বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
যা অকল্পনীয়, তা কল্পনা না করে মানুষ থাকতে পারে না। কেমন হতো যদি আলোর চেয়েও জোরে ছুটত কোনও পদার্থ? যদি আবিষ্কার হতো এমন এক প্রাচীন সভ্যতা, যা বদলে দিত ইতিহাস? যদি প্লেনে চড়ার মতোই চড়া যেত টাইম মেশিনে? কত জটিল, কঠিন এই সব কল্পনা। কিন্তু এ সবের চেয়েও জটিল, কঠিন হয়ে ওঠে নেহাত মামুলি এক বিষয়ের কল্পনা। কেমন হতো যদি ভারতে সব মজুরের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দেওয়া যেত এক দিনে?
যিনি মনে করেন, ক্যান্সার জয় করা সম্ভব, বা শনিগ্রহে মানুষ অবতরণ আর কয়েকটা বছরের ব্যাপার, তিনিও বলবেন, এ অসম্ভব। এক তো বকেয়া মজুরি ঠিক করাই এক জটিলতম কাজ — তা কি স্থির হবে ‘লিভিং ওয়েজ’ বা সুস্থ-স্বচ্ছন্দ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি ধরে, নাকি সরকার-নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি ধরে, নাকি মালিক-ঠিকাদারের নির্ধারিত মজুরি ধরে? তারপরেও প্রশ্ন, কার কথা শুনে বকেয়া স্থির হবে, মালিকের না মজুরের? মজুরি, পিএফ, পেনশন প্রভৃতি না পেয়েই যারা মরে গিয়েছে, তাদের কী হবে? যারা বেঁচে রয়েছে, তাদের বকেয়া এক কথায় মিটিয়ে দিতে পারে যে দেশ, তেমন ভারত কল্পনা করার সাধ্য আছে কার?
আশেপাশে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে, সে শক্তি আছে কেবল দেশের দুর্বলতম কয়েকটি মানুষের। তারা মেয়েমজুর। নরম জমিতে আঁচড় কাটা সহজ, এই নীতি মেনে তাদের মজুরি, পিএফ, সব চাইতে সহজে বকেয়া রাখে মালিক, ঠিকাদার, এমনকি সরকারও। গত এক মাসের দুটো আন্দোলন দেখিয়ে দিল, কতখানি গা-জোয়ারি করতে পারে নিয়োগকারী। একটি ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ‘এক্সোডাস ফিউচুরা’ নামে একটি কাপড় বোনার কলে প্রায় চারশো মেয়ে ধর্মঘট করল পঁচিশ দিনের উপর। দীর্ঘ দিন ধরে তাদের বেতন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কাটা হচ্ছে, কিন্তু মালিকের প্রদেয় অংশ জমা পড়ছে না। একবার ২০২২ সালে, আর একবার ২০২৪ সালে এ নিয়ে আন্দোলন করেন মেয়েরা। লিখিত প্রতিশ্রুতিও মিলেছে, কিন্তু বকেয়া মেলেনি। সম্প্রতি তাঁরা আবিষ্কার করেন যে পিএফ কম দেওয়ার ধান্দায় কর্মীদের বেসিক বেতন (যার উপর পিএফ নির্ধারিত হয়) তা-ও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। একেই এই মহিলা কর্মী-প্রধান কারখানায় দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় — আট ঘণ্টার ডিউটি কেবল নামেই, টার্গেট পূরণ না করে কেউ দিন শেষ করতে পারে না, আর তাতে লেগে যেতে পারে অনেক বেশি সময়। কাজের চাপ এমনই যে শৌচাগারে যাওয়ার সময়ও পান না মেয়েরা। ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার চাইলে কথা শুনতে হয়, মেয়েদের বোনাসের টাকা কেটে জেনারেটর কিনেছে সংস্থা। এ সব অভিযোগ, যা সাধারণের জানাশোনার বাইরে ছিল, তা প্রকাশ্যে এসে পড়ে যখন চারশো মহিলা শ্রমিক কারখানার গেটের সামনে ধর্মঘট শুরু করেন একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে। তাঁদের জেদে শ্রম দফতর দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করতে বলে সংস্থাকে, শেষ অবধি গেট খোলে ১৮ মার্চ। মেয়েদের কাটা বেসিক জুড়ে দেওয়া, এবং বকেয়া পিএফ জমা দেওয়ার দাবি মেনে নিয়েছে সংস্থা। কোনও বড় ট্রেড ইউনিয়ন এই মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়নি, কার্যত নিজেদের শক্তিতেই তাঁদের এই জয় তাঁরা উদযাপন করেন আবির-গুলালে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি কেরলের। সেখানে আশা কর্মীরা এখনও ধর্মঘট চালাচ্ছেন, তাঁদের আন্দোলন চল্লিশ দিন পার করেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁরা ধর্মঘট শুরু করেন তিন মাসের বকেয়া বেতন চেয়ে, এবং নিয়মিত বেতন মেটানোর দাবি করে। সেই সঙ্গে দাবি তুলেছেন, বেতন বাড়িয়ে করা হোক একুশ হাজার টাকা, অবসরের সময়ে এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা ও পেনশন দিক সরকার। আশাকর্মীদের কাজের বিপুলতা ও দায়িত্বভারের সঙ্গে যাঁদের বিন্দুমাত্র পরিচয় আছে, তাঁরা এই দাবির সঙ্গে একমত হতে বাধ্য। ভারতের সবক’টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সরকারি স্কিম কর্মীদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতির দাবিতে সহমত। তা সত্ত্বেও কেরল সরকার এবং এক বাম ট্রেড ইউনিয়ন এক অদ্ভুত দ্বিচারিতার নিদর্শন দেখাচ্ছে। অথচ গত ডিসেম্বরে দিল্লিতে আশা কর্মীদের সর্বভারতীয় জমায়েতে বাম ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা তাঁদের ‘কর্মী’ বলে স্বীকৃতির দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সরকারের শরিক আর এক বাম ট্রেড ইউনিয়ন কিন্তু আশা কর্মীদের সমর্থন জানিয়েছে।
কেরলের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ আশা কর্মী ইউনিয়ন। নেত্রী ইসমত আরা খাতুন বলেন, “আশাকর্মীদের সাম্মানিক এবং উৎসাহভাতা বকেয়া রাখা অতি স্বাভাবিক ব্যপার হয়ে উঠেছে। সরকারি সব কাজে বাধ্যতামূলক যোগদান করতে হচ্ছে আশাকর্মীদের, কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী করে রেখে যথাযথ পারিশ্রমিক না দিয়ে সামান্য ভাতা দেওয়া হচ্ছে।” এ রাজ্যে তাঁদের দাবি, ন্যূনতম পনেরো হাজার টাকা বেতন এবং সব বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া। এই দাবিতে সরকারকে সব ধরনের রিপোর্ট জমা দেওয়া বন্ধ করেছেন ওই ইউনিয়নের সদস্য আশাকর্মীরা।
