বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

বিপর্যয়ের সুবর্ণসুযোগ

বিপর্যয়ের সুবর্ণসুযোগ

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

photo

১ মে, ২০২০, শ্রমজীবী ভাষা - ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম কথাটা এখন আবার খুব শোনা যাচ্ছে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কানাডার লেখক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী নাওমি ক্লাইনের লেখা দ্য শক ডকট্রিন: দ্য রাইজ অব ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম। সে বইয়ের অন্যতম প্রধান বক্তব্য: নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্র পরিকল্পনা করেই বিপর্যয় সৃষ্টি করে, কারণ বড় রকমের সঙ্কটের কালে এই তন্ত্রের ধারক ও বাহকদের পক্ষে অনুকূল এমন অনেক নীতি এবং কার্যক্রম চালু করে দেওয়া যায়, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যা বলবৎ করা তুলনায় কঠিন। যুদ্ধ বাধলে মুনাফা লোটার সুবিধে হয়, তাই ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশের পক্ষে যুদ্ধ অতি উপকারী বস্তু— এ কথা তো বরাবরই জানা আছে। কিন্তু নাওমির প্রতিপাদ্য আরও গভীর এবং ব্যাপক। তিনি বলতে চেয়েছেন বিপর্যয় কেবল মুনাফা বাড়ায় না, রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে নিয়োলিবারাল অর্থনীতির চালকদের আধিপত্য আরও জোরদার করে তুলতে প্রভূত সাহায্য করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক অভিযান সহ নানা রণনীতিকে এই ধারণার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি। এই বিশ্লেষণের সমালোচনা অনেক হয়েছে। সমালোচকদের মতে নাওমি সমস্যাটাকে অতিসরল করে দেখিয়েছেন— আসলে বিভিন্ন বিপর্যয়ের কারণ এবং পরিণাম দুইই অনেক বেশি জটিল।
কোভিড-১৯ নামক বিপর্যয় পরিকল্পনা করে সৃষ্টি করা হয়েছে এমন কথা বলা চলে না। এই বিপর্যয়ের ফলে নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রের আধিপত্য বাড়বে এমন কোনও সুনিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণীও এই মুহূর্তে ঘোষণা করা যাবে না। বস্তুত বিশ্ব অর্থনীতির প্রচলিত ব্যবস্থা, গতিপ্রকৃতি, এমনকি তার কাঠামোটিও আপাতত বড় রকমের অনিশ্চয়তার সম্মুখীন। এই মুহূর্তে দুনিয়া জুড়ে যা ঘটছে তাকে বিপর্যয়-ধনতন্ত্রের লীলা বলে অভিহিত করলে সেটা অতিসরলীকরণই হবে। কিন্তু এই দুর্যোগের সৃষ্টি, প্রসার এবং ফলাফলের গোটা প্রক্রিয়াটিতে ধনতন্ত্রের যে বিরাট ভূমিকা, সেটা লক্ষ না করলে যে অপরাধ হয় সেটা অতিসরলীকরণের চেয়ে বহুগুণ বেশি গর্হিত।
প্রথমত এ কথা ইতিমধ্যেই সুপরিচিত যেঅন্য প্রাণীর দেহ থেকে নোভেল করোনাভাইরাসের মানবশরীরে চলে আসার ঘটনা বিনা কারণে ঘটেনি, মুনাফার তাগিদে প্রকৃতি ও পরিবেশের যথেচ্ছ সংহার এবং খাদ্য, ‘ওষুধ’ ও অন্যান্য সামগ্রী হিসেবে নানা প্রাণীর দেহকে ব্যবহার করার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এই সংক্রমণকে, এর আগের বিভিন্ন ভাইরাসের সংক্রমণের মতোই, কার্যত অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। বস্তুত বিভিন্ন দেশে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের আপন দেশেও, গত দশ-পনেরো বছরে বিশেষজ্ঞরা মহামারির সম্ভাবনা নিয়ে বহু রিপোর্ট তৈরি করেছেন এবং বহু সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন। এই বিপদ ঠিক কোন তারিখে কোথায় আসবে জানা ছিল না, কিন্তু আসবে সেটা অজানাও ছিল না। সব জেনেশুনেও মানুষ প্রকৃতির ওপর তার যথেচ্ছ ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে, কারণ পুঁজিবাদ তাকে সেটা চালিয়ে যেতে শিখিয়েছে, থামতে শেখায়নি।
