে মোদি সরকার নির্বাচন কমিশনের মতো স্বশাসিত সংস্থাকে সরকারের উপাঙ্গে পরিণত করেছে। করোনা সংক্রমণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অভিযুক্ত করার মধ্যেও কোথায় যেন অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশের নাজেহাল অবস্থার জন্য দায়ী মোদি সরকারকে আড়াল করার চেষ্টা লুকিয়ে আছে।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সারা দেশে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা মৃত্যুকে পরোয়া না করে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষের প্রাণ রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেলাম এই সামনের সারির যোদ্ধাদের।
গোটা দেশ যখন মৃত্যুর উপত্যকা তখন মহারাষ্ট্রের নন্দুরবার জেলা এবং কেরালা রাজ্য যেন মরুদ্যান। আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিয়ে মানুষকে বাচাঁনোর মহান যজ্ঞে নেমেছেন নন্দুরবারের জেলা শাসক এবং কেরালার বাম-গণতান্ত্রিক সরকার। সারা দেশ যখন অক্সিজেনের জন্য হাহাকার করছে, কেরালায় তখন অক্সিজেন উদ্বৃত্ত। কেরালা এখন অক্সিজেন সরবরাহ করছে প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাডুতে। এমনকি কর্ণাটক, গোয়াতে— যেখানে রয়েছে মোদির ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। এবং লাক্ষাদ্বীপেও।
কোভিড পীড়িত সময়ে এলডিএফ সরকার অক্সিজেন উৎপাদন বাড়াতে রাজ্য সরকারি সংস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেছে। গত বছর এপ্রিলে কেরালায় অক্সিজেনের দৈনিক মজুত যেখানে ছিল ৯৯.৩৯ মেট্রিক টন, এবছর এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৯ মেট্রিক টন। কোভিড-১৯এর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করার জন্য কেরালা সরকার ৪৮৩ কোটি টাকা ব্যয় করে এক কোটি ভ্যাকসিন জরুরি ভিত্তিতে কেনার ব্যবস্থা করেছে।
নন্দুরবারের জেলা শাসক এবং কেরালার বাম সরকার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে কোভিড মোকাবিলায় অনেকাংশে সফল হয়েছে। সেখানে প্রবল পরাক্রান্ত মোদি সরকার, যাঁদের হাতে গোটা রাষ্ট্রটাই, তাঁরা দেশের এই ভয়ানক বিপর্যয়ের সময় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলো সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবে এবং কর্পোরেট ও ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের মুনাফা স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে।
শেষ করার আগে বলা যায়, গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে বিপর্যস্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে, আমপানের ঝড়ে বিপন্ন মানুষের সাহায্যে যে নবীন প্রজন্ম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন— রাজ্য জুড়ে শ্রমজীবী ক্যান্টিন, শ্রমজীবী বাজার গড়ে তুলে তারুণ্যের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদেরই এক অংশ রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সবচেয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থতিতেও তাঁরা পৌঁছে গেছেন খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী, প্রান্তিক মানুষের ঘরে ঘরে। নেতা হিসেবে না, মানুষের আপনজন হিসেবে। নির্বাচনী লড়াইয়ের ব্যর্থতা উপেক্ষা করে সেই তারুণ্য কিন্তু আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায়। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে গিয়ে ছুটে যাচ্ছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন রেড ভলেন্টিয়ারস। অল্পবয়সিরা নাম নথিভুক্ত করে কাজ করছেন অতিমারির প্রাণঘাতী সংক্রমণে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য। এতসবের পরেও এই তারুণ্য মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার আশা জাগানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।