বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[দেশ]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২ — প্রায় ২৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ ২৮-২৯ মার্চ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটে অংশ নিয়ে প্রকৃত অর্থেই বিশ্বের বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাকশন করলেন। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স এই ধর্মঘটকে সংগ্রামী সংহতি জানিয়ে এই ধর্মঘটের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শ্রমজীবী মানুষের এই অভূতপূর্ব উত্থানের পাশে দাঁড়িয়েছিল ছাত্র-যুব-মহিলা সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মী, নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সমূহের ডাকে এই ধর্মঘটকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানিয়েছে সংযুক্ত কিসান মোর্চা ও মোর্চার নেতৃবৃন্দ ওই দু' দিন গ্রামীণ বনধ্ পালনের ডাক দিয়েছিলেন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে।
"দেশ বাঁচাও, দেশবাসী বাঁচাও" এই মূল কেন্দ্রীয় আহ্বানে, ১২ দফা দাবির ভিত্তিতে ডাকা এই ধর্মঘটে অংশ নেন কয়লা, ইস্পাত, বন্দর, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীবৃন্দ থেকে শুরু করে ব্যাঙ্ক বিমা শিল্পের কর্মীরাও। এসমাকে উপেক্ষা করে হরিয়ানার পরিবহন শ্রমিকেরা ২৮ মার্চের ভোর থেকেই ধর্মঘটে সামিল হন। তিউতিকরিন ও পারাদ্বীপে পোর্টের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রাখেন। মহারাষ্ট্রে সরকার কর্তৃক জারি করা এসমাকে তোয়াক্কা না করে বিদ্যুৎ কর্মীরা ধর্মঘটে সামিল হন। ৫০,০০০ সরকারি কর্মচারী তামিলনাড়ুর ৩০০র অধিক স্থানে পিকেটিং করেন। আসাম, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, জম্মু কাশ্মীরের হাইডেল পাওয়ার এর শ্রমিকরা সক্রিয়ভাবে ধর্মঘটে সামিল হন। ধর্মঘটের আয়নায় আরেকবার প্রমাণিত হল, মোদির কর্পোরেটপন্থী নীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে অবিজেপি সরকারগুলোও পিছিয়ে নেই। বরং, এ প্রশ্নে গোটা শাসকবর্গের মধ্যে রয়েছে অভিন্ন এক মতৈক্য। তাই, এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার, বা মহারাষ্ট্র সরকার শ্রমিক বিরোধী পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব করল না। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ধর্মঘটকে সমর্থন করলেও রাষ্ট্রীয় পরিবহন কর্মী ও সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার থেকে বিরত রাখতে সেখানকার রাজ্য সরকার সার্কুলার জারি করে।
দু' দিনের এই সাধারণ ধর্মঘটের প্রভাব বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই ধর্মঘট যে বার্তা ছড়িয়ে দিল, তা আগামীদিনে বিরাট তাৎপর্যবাহী। নিছক আর্থিক দাবি দাওয়া নয়, এই ধর্মঘট অর্থনৈতিক দাবির গণ্ডি ছাড়িয়ে তা জনপরিসরের বৃহত্তর স্বার্থকে সামনে এনেছে। অকল্পনীয় আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ১০০০ টাকা ছুঁই ছুঁই রান্নার গ্যাসের দাম, প্রতিদিন উর্ধমুখী পেট্রল ডিজেলের দাম সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসার পর মোদি পেট্রো পণ্যে শুধুমাত্র এক্সাইজ ডিউটি বাবদ ১৮.৭২ লক্ষ কোটি টাকা কোষাগারে পুরেছে। স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার, পিএফ-এ কর্মীবৃন্দের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের উপর সুদের হার ৮.১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা ৪১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। বিপরীতে, কিছুদিন আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক সার্কুলার মারফত মাইক্রো ফিনান্সের উপর এতোদিন যে সুদের উর্ধসীমা ছিল, তা তুলে দিল। ফলে ওই সমস্ত সংস্থাগুলো এখন থেকে মর্জি মাফিক যা খুশি সুদ আদায় করতে পারবে। এ বছরের বাজেট কমিয়েছে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ। গত বছরের সাপেক্ষে তা কমানো হয়েছে প্রায় ৩৮,০০০ কোটি টাকা। শহরাঞ্চলে বেকারত্ব যে আতঙ্কজনক মাত্রায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে (যা কিছুদিন আগে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে আবার সামনে এলো) তার উপশম ঘটানোর বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা মোদি সরকার দেখালো না। কোভিড গোটা দেশে ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দেউলিয়ে অবস্থা প্রকট রূপে সামনে আনলেও জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে এবারের বাজেট কোনও পদক্ষেপ নিল না। সমস্ত ইনফর্মাল শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার দীর্ঘদিনের ন্যায্য দাবি আজও অবহেলিত। ভারতের ৪০ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় থাকলেও আজ মোদি সরকার তাও কেড়ে নিতে উদ্যত।
