বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
২০২১ সালে কেরলে বামেদের শ্লোগান ছিল ‘এলডিএফ আসছেই’। ভোট শেষে দেখা গেল কেরলে এলডিএফই ক্ষমতায় এল। বামেদের এই আত্মবিশ্বাসের উৎস কোথায়? উৎস সরকারে জনমুখী কল্যাণ কর্মসূচি এবং সুশাসন। কেরলে যখন অচ্যুত মেনন মুখ্যমন্ত্রী পদে ছিলেন, তখনই টেকসই উন্নয়নের বিশ্ববিখ্যাত কেরালা মডেল রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেটাই আরও উন্নত মানে পৌঁছে দিয়েছে এলডিএফ সরকার। এটাও এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, কেরালা মডেল দিয়েই কোভিডকে প্রতিরোধ করা যায়। এটা শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রের সাফল্য নয়। এই সাফল্যের মূল কথা হলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একটা লোকও প্রান্তিক স্তরে পড়ে থাকবে না।
নোয়াম চমস্কিও একথা মেনে নিয়েছেন যে, কেরালা সম্পূর্ণ ভিন্নপথে কোভিডের মোকাবিলা করেছে। অতিমারির কারণে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়েছে। মুক্ত বাজারের ক্রোনি পুঁজিবাদী অর্থনীতি দিয়ে এই বাড়তি বিভাজনের মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। তখন একমাত্র পথ ছিল, অতিমারির মোকাবিলায় রাষ্ট্র সর্বতোভাবে হস্তক্ষেপ করবে। কেরলে ঠিক করা হয়েছে। সেটাই কেরালা মডেলের সাফল্যের মূল কথা।
ভারতে বহু এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রয়েছে চরম অব্যবস্থা। ফলে দেশের ৬৬ শতাংশ মানুষই চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। অর্থনীতিতে যখন ধাক্কা আসে, বেসরকারি ক্ষেত্র তা সামলানোর জন্য কিছুই করে না। এই কারণে সংকটগ্রস্থ অর্থনীতিতে যখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের কোভিড অতিমারি আছড়ে পড়ল, তখন রাজ্যগুলি এর মোকাবিলা করে উঠতে পারল না। এরপর এল লকডাউন। এতে বিধ্বস্ত হলো অর্থনীতি। দুঃসহ হয়ে উঠল সাধারণ মানুষের জীবন। দারিদ্র, ক্ষুধা ও আয় কমে যাওয়ায় সমাজে অসাম্য আরও বাড়ল। তবে এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রমী হয়ে দাঁড়াল কেরালা। সারা দেশের মধ্যে কেরালাই সেইরাজ্য যারা জনস্বাস্থ্যে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে। রাজ্যের সমগ্র স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ওপর বাম সরকারের জোরালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সেকারণেই অতিমারির মোকাবিলায় দারুণভাবে সাড়া দিতে পেরেছে স্বাস্থ্য দপ্তর। এর ফলে কোভিডে মৃত্যুর হার কমেছে। এবং অল্প খরচে সেরা চিকিৎসা পরিষেবা পেয়েছেন মানুষজন।
এলডিএফ সরকারের আমলে কেরলে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। অতিমারির সময় রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টরের পরিকাঠামো খুব ভালভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। কেরালা মিনারাল অ্যান্ড মেটালস লিমিটেডের অক্সিজেন প্ল্যান্ট এমনভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করেছে যাতে করে অক্সিজেনের অভাব হয়নি। একজন লোকও যাতে অভুক্ত না থাকে সেজন্য সব পঞ্চায়েতে কমিউনিটি কিচেন খোলা হয়েছে। লোকজনকে বিনামূল্যে রেশন দিয়েছে রাজ্য সরকার। এর সঙ্গে কেন্দ্রের দেওয়া রেশনও কাজ লাগানো হয়েছে।
আজকের এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের দুনিয়ায় কেরালা অনুসরণ করে চলে একটা আদ্যন্ত মার্কসীয় মডেল। ২০০৮ সালের সাবপ্রাইম সংকটের পর স্টিগলিৎস রিপোর্টে বলা হয়েছিল অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা তখন বলেছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সেক্টরকে আরও শক্তিশালী করতে এবং বাজারকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণে আনতে। কিন্তু পুঁজিবাদী ও দক্ষিণপন্থী শিবির এই পরামর্শ শোনেনি। ৯০এর দশকের গোড়ায় নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো লিখেছিলেন, কেন মেডিক্যাল সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না মুক্ত বাজার। তখন একথায় পৃথিবী কেন, ভারতও কান দেয়নি।
নরেন্দ্র মোদি আবার এগোলেন এমন এক অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে যা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের পথ ধরল এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা তুলে দিল। বেসরকারিকরণের নীতি আঁকড়ে ধরলেন তিনি এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশার দিকে নজরই দিলেন না। দারিদ্র, ক্ষুধা, অসাম্য বেড়েই চলল। কর্মহীনতা আকাশ স্পর্শ করল। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে গেল, সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্প তুলে দেওয়া হলো। চাষিদের পণ্যের দাম কমানো হলো। তাদেরও মুক্ত বাজারের নির্মমতার হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো।
