বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
২০১৪ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতা দখল করেই নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’কে লক্ষ্য করে দেশের সেবক হিসেবে কাজ করে যাবেন। বিগত দশ বছরের শাসনকালে তাঁর ঘোষণা কতটা কার্যকরী হয়েছে তার মূল্যায়ন দেশের মানুষ আসন্ন নির্বাচনে করবেন। মোদি কিন্তু ঘোষণা করে চলেছেন যে তিনি চারশোর বেশি আসনে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতা দখল করবেন।
তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসে দেশকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে তিনি শুধু তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন তাই নয়, দেশকে মজবুত করতে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে যেমন পরিবর্তন দরকার সেইমত ব্যবস্থা নিতে তিনি কালবিলম্ব করবেন না।
মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মানুষের অধিকার হরণ করেছেন। এখন যে হুমকি তিনি আগাম দিয়ে রাখছেন তার পরিণাম ভেবে মানুষ স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন।
(২)
মোদি জমানায় নাগরিক অধিকার হরণের তালিকা বেশ লম্বা। লম্বা তালিকার ‘ক্রনোলজি’তে না গিয়েও কয়েকটি প্রতিনিধিস্থানীয় ঘটনার উল্লেখেই অধিকার হরণের চিত্রটি মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
এক) কৃষক ও গণতান্ত্রিক মানুষের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলেই ইউপিএ সরকারের শেষলগ্নে ১৮৯৪ সালের ভূমিঅধিগ্রহণ আইন বাতিল হয় এবং ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়। এই আইনে জমি অধিগ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট কৃষকের মতামতসহ অধিগ্রহণের সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সমীক্ষার বিধানসহ আরো কিছু শর্ত আরোপিত হয়। এই আইন প্রণয়নে বিজেপির সাংসদেরাও যুক্ত ছিলেন।
মোদি ক্ষমতায় এসেই উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কৃষকের মতামত ও সামাজিক সমীক্ষার ধারা বাতিল করে এক অধ্যাদেশ জারি করেন। কৃষক ও মানুষের প্রতিরোধে কর্পোরেটের হাতে জল, জমি ও জঙ্গল তুলে দেওয়া আটকে যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার অধ্যাদেশে জারি কৃষকের অধিকার হরণ করার চেষ্টা করলেও মোদি সরকার সফল হতে পারেননি। মোদি জমানার শুরু হয়েছিল অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে। দুই) মান্ডি ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে কৃষকের ফসল ফড়ে ও কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করতে, কৃষকদের চুক্তিচাষে শৃঙ্খলিত করতে এবং শস্য মজুতের সীমা তুলে দেওয়ার নিদান দিয়ে তিনটি কালাকানুন জারি করেন মোদি সরকার। কৃষকেরা পাঁচশোরও বেশি সংগঠন নিয়ে গড়ে তোলেন সংযুক্ত কিসান মোর্চা। দীর্ঘ আন্দোলনে কৃষকেরা জয়ী হলেন। মোদি সরকার তিনটি কালা কানুন বাতিল করতে বাধ্য হলেন।
(৩)
তিনটি কৃষি আইন বাতিল হলেও কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হল না। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল যে এই দাবিটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। দীর্ঘ তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে কোনও মীমাংসা হয়নি। এই অধিকারকে বানচাল করতে সি২ + ৫০% সূত্রের বিরোধী ‘পন্ডিতদের’ নিয়ে কমিটি গঠন করে টালবাহানা অব্যাহত রেখেছেন। যদিও কৃষকের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অধিকারের প্রবক্তা ও দেশের খাদ্য স্বয়ম্ভরতার জনক ড. এম. এস. স্বামীনাথনকে মোদি সরকার ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করেছেন। কৃষকেরা আবারও আন্দোলনের রাস্তায় নেমেছেন। কৃষকদের দিল্লী অভিযান রুখতে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে — ড্রোন থেকে তাদের উপর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মোদি ঘোষণা করে চলেছেন যে তিনি কৃষকদের আয় বৃদ্ধির জন্য অনেক ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং বার্ষিক ছয় হাজার টাকার কৃষক সম্মান প্রকল্প চালু করেছেন। মোদিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে সূত্র মেনে সহায়ক মূল্য চালু হলে কৃষকেরা কৃষক সম্মানের চেয়েও বেশি টাকা রোজগার করতে পারবেন। মূল বিষয় হল অধিকারের আইনি স্বীকৃতি, যেটি মোদি কিছুতেই মান্যতা দিতে চান না।