দ্বিতীয়ত ভাইরাস সংক্রমণের মোকাবিলায় দুনিয়ার, বিশেষত ধনী দুনিয়ার, বহু দেশেই যে ভয়ানক অপ্রস্তুতি, অপদার্থতা, এমনকি মারাত্মক অবহেলা দেখা গিয়েছে, তার পিছনেও কাজ করেছে বাজার অর্থনীতির ওপর নিঃসংশয় নির্ভরশীলতা। জনস্বাস্থ্যের আয়োজনে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ না করে তাকেও মুনাফার কারবারে পরিণত করলে ফল কী হয়, তার উৎকট নজির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম বা কেরলের মতো নানান দৃষ্টান্ত পরিষ্কার দেখিয়ে দেয় এই সংক্রমণের সঙ্গেও সফল ভাবে লড়াই করা সম্ভব। এমনকি ইউরোপের মধ্যেও কিছু দেশের, যেমন জার্মানি বা নরওয়ের অভিজ্ঞতা একই কথা জানায়। এই দেশগুলির রাজনৈতিক চরিত্র এক নয়, কিন্তু একটি বিষয়ে এদের মিল আছে— কোথাওই ‘বাজার যা করবে তা-ই হবে’ বলে জীবনমৃত্যুর দায়দায়িত্ব মুনাফাসন্ধানী পুঁজির পদতলে সমর্পণ করা হয়নি। ভবিষ্যতে এই বিপর্যয়ের ইতিহাসলেখা হবে। সেটা নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রের গৌরবের ইতিহাস হবে না।
তৃতীয়ত, এই সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী কোথায় পৌঁছবে, বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা চরিত্রের বিবর্তন কী হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই ঠিকই, কিন্তু সেই বিবর্তনে ধনতন্ত্র এবং তার হাতিয়ার বাজার অর্থনীতির ভূমিকা বিরাট হতে বাধ্য। ইতিমধ্যেই তার নানা সঙ্কেত মিলছে নানা দিক থেকে। অতিমারির মধ্যে দাঁড়িয়েই বৃহৎ পুঁজির পারস্পরিক লেনদেন চলছে, লকডাউনের দুনিয়ায় দেশ-মহাদেশ-গোলার্ধের সীমান্ত হেলায় টপকে মহাকায় কর্পোরেট সংস্থার শেয়ার কিনছে অতিকায় কর্পোরেট সংস্থা, অর্থনীতিতে নিজেদের সম্মিলিত আধিপত্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে নেওয়াই যে লেনদেনের লক্ষ্য। পুঁজি ক্রমশই পুঞ্জীভূত হবে এবং তার মালিকানা ক্রমশই কেন্দ্রীভূত হবে— ধনতন্ত্রের এই ধর্ম অনুশীলনের পালে এখন আরও জোর হাওয়া লাগতে পারে। অন্য দিকে, গভীর অতিমন্দার নিশ্চিত অতল থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করার জন্য দেশে দেশে বেসরকারি পুঁজিকে যে বিপুল উৎসাহ ও সুবিধা দেওয়া হবে, তার একটা অঙ্গ হবে পরিবেশ নিয়ে মাথা না ঘামানোর ছাড়পত্র। ইতিমধ্যেই চীনে তেমন বিনিয়ন্ত্রণের সঙ্কেত মিলেছে। অর্থাৎ, বাজারের তাড়নায় পরিবেশ সংহারের গতি আরও বাড়বে। আবার, কোনও সন্দেহ নেই, ‘উন্নততর’ স্বাস্থ্য পরিষেবা তৈরির নামে চিকিৎসার দুনিয়ায় কর্পোরেট পুঁজি তার সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচণ্ড চেষ্টা চালাবে। এগুলি কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র।
তার পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়, পুঁজির এই সব উদ্যোগ শেষ অবধি কতটা সফল হবে? নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্র তার আধিপত্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারবে কি? এর বিপরীত শক্তিও কাজ করছে এবং করবে। প্রথমত, বাজার অর্থনীতির অক্ষমতার দিকটা দুনিয়ার মানুষের কাছে এক ধাক্কায় অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক চোখের সামনে দেখছেন যে, প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজের একেবারে প্রাথমিক এবং মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটাতে অক্ষম এবং অনিচ্ছুক। