বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
অতিমারির সময় থেকেই ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে গৌতম আদানি একটি অতি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রীর সুহৃদ পৃথিবীর দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তির আসন পান। বিগত ৩ বছরে তার বিভিন্ন কোম্পানিগুলির শেয়ার দরের দাম বেড়েছে কোনওটির ২১২১% কোনওটির ১৩৯৮% ইত্যাদি। কোভিডের সময় যখন কোটি কোটি মানুষ কর্মচ্যুত হয়েছেন, বন্ধুবর আদানির সম্পত্তি প্রায় ১৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এহেন প্রভাবশালী ধনীর মসনদে আঘাত নেমে এসেছে ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩। মার্কিন সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ ৪১৩ পাতার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেই রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে, কীভাবে আদানির কোম্পানিগুলিতে তাদের শেয়ারের মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছে। বাজারে তাদের শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের পরিবর্তে নিজেদের পরিবারের মধ্যে লেনদেনেই এগুলিকে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। উপরন্তু মরিশাসের মতো কয়েকটি দেশে যেখানে বিপুল ট্যাক্সের ছাড় দেওয়া হয় সেইসব tax-haven-এ কোম্পানি খুলে শেয়ার কিনে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আদানির কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামে ধ্বস নামতে শুরু করল। পাঁচ দিনের মধ্যেই আদানি গোষ্ঠীতে লগ্নিকারীদের শেয়ার মূল্য প্রায় ৪০% কমে যায়। অর্থাৎ সম্পদের মূল্যের বিচারে তারা প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ কোটি টাকা হারান। স্বয়ং গৌতম আদানির নিজের সম্পদ কমেছে ১১০০ কোটি ডলার। ধনীদের তালিকায় তিনি নেমে গিয়েছেন ১৫তম স্থানে। শিল্পপতিদের জন্য নির্মিত নির্মলা সীতারামনের বাজেটও শেয়ার বাজারের ধ্বস ঠেকাতে পারেনি। আদানি গোষ্ঠী দেশের ব্যাঙ্কগুলি বিশেষ করে স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ৮০,০০০ কোটি টাকার বেশি ধার নিয়েছে। ভারতীয় জীবন বীমা নিগম আদানির কোম্পানিগুলিতে প্রায় ৩৬,০০০ কোটি টাকার বেশি লগ্নি করেছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই জীবন বীমা নিগমের গ্রাহকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন তাদের সঞ্চিত অর্থ আদৌ জীবনবীমাতে সুরক্ষিত কিনা তা ভেবে। জীবনবীমা নিগমের তরফে চেয়ারম্যান এবং সর্ববৃহৎ কর্মচারী সংস্থা সারা ভারত বীমা কর্মচারী সমিতি (AIIEA) বিবৃতি পেশ করে ও বিজ্ঞপ্তি জারি করে ইতিমধ্যেই গ্রাহকদের সুনিশ্চিত করেছে যে তাদের টাকা সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত।
সারা ভারত বীমা কর্মচারী সমিতির প্রাক্তন সভাপতি আমানুল্লা খান সুস্পষ্টভাবে এই ঘটনার মূল্যায়ন করেছেন। প্রথমত, এটা প্রথমেই খুব জোরের সঙ্গে এবং শ্রেণীঘৃণা নিয়ে বলা দরকার যে গৌতম আদানি ধান্দার ধনতন্ত্রের একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে হিন্ডেনবার্গ সংস্থা কর্তৃক উল্লিখিত প্রশ্নগুলির অতি দ্রুত তদন্ত করা দরকার। ভারত সরকার নিশ্চুপ আর আদানি এই রিপোর্টকে বলছেন এটা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার ষড়যন্ত্র। কোনও ব্যক্তির এই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা একেবারেই গ্রহণীয় নয়। যেন আদানি মানেই