মেয়েদের বকেয়ার আন্দোলনের দিকে তাকাতে হলে কোন দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে কোথায় তাকাতে হবে, তা ভাবতেই ধাঁধা লাগে। উত্তরবঙ্গের চা বাগানে বকেয়া পিএফ আদায় করতে গেলেই মেয়েদের শুনতে হয়, তারা বাগান তুলে দিতে চায়, শিল্পের ক্ষতি করতে চায়। পুজোর আগে লংভিউ চা বাগান-সহ বেশ কিছু বাগানে মেয়েরা কুড়ি শতাংশ বোনাসের জন্য আন্দোলন করে, শেষ অবধি ষোল শতাংশ আদায় করতে পেরেছে। এটা তাদের কাছে মস্ত জয় বলেই মনে হয়েছিল, যেহেতু তারা প্রায় নিজেদের জোরে লড়াই করেছে।
২৪ মার্চ গরগন্ডা চা বাগানের মেয়েরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলন করলেন — বাগান কর্তৃপক্ষ দু’মাসের উপর বেতন দেয়নি, কাটা পিএফ জমা করেনি বাইশ মাস। উত্তরবঙ্গে শ্রমিক আন্দোলন ঘোরে বকেয়া পিএফ-কে কেন্দ্র করে। কোনও বাগানে পনেরো কোটি টাকা তো কোথাও দেড়শো কোটি টাকা, মোট বকেয়ার হিসাব সন্ধান করা দুঃসাধ্য। অসাধ্য বকেয়া বেতনের হিসাব। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকার কমিটি তৈরি করেছিল ন্যূনতম মজুরি স্থির করার। আজও তার সুপারিশ জমা পড়েনি। পঞ্চদশ শ্রম সম্মেলনের (১৯৯২) সুপারিশ মানলে ন্যূনতম মজুরি দাঁড়াবে দৈনিক ছ’শো টাকারও বেশি। এখন বাগানে মজুরি আড়াইশো টাকা তা থেকে পিএফ কাটা হয় তিরিশ টাকা।
রোজ ৩৫০ টাকা মজুরি বকেয়া থাকছে চা বাগানের মেয়েদের।
কেন্দ্র বাকি রেখেছে এ রাজ্যের মনরেগার টাকা, তিন বছর যাবৎ। টাকার অঙ্ক সাড়ে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি। এর অন্তত দু’হাজার কোটি টাকা রাজ্যের দরিদ্র মেয়েদের। কবে তারা টাকা পাবে? কী করে পূরণ হবে এত দিন টাকা না পাওয়ার ক্ষতি? রাজ্য সরকার হিসাব মেলাতে পারেনি, তা বলে শ্রমজীবী মেয়ের টাকা বকেয়া ফেলে রাখা কোন হিসাবে সরকারি নীতি বলে গণ্য করতে পারে কেন্দ্র? এতে কি ‘বকেয়া সংস্কৃতি’-তেই ছাপ মারা হয় না?
পশ্চিমবঙ্গ গৃহপরিচারিকা সমিতির নেত্রী স্বপ্না ত্রিপাঠী সে দিন বলছিলেন এক বকেয়ার গল্প। মাসে দশ হাজার টাকা বেতনে এক পরিবারে চব্বিশ ঘণ্টা থেকে কাজ করতেন শান্তি। ক্রমে পরিবারের কর্তা, যিনি পেশায় উকিল, এক দিকে বেতন বকেয়া রাখতে শুরু করেন, অন্য দিকে শান্তির কাছে বায়না শুরু করেন, হাত টিপে দাও, পিঠে তেল মাখিয়ে দাও, ইত্যাদি। অসম্মানিত শান্তি কাজ ছাড়েন, তৎক্ষণাৎ উকিলবাবু মিথ্যা নালিশ ঠোকেন থানায়। সে মামলার ফাঁস থেকে শান্তিকে বার করেছে তাঁর ইউনিয়ন, কিন্তু বকেয়া প্রায় তিরিশ হাজার টাকা তিন বছর পরেও মেলেনি।
গরিব মেয়েদের কাছে এই সরকার, এই সমাজ, এই দেশের বকেয়ার শেষ নেই। যখনই তাদের পূর্ণ শ্রম ব্যবহার করে ন্যূনতম মজুরির চাইতে কম টাকা দেওয়া হয়, বোনাস, পিএফ ছাঁটা হয়, তখনই সেই বকেয়া দেখা দেয় উন্নয়নের সূচকে ঘাটতি হয়ে। মেয়েদের সক্ষমতার বাণী না শুনিয়ে, তাদের বকেয়াগুলো মিটিয়ে দিচ্ছে রাজ্য, কেন্দ্র, শিল্পপতি, ঠিকাদার — এমন কল্পনা করার শক্তি কার আছে?