(৪)
দেশের অন্নদাতারা যেমন অধিকার রক্ষার লড়াই করছেন তেমনি শ্রমিকেরাও তাদের অর্জিত অধিকার রক্ষার লড়াই জারি রেখেছেন। কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থে ২৯টি শ্রম আইনকে কার্যত বাতিল করে চারটি শ্রম কোড করা হয়েছে। শ্রম শোষণ আরও অবাধ ও তীব্র হয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলনকে নানান কৌশলে খর্ব করা হচ্ছে। বহু সংগ্রামে অর্জিত আট ঘণ্টা কাজের সময়সীমা প্রায় অবলুপ্তির পথে। সম কাজে সম বেতনের অধিকার, অসংগঠিত এবং গিগ শ্রমিকদের মজুরি ও চাকুরির নিরাপত্তা এবং সামাজিক সুরক্ষার অধিকার শাসকের মর্জিমফিক চলে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি ও মিড ডে মিলের লক্ষ লক্ষ প্রকল্প কর্মীদের সাম্মানিকের নামে জোটে সামান্য মজুরি। সম্প্রতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করে অন্ধ্র, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা কিছু দাবি ছিনিয়ে এনেছেন। মোদি সরকার সকলের বিকাশের কথা বলেন কিন্তু এদের জীবিকার নিরাপত্তা, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি ও অধিকারের কথা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেন না।
(৫)
পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে মোদি সরকার মানুষের অধিকার হরণ করে চলেছেন এবং দেশের ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন।
পার্লামেন্টে বিরোধীদলের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া সংসদীয় প্রথার আবশ্যকীয় অঙ্গ। মোদি সরকার সেই প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিরোধী কন্ঠ রোধ করে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে বিলগুলি প্রেরণের দাবিকে উপেক্ষা করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধ্বংসী বিল পাশ করিয়ে নিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে আগের ফৌজদারি তিনটি আইন বদল করে নতুন তিনটি আইন— ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা, ভারতীয় সাক্ষ্য আইনগুলি পাশ করার আগে পার্লামেন্টে আলোচনার কোনও সুযোগ দেওয়া হল না। এই সময়ে লোকসভার ১৪৩ জন সদস্যকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নজিরবিহীন ভাবে সাসপেন্ড করা হল।
নতুন ফৌজদারি তিনটি আইনের অনেক ধারাই দানবীয়। যেমন, (১) পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৯০ দিন পয্যন্ত করা হয়েছে। এতদিন আটক রাখা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। (২) ১৯৮০ সালের একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল আদালতের অনুমোদন ছাড়া পুলিশের অভিযুক্তকে হাতকড়া লাগানো অমানবিক। নতুন আইন এবিষয়ে নীরব। (৩) Solitary Confinement বা নির্জন কারাবাস সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছেন, নতুন আইনে তাকে সমর্থন করা হয়েছে। (৪) সন্ত্রাসের মোকাবিলায় টাডা, পোটা আইন বাতিল হলেও নতুন ধারা যোগ করে পূর্বের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আসলে মোদি জমানায় অধিকার শুধু হরণ হবে, নতুন কিছু অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
(৬)
গণতান্ত্রিক অধিকার এই জমানায় যেভাবে পদদলিত হয়েছে তার কোনও নজির নেই। জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল আইনি পথে এবং তার অবসানও ঘটেছিল আইনি পথে। কিন্তু বর্তমানে চলছে অঘোষিত জরুরি অবস্থা। তদন্তকারী সংস্থা ইডি, সিবিআই, এনআইএ প্রভৃতি শাসক দলের অঙ্গুলি হেলনে বিরোধী দলগুলিকে হেনস্তা করে চলেছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতৃত্বকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হচ্ছে, যদিও একটিও দুর্নীতি প্রমাণিত হয় নি। প্রধানমন্ত্রী বলছেন এটা ট্রেলার মাত্র, ছবি শুরু হবে নির্বাচনের পরে। এটি হাড়হিম ভয়ের বার্তা। যদি প্রধানমন্ত্রীর নিশানা দুর্নীতির মূলচ্ছেদ করাই হয় তবে নির্বাচনি বন্ডে তাঁর দলীয় তহবিলে কোটি কোটি টাকা নেওয়ার যে যুক্তি তিনি দেশকে জানালেন তা যে প্রতারণামুলক তার বিষদ ব্যাখ্যা বাহুল্যমাত্র। প্রধানমন্ত্রী একটি কথা অনুচ্চারিত রাখলেন, যে সব কোম্পানি বন্ডে টাকা দিয়েছে তাদের কোম্পানিগুলিতে আয়কর, ইডি, বা সিবিআই প্রথমে হানা দিয়েছে এবং তারপর টাকা এসেছে। তদন্ত চাপা পড়েছে।
