বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[দেশ]

[দেশ]

দুর্ঘটনায় ৪৮০০০ শ্রমিকের মৃত্যু না 'হত্যা'

দুর্ঘটনায় ৪৮০০০ শ্রমিকের মৃত্যু না 'হত্যা'

শৌভিক দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— সম্প্রতি কর্ণাটকে কাজ করতে গিয়ে কয়েকজন বাঙালি শ্রমিকের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর খবর জায়গা পেয়েছিল সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায়।
২০১৯ সালে আইআইটি দিল্লীর রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর ভারতের প্রায় আটচল্লিশ হাজার শ্রমিক কাজ করতে করতে প্রাণ হারান দুর্ঘটনায়। এঁদের মধ্যে সত্তর শতাংশই নির্মাণ শ্রমিক। কিন্তু এই মৃত্যুগুলিকে কি নিছক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো বলা যায়? রাষ্ট্র কি অস্বীকার করতে পারে এই সব শ্রমিকদের মৃত্যুর দায়? সাধারণ বুদ্ধিতে বলে নিরাপত্তার বিষয়ে মালিক ও কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যের কারণেই প্রতিদিন প্রাণ হারান হতভাগ্য শ্রমিকরা।
তাই এঁদের মৃত্যুকে হত্যা বলাটাই শ্রেয়। যদিও সেই হত্যার জন্য সাজা হয় না কারো। মালিক-কর্তৃপক্ষের প্রতি রাষ্ট্রের নমনীয় মনোভাবের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাজা পায় না অপরাধীরা।
কিন্তু ঠিক কী কারণে প্রতিদিন কাজ করতে করতেই চুপচাপ টপাটপ করে মরে যান আমাদের দেশের এই মেহনতি মানুষগুলো? কেন দুর্ঘটনার এতো ঝুঁকি থাকতেও কোনওরকম সাবধানতা অবলম্বনের বালাই নেই?
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এবং কর্ম সংস্থানের দিক দিয়ে ভারতের ইমারত ব্যবসা বা কনস্ট্রাকশন ইণ্ডাস্ট্রি এই মুহূর্তে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প। কৃষিক্ষেত্রের ঠিক পরেই সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়িয়ে আছেন এই কর্মক্ষেত্রে।
২০১৮ সালের সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে তার আগের চার বছরে নির্মাণ শিল্পের আশি শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০১৩ সালে এই শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০১৭ সালে পৌঁছোয় ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
অথচ প্রদীপের নীচেই যেমন সবচেয়ে বেশি অন্ধকার থাকে, তেমনই নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রেও সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে নীচু তলার কর্মীরা বা নির্মাণ শ্রমিকরা প্রাণ হারান।
এঁরা সবাই অসংগঠিত শ্রমিক। নিজেদের সুরক্ষার জন্য দাবি তোলার মতো জোরালো সংগঠন বা ইউনিয়নের জোর তাঁদের নেই। নেই সুরক্ষা যন্ত্রপাতি, নেই ইনসিওরেন্স। প্রায় সকলেই অস্থায়ী শ্রমিক। কোভিড লকডাউনে যাদের আমরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে জেনেছি। শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেবার মতো সচেতনতা নেই এঁদের।
সুতরাং এঁদের মরণ বাঁচন নিয়ে কোনও কনস্ট্রাকশন কোম্পানির তো বটেই সরকারেরও কোনও মাথা ব্যথা নেই। রক্তকরবীর সেই যক্ষপুরীর খনি শ্রমিকদের মতোই এঁরা শুধুই সংখ্যা।
প্রতিদিন প্রাণ হাতে নিয়ে কাজ করতে করতে যাঁরা মারা পড়েন, তাঁদের মধ্যে ষাট শতাংশ মারা যান উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে, পঁচিশ শতাংশ মারা যান ছাদ বা দেওয়াল চাপা পড়ে, পনেরো শতাংশ মারা যান বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে।
কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলো, সরকার, প্রশাসন কারোর কাছেই অজানা নয় এই তথ্যগুলো। তবুও এই সমস্ত মেহনতি মানুষগুলোর ন্যূনতম শ্রমসুরক্ষার জন্য আওয়াজ তুলতে দেখা যায় না কাউকেই।
মালিকপক্ষ চড়া হারে মুনাফার জন্য সুরক্ষার জন্য ব্যয় করতে চাইবে না সেটা ধরে নেওয়াই যেতে পারে। অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে তখনই এই শ্রমিকদের জীবনের মূল্য নিয়ে মালিক শ্রেণী চিন্তিত হতো, যখন চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের জোগানে টান পড়তো। কিন্তু ৪৭ বছরের রেকর্ড বেকারির সময়ে সে কথা ভাবাই বাতুলতা। হেলমেট, সুরক্ষা জাল, জ্যাকেট, গ্লাভস, মাস্কের মতো ন্যূনতম সুরক্ষা যন্ত্রপাতিগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতি দিন কাজ করে চলেছেন শ্রমিকরা।
ঠিক যেমন এ দেশের অসংখ্য নামে বেনামে চলতে থাকা বৈধ-অবৈধ পাথর খাদান, কয়লা খাদান, বালি খাদান, ইঁটভাটা, মূর্তি কারখানাগুলোয় পেটের তাগিদে কাজ করতে করতে প্রশ্বাসের সঙ্গে সিলিকনের গুঁড়ো ফুসফুসে নিয়ে প্রতি বছর সিলিকোসিসের মতো মারণ রোগে আক্রান্ত হন লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। অথচ মুনাফালোভী খাদান মালিক, কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের জন্য ন্যূনতম মাস্কটুকুর ব্যবস্থাও করে না। সরকার, প্রশাসন সবটা জেনেশুনেও অন্ধ সেজে থাকার ভান করে। রাষ্ট্র নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।
দু’ একরের বড় কনস্ট্রাকশন ক্ষেত্রে এবং তিরিশ চল্লিশ মিটার উঁচু বিল্ডিং তৈরি হলে নির্মাণ শ্রমিকদের সুরক্ষাজনিত যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা। শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষাবিধি না মানলে কর্তৃপক্ষের যে হাজতবাস ও জরিমানার নিয়ম রয়েছে কাগজে কলমে, তাকেও কার্যত বুড়ো আঙুল দেখায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা।
২৫ কোটির বড় অঙ্কের প্রোজেক্টগুলোর ক্ষেত্রেই শ্রমিক সুরক্ষা বিধি মানা হচ্ছে কি না তা দেখতে নজরদারি চালানোর নিয়ম রয়েছে কনস্ট্রাকশন বোর্ডের। তবে সেই নিয়মও যে আদতে খাতায় কলমে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু শ্রমিকদের এই মৃত্যূ মিছিল কি এভাবে চলতেই থাকবে? মালিক পক্ষের চরম অবহেলায়, রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে দিনের পর দিন কি কার্যত খুন হতে থাকবেন মেহনতি মানুষ?
নাকি প্রতিরোধ গড়ে তোলার সময় এসেছে? সময় এসেছে অচলায়তনে ধাক্কা দেবার?
যে ঐতিহাসিক মে দিবস শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলে, তার প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হতে থাকে এই কোটি কোটি মেহনতি মানুষের দাবি বুঝে নিতে, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে সংগঠিত করতে চাই অংসগঠিত ক্ষেত্রের সর্বভারতীয় শ্রমিক সংগঠন।
তবে, "লেনিন যেন চেঁচিয়ে বললেন, শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে। একটু পা চালিয়ে ভাই, একটু পা চালিয়ে"।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.