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো না পাল্টে তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে কি না, সেটাই এখন একটা বড় প্রশ্ন। অর্থনৈতিক সঙ্কট ধনতন্ত্রের অন্তর্নিহিত ব্যাপার। সেই সঙ্কট তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, সেটাও বহুচর্চিত সত্য। তার পরিণাম কী দাঁড়াবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ মানে নিয়তি নয়। বর্তমানের গর্ভ থেকেই সেই ভবিষ্যৎ জন্ম নেবে, কিন্তু তার স্বরূপ কী হবে সেটা কোনও পূর্বনির্ধারিত সত্য নয়, আমরা কী করব তার প্রভাব পড়বে সেই ভবিষ্যতের ওপর।
এখানেই প্রতিরোধের গুরুত্ব, প্রতিস্পর্ধার গুরুত্ব। বড় পুঁজি এবং বহুলাংশে তার বশীভূত রাষ্ট্রশক্তি এই সঙ্কটের মোকাবিলায়, এবং এই সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে, আধিপত্য কায়েম রাখার এবং আরও বাড়িয়ে তোলার যে চেষ্টা করবে তাকে প্রতিহত করার জন্য সংগঠিত প্রতিরোধ জরুরি। এই সঙ্কটই সেই প্রতিরোধের নতুন রসদ সরবরাহ করতে পারে। এক দিকে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বহু মানুষের মরিয়া প্রতিরোধস্পৃহা, অন্য দিকে স্থিতাবস্থার গভীর অন্যায় সম্পর্কে মানুষের নতুন ও প্রখর উপলব্ধি— এই দুইয়ের মিলন থেকেই জন্ম নিতে পারে নতুন সংগ্রামের শক্তি, যার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা অপরিমেয়। সেটা, অবশ্যই, সম্ভাবনামাত্র। তাকে ফলবান করে তোলার জন্য যে বস্তুটির প্রয়োজন তার নাম রাজনীতি। গণ-রাজনীতি। গণ সংগঠনের রাজনীতি। কোভিড-১৯ নামক বিপর্যয় সেই রাজনীতির প্রয়োজন বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। তার নতুন সুযোগও তৈরি করে দিয়েছে। একটা নয়, অনেক সুযোগ। বস্তুত, পুঁজি তার সঙ্কট মোকাবিলায় যত তৎপর হবে, ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ তার নখদাঁত যত বার করবে, প্রতিরোধের তাগিদ ততই বাড়বে। সেই তাগিদ কতটা কাজে লাগানো হবে, সেটাই প্রশ্ন।
একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। দৃষ্টান্তটি এ দেশেরই। সম্প্রতি শোনা গেল, কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করেছে ১৯৪৮ সালের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট সংশোধন করা হবে, যাতে শ্রমিক-কর্মীদের আপাতত দিনে আট ঘণ্টার জায়গায় বারো ঘণ্টা কাজ করানো যায়। এখনও আইনে ‘ওভারটাইম’-এর ব্যবস্থা আছে, কিন্তু প্রথমত সেটা কিছুটা বিশেষ বন্দোবস্ত, এবং দ্বিতীয়ত তার জন্য বাড়তি হারে বেতন বা মজুরি দিতে হয়— স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঘণ্টা প্রতি দ্বিগুণ টাকা দেওয়াই দস্তুর। কেন্দ্রীয় সরকার নাকিচায় যে সেই বাড়তি মজুরির নিয়মটা বহাল থাকবে। সরকার কী করতে চাইছে সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। শ্রমিক সংগঠনগুলি এই উদ্যোগে আপত্তি জানালে তার জবাবে সরকারি মহল বলেছে আইনে এমন কোনও সংশোধনের কথা ভাবা হচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটাই একটা ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে। এমনও হতে পারে, কারণ হয়েই থাকে— এ-ধরনের একটা প্রস্তাব সংবাদমাধ্যমে ‘ফাঁস’ করিয়ে দিয়ে দিল্লীশ্বররা জল মাপতে চান, দেখতে চান এর কী প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু, লক্ষণীয়, ইতিমধ্যেই রাজস্থান, পাঞ্জাব ও গুজরাত বারো ঘণ্টার শ্রমদিবস চালু করার আইনি ব্যবস্থা করে দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে গুজরাত সরকার বলে দিয়েছে, বাড়তি সময়ের কাজের জন্য ঘণ্টাপ্রতি বাড়তি হারে বেতন না দিয়ে একই হারে টাকা দেওয়া হবে!