শুধু তদন্তকারি সংস্থাগুলি নয়, মানবাধিকার কমিশন, ভিজিলেন্স কমিশন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নির্বাচন কমিশন সব জায়গায় দলীয় অনুগতদের মাথায় রেখেই আধিপত্য বিস্তার করাই বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা। এমনকি বিচার ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করা হচ্ছে। ২৬ জন প্রাক্তন বিচারক দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপাতির কাছে এই মর্মে একটি চিঠি লিখেছেন। স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যে কোনও ভিন্ন মতামতকে জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও আর্বান নকশাল বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এমনই কঠোর হয়েছে যে মানুষ মিডিয়াকে ‘গোদি মিডিয়া’ মনে করেন। নিউজ ক্লিকের প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার, ঐ নিউজ পোর্টালের ৪৬ জন সাংবাদিকের বাড়ি তল্লাসি এবং ইউএপিএ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ মতপ্রকাশের অধিকারকে একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এরপর ব্রডকাস্টিং সারভিসেস (রেগুলেশন) বিল, ২০২৩এ যেসব দানবীয় ধারার প্রস্তাব আছে তা লাগু হলে সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার মূল্যহীন হয়ে যাবে। এটা ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি।
(৭)
সংবিধানে নাগরিকদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। কিন্তু কেন্দ্র রাজ্য মনে করে তাঁরা বদান্যতা বিতরণ করছেন। ঘটনা হল যে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব খাতেই বাজেট বরাদ্দ কমে চলেছে এবং সরকার ক্রমশ বেসরকারিকরণের পথে এগিয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষকে এইসব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন। আর এসবই ঘটছে ক্রোনি পুঁজিকে খুশি রাখতে।
এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি:
এক) ২০২০-২১ সালে খাদ্যে ভরতুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৫,৪১,৩৩০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ সালে হয়েছে ২,০৫,২৫০ কোটি টাকা। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ২০১৩ সালে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ৬৩ নম্বরে আর ২০২৩ সালে অবনমন ঘটে স্থান হয়েছে ১১১ নম্বরে। অপুষ্টি বিষয়ে রাষ্ট্রসংঘের প্রতিবেদন হল দেশের ৭৪ শতাংশ মানুষ ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার পান না।
দুই) মোদির প্রতিশ্রুতি ছিল স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হবে। কিন্তু এই বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম। আয়ুষ্মান ভারত বা স্বাস্থ্য সাথী স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পগুলি আসলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার ছক এবং বিমা কোম্পানিগুলির মুনাফার ব্যবস্থা করার কৌশল। হিসাব কষে দেখা গিয়েছে যে এইসব প্রকল্পে চিকিৎসা করতে রোগীর পকেট থেকে খরচ হয় প্রায় ৫৭ শতাংশ। ফসল বিমাও একই ছকে বাঁধা।