এসবরেই বিকল্প হলো কেরালা মডেল। এই মডেলে শিক্ষা সর্বজনীন এবং তা দেওযা হয় নিখরচায়। রয়ালটি সহ চাষিদের দেওয়া হয় ফসেলর বেশি দাম। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা তুলে না দিয়ে রক্ষা করা হয়। সেগুলো লাভে চলে এবং অর্থনীতিকে জোরদার করে। হাসপাতালগুলিতে থাকে সেরা পরিকাঠামো ও সর্বোচ্চ পরিষেবা। রেশন ব্যবস্থা এতটাই জোরদার করা হয় যে লোকে না খেয়ে থাকে না। আসলে কেরালা মডেল হলো মানব উন্নয়নের মডেল, টেঁকসই উন্নয়নের মডেল, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের মডেল, সমাজাতান্ত্রিক নীতিসমূহের মডেল, গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মডেল, মহিলাদের ক্ষমতায়নের মডেল, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং প্রগতিশীল চিন্তার মডেল।
আসলে কেরালায় বামেদের সাফল্যের কারণগুলো এরকম:
১। লোকসানে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি লাভজনক হয়ে উঠেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনিট নতুন করে খোলা হয়েছে। রাজ্যের কোষাগারে এই সব সংস্থা দিয়েছে ১২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রের কোষাগারে গেছে ৮৮১ কোটি টাকা। সবটাই হলো লাভের টাকা।
২। এই রাজ্যের অসামরিক সরবরাহ দপ্তরের অধীনে রয়েছে ১৫৮৯ মাভেলি সুপার মার্কেট এবং ৯৫টি সাবারি মেডিক্যাল স্টোর্স। এগুলো থেকে মুদিখানার জিনিস ও ওষুধ স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। এছাড়া ৮৮ লক্ষ ৬০ হাজার জন রেশন কার্ডধারী পান বিনামূল্যে রেশন।
৩। কেরালাই দেশের প্রথম রাজ্য যারা কৃষকদের রয়ালটি দিয়েছে। প্রায় ৫ হাজার একর শুখা জমিকে চাষের জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কৃষিপণ্যে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ এমএসপি দেয় কেরালা।
৪। ৪৬২৫ ভূমিহীন তপশিলি উপজাতি পরিবার জমি পেয়েছেন। গত ৫ বছরে ১,৭৭,১১২ টি পরিবারকে জমির চূড়ান্ত মালিকানা দেওয়া হয়েছে।
৫। প্রান্তিক গোষ্ঠীর লোকেদের দেওয়া হয়েছে আর্থিক ও অন্যান্য ধরনের সাহায্য। তৈরি করা হয়েছে হাইটেক স্কুল। কেরালাকে নলেজ সোসাইটি হিসাবে গড়ে তোলা লক্ষ্য।
কেন্দ্রের বঞ্চনার শিকার কেরালা
১। ২০১৪-১৫ সালে কেন্দ্রের এনআরইজিএতে কেরালার অংশ ছিল ২৫৮ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ সালে তা কমিয়ে করা হয়ে মাত্র ৭১ কোটি টাকা।
২। ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে কেরালা পেয়েছিল মোট কেন্দ্রীয় বাজেটের ০.৯১ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে হয়েছে ০.৬১ শতাংশ।
৩। ২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কর্মসূচি বাবদ কেরালা পেয়েছিল ১০০০ কোটি টাকার বেশি। এনডিএ আমলে তা ৩৫ শতাংশ কমানো হয়েছে।
৪। সর্বশিক্ষা অভিযানে বরাদ্দ ৪১৩ কোটি টাকা কমিয়ে করা হয়েছে ২০৬ কোটি।
৪। দু’ দু’ বার বন্যা হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোগ তহবিলের তালিকা থেকে কেরালার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
৬। ২০১৯ সালের বন্যার সময় কেরালা আর্থিক সহায়তা হিসাবে চেয়েছিল ১২০১ কোটি টাকা। পেয়েছিল মাত্র ৫২.২৭ কোটি টাকা।
৭। ২০১৮ সালের বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২৬,৭১৮ কোটি টাকা। কেন্দ্র দিয়েছিল মাত্র ২৯০৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় সরকার এনআইএ এবং সিবিআইয়ের মতো সংস্থাগুলিকে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার কাজে লাগিয়েছে। সিপিআই-এর নৈতিক সমর্থন কাজে লাগিয়ে এলডিএফ এই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের কমিউনিস্ট বিরোধী বিদ্বেষের বিষয়টি কেরলের মানুষ বুঝতে পারেন এবং তা ধুলোয় মিশিয়ে দেন।
নতুন বাম সরকার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি চালিয়ে যাবে এবং চালিয়ে যাবে ফ্যাসিবিরোধী কার্যক্রমও। ভবিষ্যতে কেরালা মডেলই ভারতকে নেতৃত্ব দেবে। ততদিন পর্যন্ত দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তির কাছে কেরালা রাজ্য ও কেরালা মডেল একটা দুঃস্বপ্ন হয়েই জেগে থাকবে।
লেখক কেরালার সিপিআই, রাজ্য সম্পাদক।
সূত্র — দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৯ মে, ২০২১