এই সংশোধনের সরকারি যুক্তি হল: ভাইরাসের মোকাবিলায় সাময়িক ভাবে এই বিশেষ ব্যবস্থা আবশ্যক। কারণ প্রথমত কলকারখানা খুললে যথেষ্ট কর্মী পাওয়া যাবে না, পরিযায়ী শ্রমিকরা অনেকেই কাজের জায়গায় যেতে পারবেন না বা চাইবেন না। দ্বিতীয়ত এখনও অনেক দিন অবধি কাজের জায়গায় ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রাখার জন্য কর্মীর সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম থাকতে হবে। কম কর্মী দিয়ে কাজ তুলতে গেলে প্রত্যেককে বেশি সময় কাজ করতে হবে। এই যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণীয় বলে মনে হতে পারে— আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য আপৎকালীন বন্দোবস্তের বিধান অভিনব কিছু নয়। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয়, সত্য অনেক সময়ই তার সঙ্গে মেলে না। শ্রমদিবসের ধারণাটি সংশোধন করে নেওয়ার এই প্রস্তাব সম্পর্কে গভীরতর প্রশ্ন হল: এটা সত্যিই সাময়িক বন্দোবস্ত, না এর পিছনে গভীরতর অভিসন্ধি কাজ করছে? আপৎকালীন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের আয়োজন করা হচ্ছে না তো? রটনা এবং ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে তেমন সন্দেহ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
শ্রমিক সংগঠনগুলি তেমন আশঙ্কাই জানিয়েছে। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন একযোগে এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, দেশ জুড়ে কর্মহীন শ্রমজীবীর সংখ্যা যখন বিপুল ভাবে বেড়ে গিয়েছে ও বাড়বে, তখন কর্মীর অভাব হবে এই আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। আর, কোথাও যদি সাময়িক ভাবে কর্মীর অভাব দেখা যায়ও, বর্তমান আইনের মধ্যেই (ওভারটাইম ইত্যাদি বন্দোবস্তের মাধ্যমে) তার মোকাবিলার পথ খোলা রয়েছে। শ্রমিক সংগঠনগুলি লিখেছে, সরকার আসলে খিড়কির দরজা দিয়ে শ্রমদিবস বাড়িয়ে নেওয়ার কৌশল করছে, তাদের প্রকৃত লক্ষ্য হল শিল্পবাণিজ্যের মালিকদের মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করা। চিঠিতে খেয়াল করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আট ঘণ্টার শ্রমদিবসের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সরকার আগে থেকেই চেষ্টা চালাচ্ছে। স্বভাবতই মনে করার কারণ আছে যে কোভিড-১৯ সেই উদ্দেশ্য সাধনের নতুন প্রকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
লক্ষণীয়, শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিবাদের বিষয়বস্তু এবং ভাষা দুইই রীতিমতো সংযত ও নিয়ন্ত্রিত। অনুমান করা যায়, এই অস্বাভাবিক সঙ্কটের মধ্যে তারা সেটাই সঙ্গত বলে মনে করেছে। সেটা অযৌক্তিক নয়। তবে এমন একটা আশঙ্কারও বিলক্ষণ হেতু আছে যে রাষ্ট্রের চালকরা এই সঙ্কটের সুযোগটাই নিতে চাইছেন, এই সময়ে জোরদার প্রতিবাদ হবে না জেনেই এই পরিবর্তন ঘটাতে তৎপর হয়েছেন। একটা কথা বিশেষ ভাবে বলা এবং মনে রাখা দরকার। ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র দোহাই দিয়ে শ্রমদিবসের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগ গোটা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসকে কলমের এক আঁচড়ে নস্যাৎ করে দেওয়ার শামিল। শ্রমদিবসকে আট ঘণ্টার সীমায় বেঁধে রাখার দাবিতে শ্রমিকদের যে দীর্ঘ এবং কঠিন লড়াই লড়তে হয়েছে, আজকের মে দিবস তারই স্মারক।