ভারত। আরো একটি প্রশ্ন, এই ঘটনায় সেবি (SEBI) চুপ কেন? সেবি কেন তদন্তে উদাসীন? এটা পরিষ্কার যে আদানির এই উত্থানের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জীবন বীমা নিগম সঙ্গত কারণেই হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নিয়ে চিন্তিত। সর্ববৃহৎ দেশীয় লগ্নিকারী হিসাবে জীবন বীমা নিগমের অধিকার আছে হিন্ডেনবার্গ এবং গৌতম আদানির কাছে কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করার। লগ্নির নীতি অনুযায়ী ভারতীয় জীবন বীমা তার মোট লগ্নির ৮০% নিয়োগ করে সরকারের নিরাপদ প্রকল্পগুলিতে (securities) ও বন্ডে। বাকি ২০% নিয়োজিত হয় শেয়ারে। এলআইসি দীর্ঘমেয়াদী লগ্নি করে— বাজার যখন নিম্নমুখী (Bearish) তখন শেয়ার কেনে অর্থাৎ লগ্নি করে আর বাজারের উত্থানের সময় (Bullish) সে শেয়ার বিক্রি করে লাভ আয় করে অর্থাৎ বাজার থেকে বেরিয়ে যায়। এর একটা নাম আছে Contrarian। অর্থাৎ এলআইসি-র ইনভেস্টমেন্ট বোর্ড গ্রাহকদের স্বার্থকে অপরিসীম গুরত্ব দিয়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকে মাথায় রেখেই সম্পূর্ণভাবে পর্যালোচনা করে লগ্নির সিদ্ধান্ত নেন। শেয়ার বাজারে এলআইসি-র লগ্নির ২০% এর মাত্র ৭% আদানির কোম্পানিগুলিতে নিযুক্ত হয়েছে যার মূল্য ৩৫০০০ কোটি টাকা (৩৫০ বিলিয়ন)। বর্তমান বাজার মূল্য ৫৬০০০ কোটি টাকা। শেয়ারের দাম পড়ার আগে পর্যন্ত এইমূল্য ছিল ৭৫০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া বিচার করলে মানসিক অঙ্কে আপনার মনে হতে পারে যে এতে প্রায় ১৯০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হল যা জাতীয় ক্ষতি। কিন্তু এলআইসি এখনো পর্যন্ত এসব কোম্পানির একটি শেয়ারও বেচেনি। ফলে প্রকৃত ক্ষতির (Real loss) প্রশ্ন নেই। উল্টে এখনো পর্যন্ত ভারতীয় জীবন বীমা নিগম এই লগ্নির মাধ্যমে প্রায় ২৩০০০ কোটি টাকা ধারণাগত লাভ (notional Profit) করেছে। হ্যাঁ, এটাকে প্রকৃত লাভ (Real Profit) বলা যাবে না। এটা কমতেও পারে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত গ্রাহকদের অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। এলআইসি তার বিপুল সম্পদ ফেলে রাখতে পারে না— এলআইসি সর্ববৃহৎ দেশীয় লগ্নি সংস্থা (largest domestic institutional investor)। প্রতিবছর অন্তত ৪.৫-৫ লক্ষ কোটি টাকা তার বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত (investible surplus)। বাজার অর্থনীতিতে এই বিপুল পরিমাণ পুঁজি এলআইসি অলস ভাবে ফেলে রাখতে পারে না। কোথাও না কোথাও তো তাকে লগ্নি করতে হবেই। অর্থনীতির সর্বজ্ঞরা যারা বলছেন উল্টো কথা তারা বাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে কতটা সরব? তারা চাইছেন হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিতে- এরা তো এলআইসি বা আত্মনির্ভর অর্থনীতির সমর্থক নন এরা এলআইসি-র ক্ষতি চাইছেন, প্রকারান্তরে দেশি-বিদেশি পুঁজির দালাল। জেনে রাখা ভাল, চেয়ারম্যানের বিবৃতি অনুসারে এলআইসি তার মোট সম্পদের মাত্র ০.৯৭৫% নিয়োজিত করেছেন আদানির কোম্পানিতে যা কিনা শেয়ারের মোট নিযুক্ত সম্পদের (মোট সম্পদের ২০%) মাত্র ৭%। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ক্রেডিট রেটিং এর বিচারে আদানির কোম্পানিগুলির মান AA বা তারও বেশি। যদিও বাজার অর্থনীতিতে এই ক্রেডিট রেটিংও manipulative। কিন্তু সেটা তদন্ত ও বিচার সাপেক্ষ। আরো বড় কথা লগ্নির পরিমাণ অনুযায়ী রিলায়েন্সে এলআইসি-র লগ্নি এর থেকে বেশি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে লগ্নি অধিকতর। ৩৫০০০ কোটি টাকা পরিমাণের বিচারে যথেষ্ট বেশি কিন্তু মোট সম্পদের তুলনায় সেটা নগণ্য। জীবন বীমা নিগমকে এর আগেও এই ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে ONGC, IDBI ইত্যাদির শেয়ারের ক্ষেত্রে। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই ভারতীয় জীবন বীমা নিগম বিচক্ষণতার সাথে লাভ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বচ্ছলতার পরিমাপ (solvency ratio) প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। গ্রাহকের মোট দায় (Liability) তার সম্পদ (asset) দ্বারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এখানে সম্পদের খাতার মূল্যের (book value) কথাই বলা হচ্ছে, বাজার মূল্য (market value) নয়। সুতরাং গ্রাহকদের এখনই শঙ্কিত হওয়ার বিষয় নয়। তাদের অর্থ সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত।
তবে দুশ্চিন্তার কারণ তো আছেই। দুশ্চিন্তা যদি করতেই হয় তবে ভারতের অর্থনীতিকে নিয়ে করুন। এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র জীবন বীমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কারণ ঘটেনি। তবে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি এই দুর্মর গতিতে অগ্রসর হতে থাকলে কতদিন ভারতীয় জীবন বীমা নিগম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো সুরক্ষিত থাকতে পারবে?
যদি সৎভাবে ও রাজনৈতিকভাবে সচেতনতার সঙ্গে চিন্তা করলে অর্থনীতি নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। সচেতনতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াও জানানো দরকার। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এলআইসি শাসক শ্রেণীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা ফলে শ্রেণী স্বার্থেই তারা এলআইসি-কে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সারা ভারত বীমা কর্মচারী সমিতির নিরলস সংগ্রাম জারি আছে যেখানেই এলআইসি-র অর্থ নিয়োজিত হোক না কেন, তার লাভ ব্যক্তিস্বার্থে না হয়ে যেন বৃহত্তর ভাবে সমাজে সাধারণ মানুষের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। যেভাবে বন্দর থেকে বিমানবন্দর, মাটি থেকে আকাশ কয়েকজন ব্যক্তির দখলে যাচ্ছে তাতে ভয়ের কারণ আছে তো বটেই। একটা গোটা দেশের অর্থনীতি প্রভাবিত হচ্ছে কয়েকজন মাত্র ধনীদের দ্বারা। যেটা সবচেয়ে ভয়ের। দুশ্চিন্তা করতে হলে, দেশের অর্থনীতির একচেটিয়াকরণ (monopolization) নিয়ে করতে হবে, শুধুমাত্র ভারতীয় জীবন বীমা নিগমকে নিয়ে নয়। অর্থনীতির নয়া উদারবাদী রূপরেখার জন্যই ভারত বৈষম্যের বিচারে পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। প্রধান বিরোধী দল যারা এই দেশে নয়া উদারবাদের জনক তারা জীবন বীমা নিগমের কার্যালয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে! একমাত্র বামপন্থীরা প্রথম থেকে নয়া উদারবাদের বিপক্ষে সংগ্রাম করেছেন, তাদের প্রতিবাদ যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু বুঝতে হবে, অর্থনীতিতে যদি প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির মাধ্যমে বিকল্প ভাষ্যে না পৌঁছনো যায়, তবে শুধুমাত্র জীবন বিমা নিগম নয়, প্রতিটি মানুষই নিরাপত্তা হারাবেন। এখনো পর্যন্ত ভারতীয় জীবন বীমা নিগম সুরক্ষিত ও নিরাপদ। কতদিন থাকবে তা নির্ভর করবে এদেশের মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বৃহত্তর অর্থে ভবিষ্যতের রাজনীতির দিশার উপর।