(তিন) শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্পষ্টতই বেসরকারিকরণ ও ধনীদের একচেটিয়া অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলেছে। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে হয় তুলে দেওয়া হচ্ছে বা সরকারি সহায়তা ক্রমশ সংকুচিত করা হচ্ছে। দরিদ্র ছাত্র ছাত্রীরা বিদ্যালয় স্তরেই পড়াশুনো ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যারা কষ্ট করে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে যেতে পারছেন তারাও সেখানে সরকারি বৃত্তির অভাবে গবেষণামূলক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকেই জাতপাত ও ধর্মীয় বৈষম্যেরও শিকার হয়ে শিক্ষাঙ্গন ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। নতুন শিক্ষানীতি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সরকারি নীতি।
(৮)
কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েই বদান্য একনায়কের ভূমিকায়। গ্যারান্টির প্রতিযোগিতায় দুই সরকারই পরস্পরকে টেক্কা দিতে আস্ফালন করতে ব্যস্ত। তাঁরা এমনভাব দেখাচ্ছেন যেন কন্যাশ্রী প্রভৃতি শ্রী প্রকল্পের অর্থ নিজেদের পকেট থেকে দিচ্ছেন। দাদা দিদিদের কথার অন্যথা হলে নাম কাটা যাওয়ার হুমকি দেখে এই কথা মনে আসা অস্বাভাবিক নয়। মানুষ এইসব প্রকল্প থেকে কিছু সুরাহা অবশ্যই পাচ্ছেন, কিন্তু রোজগার ও কাজের কোনও গ্যারান্টি দাদা-দিদি মুখে আনেন না। এমনকি সরকারি স্তরে যে ১০ লক্ষ পদ খালি আছে সেগুলি পূরণের কোনও হুঙ্কার শোনা যায় না। অর্থনীতিবিদরা যে ন্যূনতম নিশ্চিত মাসিক আয় প্রকল্পের পরামর্শ দিচ্ছেন তাও এঁদের কানে প্রবেশ করে না। কোনও অধিকারের কথায় এঁদের গায়ে জর আসে।
আসলে এঁরা দানখয়রাত করে আত্মপ্রসাদ পেতে অভ্যস্ত।
সরকারি ব্যয়ের প্রভাব নিয়ে ভাবিত নয়। উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রসঙঘ স্বীকৃত কন্যাশ্রীর সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে অল্প কথা বলা যেতে পারে। আমাদের রাজ্যের গর্বের প্রকল্পের অনেক ছাত্রী যুক্ত। তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে বাল্যবিবাহ নিম্নগামী হয়নি এবং ক্রাইম বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যে নারী নিগ্রহের ঘটনা বেশ ভাবনার। আসলে বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আর্থ-সামাজিক পটভূমি। তার সমাধান শুধু প্রচারে হবে না। দরকার সঠিক দিশা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
এই সদিচ্ছা ও দিশা ছিল বলেই বাম সমর্থিত প্রথম ইউপিএ সরকারের সময়কালে ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি, অরণ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্যের অধিকার, খাদ্যের অধিকার প্রভৃতি আইনি অধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। এই অধিকারগুলি দয়ার দান নয়। বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত। দাদা-দিদি হুমকি দিয়ে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। মোদির বছরে দু’ কোটি চাকরি, ১৫ লাখ টাকা সকলের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার গল্প বা নোট বাতিল করে কালো টাকা উদ্ধারের মিথ্যা কাহিনী নয়— নাগরিকেরা চান জীবিকা অর্জনের নিশ্চয়তা, চান সকলে মিলেমিশে থাকতে। মোদির গ্যারান্টিতে সেই বার্তা নেই।
(৯)
এই নির্বাচন অর্জিত অধিকার রক্ষা এবং ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধানকে বাঁচানোর নির্বাচন। মোদি যে ঔদ্ধত্যের সঙ্গে সারা দেশজুড়ে ৪০০এর বেশি আসনে জয়ী হয়ে এক দেশ এক আইন, এক নির্বাচন ইত্যবিধ ঘোষণা কার্যকরী করার ঘোষণা করে চলেছেন তাতে দেশে গণতন্ত্র ও সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। গত দশ বছরে নাগরিকের অধিকার হরণ, বিভাজনের রাজনীতি, সংবাদপত্রের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগের উপর সরকারের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, সংখ্যালঘুদের উপর বৈষম্য ও নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে সেই বৈষম্যকে প্রকট করে তোলা, সংখ্যাগুরুবাদ প্রতিষ্ঠা, নির্বাচনের আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার ও বিরোধী দলের নেতৃত্বের উপর ইডি, সিবিআই আয়কর হানা প্রভৃতি ঘটনাপ্রবাহ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে মোটেই সুখকর সংবাদ নয়। এই নির্বাচনে ভোটদাতাদের বিচক্ষণ বিচারের উপর ভারতের গণতন্ত্র, সংবিধান ও সাস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।