এটাও ভুললে চলবে না যে, এই দাবি নিছক ‘মানবিকতা’র দাবি নয়, এটা শ্রমিক-শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম মৌলিক দাবি। শ্রমিক সংগঠনগুলি তাঁদের প্রতিবাদপত্রে এই ব্যাপারটাকে কিছুটা পরোক্ষ ভাবে এনেছেন: অভিযোগ করেছেন যে, কাজের সময়কে বারো ঘণ্টা অবধি সম্প্রসারিত করে সরকার পুঁজিমালিকদের মুনাফা বাড়ানোর সুবিধে করে দিতে চায়। যথাযথ অভিযোগ, তবে অভিযোগটা এখানে শেষ হওয়ার কথা নয়, শুরু হওয়ার কথা। কারণ এ কেবল সুবিধে করে দেওয়া নয়, এটাই শোষণ বাড়ানোর একেবারে আদিমন্ত্র। ধনতন্ত্রের মার্ক্সীয় তত্ত্বে শোষণের অর্থ উদ্বৃত্ত শ্রম আত্মসাৎ করা। উদ্বৃত্ত শ্রমের সঙ্গে শ্রমদিবসের দৈর্ঘ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত— আরও বেশি উদ্বৃত্ত শ্রম আত্মসাৎ করে শোষণের মাত্রা বাড়ানোর অন্যতম মৌলিক উপায় হল শ্রমদিবসকে দীর্ঘতর করা। সেই কারণেই আট ঘণ্টার শ্রমদিবসের ধারণাটি এতটা মূল্যবান, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব এত বেশি। এবং সেই কারণেই বিপর্যয়ের অবকাশে তার মূলে আঘাত করার এই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগটি আক্ষরিক অর্থেই ভয়ানক। এটাও ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম-এর একটি রূপ। আমাদের মতো দেশে এই রূপটি বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক। তার কারণ, এমনিতেই অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মীর কর্মক্ষেত্রে যথাযথ শ্রমদিবস বলে কিছু নেই, ঠিক যেমন ন্যূনতম মজুরি ব্যাপারটাও তাঁদের কাছে বিলাসিতামাত্র। সংগঠিত ক্ষেত্রের সীমিত পরিসরে আইনকানুনের কিছুটা ভূমিকা আছে। এখন, শ্রম আইনের ‘উন্নয়নমুখী’ সংস্কারের নামে সেই ভূমিকাকেও খর্ব করার রকমারি তৎপরতা চলছে। সাম্প্রতিকতম আক্রমণটি তারই অনুসারী।
এই আক্রমণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা শ্রমিক সংগঠনের একটা বড় কাজ। সেই কাজে সমস্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সহযোগিতাও জরুরি। গভীর সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়েও যে শ্রমজীবী মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পারেন, গত কয়েক সপ্তাহে তার দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে নানা দেশে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে দেশের বিভিন্ন শহরে অতিকায় বিপণন সংস্থার কর্মীরা তাঁদের স্বাস্থ্য ও আয়ের নিরাপত্তার দাবিতে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ধর্মঘট করেছেন। এবং সেই আন্দোলন সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়নি, কোম্পানির কর্তারা নিজেদের মুনাফার তাগিদ কিছুটা সংযত করে শ্রমিকদের কিছু সুবিধা ও ছাড় দিতে বাধ্য হয়েছেন। বেশি নয়, অতি সামান্য ছাড়ই আদায় করা গিয়েছে তাঁদের কাছ থেকে। কিন্তু সেটুকুই প্রমাণ করে যে, শ্রমিকের দাবিগুলি আদায়ের সম্ভাবনা কঠিনতম সময়েও পুরোপুরি হারিয়ে যায় না।
এই সব দাবি কোনও বিশেষ সুযোগ বা করুণার দাবি নয়, অধিকারের দাবি। শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার। নিয়োলিবারাল ধনতন্ত্রের কারবারিরা যে অধিকারের সীমানাগুলিকে ঠেলতে ঠেলতে ক্রমাগত শ্রমিকের জীবন-জীবিকাকে দুর্বিষহ করে তুলেছেন। এই বিপর্যয়ের পরিস্থিতিকেও তাঁরা সেই উদ্দেশ্যে কাজ লাগাতে চাইছেন। সংগঠিত প্রতিরোধ ছাড়া এই আক্রমণের মোকাবিলার কোনও উপায় নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.