বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
অর্থশাস্ত্রে বাজেট বলতে বোঝায় প্রস্তাবিত ব্যয় ও প্রত্যাশিত আয় সম্পর্কিত একটা বিবরণ বা দলিল। আয়-ব্যয় সম্পর্কিত এই দলিলের মাধ্যমে সরকার দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে থাকে। এইরকম দলিলের গুরুত্বের কথা প্রথম তুলে ধরেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কেইনস। ১৯৩০ সালে মহামন্দার হাত থেকে আমেরিকা তথা পুঁজিবাদী অর্থনীতির পুনুরুজ্জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে কেইনস বলেন যে, উৎপাদনে প্রণোদনা দিলেই অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরবে না, প্রয়োজন হচ্ছে আমজনতার চাহিদা বাড়ানো এবং এর জন্য সরকারকে ঘাটতি ব্যয় করতে হবে। কেইনসীয় এই বক্তব্যের সূত্র ধরে অর্থশাস্ত্রে সরকারের আয়-ব্যয় নীতির গুরুত্ব বাড়ে। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হিসাবে ‘আর্থিক নীতির’ পাশাপাশি সরকারের ‘রাজস্ব নীতি’ও সমান গুরুত্ব পায়। বর্তমানে নয়া উদারনৈতিক জমানায় ‘আর্থিক শৃঙ্খলার’ নামে সরকারের ঘাটতি ব্যয়কে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, সরকার কোন খাতে ঘাটতি ব্যয় করবে? কেইনসের দৃষ্টিভঙ্গিতে সরকার, নদী উপত্যকা পরিকল্পনা, রাস্তা নির্মাণ, প্রয়োজন হলে মিশরের পিরামিড এর মতো কাজ অর্থাৎ ‘পাবলিক ওয়াকার্স’ এর মধ্যে দিয়ে দরিদ্র মানুষের হাতে অর্থ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করবে এবং সেই অর্থই অর্থনীতিতে গতিময়তা আনবে। ভারতে ২০০৬ সালে প্রণীত ‘গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা যোজনা’ এই ধরণের একটা কাজ। এই আইনের বৈশিষ্ট্য হল ‘যে সকল গ্রামীণ পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যরা অদক্ষ কায়িক শ্রম করতে ইচ্ছুক, সেই রকম প্রত্যেক পরিবারকে প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী বছরে ১০০ দিনের কাজ দেওয়া।’ শুরু থেকেই গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প ভারতে সামাজিক সুরক্ষা এবং গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য একটা শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের তথ্য থেকে দেখা যায় বছরের যে কোনও দিন প্রায় ১৪ লক্ষ সাইটে (জায়গায়) প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এই কর্মসূচির আওতায় কাজ করে। ২০১১ সালের জনগণনায় ভারতে গ্রামের সংখ্যা প্রায় ৬.৫ লক্ষ। এর অর্থ হল প্রতিটি গ্রামে প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি করে সাইট আছে যেখানে গড়ে জবকার্ড আছে এমন ১৩ জন লোক কাজ করে। গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের এই বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ উত্তরোত্তর হ্রাস পেয়েছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যায়ে ২০২১-২২ সালে এই খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৮,৪৬৮ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ সালে বরাদ্দ হ্রাস পেয়ে হয় ৮৬০০০ কোটি টাকা। চার বছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ ১৪.৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এনআরইজিএস সংঘর্ষ মোর্চার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অর্জুন উন্নিকৃষ্ণন বলেছেন, এইভাবে অর্থ সংকোচনের ফলে বর্তমানে অধিকাংশ রাজ্যে পুরোপুরি ১০০ দিনের কাজ হয় না। একজন জবকার্ড হোল্ডার খুব বেশি ৪০-৪৫ দিনের কাজ পায়। তিনি আরও বলেছেন ২০২৪-২৫ এর বাজেটে এই খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ নিঃশেষ। তবে এখনও ৭০০০ কোটি টাকা মজুরি বাবদ অর্থ জবকার্ড হোল্ডারদের দেওয়া হয়নি। তিনি বলেছেন এই প্রকল্প আজ ‘অন্তর্ঘাতের শিকার।’ এই মুহূর্তে দেশের সামনে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। অথচ বাস্তবে বিপরীতটাকেই ত্বরান্বিত করা হচ্ছে।
আরও একটা বিষয়কে বর্তমান বাজেটে পরিহার করা হয়েছে। এটা হচ্ছে জনগণনাকে বিলম্বিত করে প্রায় ১৪ কোটি মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার অর্থাৎ খাদ্য সুরক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। ২০১৩ সালে প্রণীত খাদ্য সুরক্ষা আইনে শহরবাসীর ৫০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৭৫ শতাংশ মানুষকে প্রতি মাসে মাথা পিছু ৫ কেজি দানাশস্য গণ বন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ২০১১ এর জনগণনা অনুযায়ী শহর ও গ্রাম মিলিয়ে এই আইনের আওতায় আসে প্রায় ৮১.৩৫ কোটি মানুষ। এখন জনগণনাকে বিলম্বিত করার অর্থ হল, বিগত বছরে এই জনসমষ্টির যে বৃদ্ধি ঘটেছে তার দায় কৌশলে এড়ানো। ২০০১-১১ এর দশকে ভারতে জনবৃদ্ধির হার ছিল ১৭.৭ শতাংশ। এই হিসাবে পিডিএস এর আওতায় বর্ধিত জনসমষ্টির পরিমাণ হল ১৪ কোটি। জনগণনাকে বিলম্বিত করার অর্থ হল ১৪ কোটি মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনের বাইরে রাখা অর্থাৎ তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ২০২৪ সালে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ১২৭টি দেশের মধ্যে ছিল ১০৫তম। এই তালিকায় ভারত ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন, এমনকী পাকিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলোরও পিছনে স্থান পেয়েছে। সংক্ষেপে বললে, কর্মসংস্থানের বৃদ্ধির দিকে পদক্ষেপের প্রকাশ বাজেটে নেই। আছে শুধু ধূর্ততা।