গোটা দেশে আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল ও অন্যান্য প্রকল্প কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিমারির সময়ে দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করলেও, ৬০ লক্ষের উপর মূলত মহিলা নির্ভর এই পেশার কর্মীদের "স্বেচ্ছাসেবক" হিসাবে গণ্য করা হয়। নেই তাঁদের কোনও ধরনের সামাজিক সুরক্ষা, নেই শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি, নেই বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি। ৪৪-৪৫তম জাতীয় শ্রম সম্মেলন, যা দেশের সর্বোচ্চ ত্রিপক্ষীয় মঞ্চ, পূর্বোক্ত সুপারিশগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে করলেও আজ পর্যন্ত তা পালন করা হল না। গোটা শ্রমবাজার ভরে উঠেছে ইনফর্মাল শ্রমিকদের দিয়ে। এ রাজ্যে প্রায় ১১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৩ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কন্ট্রাক্ট শ্রমিক। আর, চারটে শ্রম কোড এর মূল লক্ষ্যই হল, দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে নতুন দাস শ্রমিককে পরিণত করা। তাই, শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত শ্রমিকশ্রেণীর সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার মোদি হরণ করল। অতিমারির সুযোগে, সংসদে বর্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতার স্টিমরোলার চালিয়ে চারটে শ্রম কোড পাশ করিয়ে নেওয়া হল। আর এই শ্রম কোড সূত্রায়িত হল, "ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস" এর ভিত্তিভূমির উপর।
বিচারবিভাগ ও আইনসভা ও প্রশাসনের ইশারায় চলছে। কেরলার হাইকোর্ট অতি সক্রিয়তা দেখিয়ে ধর্মঘটের প্রথম দিনেই ঘোষণা করে যে রাজ্য সরকারি কর্মী ও বিপিসিএল-এর কর্মীদের ধর্মঘটে অংশ নেওয়াটা বেআইনি। সেই মোতাবেক রাজ্য সরকারকে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়।
হিন্দুত্ববাদকে নব্য জাতীয়তাবাদ হিসাবে প্রতিপন্ন করছে এই ফ্যাসিবাদী মোদি সরকার। আর তার আড়ালে দেশের অর্থনীতিকে বেচে দিচ্ছে কর্পোরেট বহুজাতিক সংস্থাগুলোর কাছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। গত সাত বছরে, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো কর্পোরেটদের কাছে পাওনা প্রায় ১১ লক্ষ কোটি টাকা মাফ করে দিল। আগামীদিনে তিন-চারটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনও কিছুই সরকারের অধীনে থাকবে না। জাতীয় পাইপলাইনের কর্মসূচিতে এবার নাগরিকদের করের টাকায় তিলে তিলে গড়ে ওঠা পরিকাঠামো বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
এবার আত্মসমীক্ষার পালা
একটা পর্ব সাঙ্গ হল। সামনের দিকে ফের এগিয়ে যেতে, আঘাত করার ক্ষমতাকে আরও তীব্র করতে ট্রেডইউনিয়ন নেতৃত্বকে দাঁড়াতে হবে আয়নার সামনে। কঠোর, নির্মোহ আত্মসমীক্ষা, আত্মজিজ্ঞাসা আজ সময়ের দাবি।
কৃষক সংগঠনগুলো যদি মরণপণ লড়াই করে তিনটি কৃষি আইন খারিজ করাতে পারে, শ্রমিকশ্রেণী কেন পারল না চারটে শ্রম কোড কে বাতিল করাতে? কেনই বা দিল্লিতে দিনের পর দিন দাঁত কামড়ে, ঝড় জল শৈত্যপ্রবাহ তীব্র দাবদাহকে সহ্য করে যে ভাবে জয় ছিনিয়ে নিল কৃষক মোর্চা, ট্রেড ইউনিয়নগুলো পারলো না কেন সেই পথে হাঁটতে?
প্রায়শই এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে ট্রেডইউনিয়ন কেন্দ্রগুলোকে।
কৃষক সমাজ ও শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে বুনিয়াদি পার্থক্য রয়েছে, যা তাদের লড়াইয়ের রূপ ও নির্ধারণ করে দেয়। কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রমিক মালিক সম্পর্ক রয়েছে একমাত্র কৃষি শ্রমিকদেরই ক্ষেত্রে। তাই দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ করে ওই ধরনের সংগ্রামের রূপ শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে গ্রহণ করা আদৌ সম্ভব নয়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে চলতে হয় আইন মেনে। এমনকি ধর্মঘট ডাকার আগে আইন মেনেই অগ্রিম নোটিশ দিতে হয়। নতুন শ্রম কোড এই আইনসম্মত ধর্মঘটকেও আরও জটিল করায় এরপর ধর্মঘট করাটাই অসম্ভব হয়ে যাবে। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ৪১টি অর্ডন্যান্স কারখানাকে ৯টি কর্পোরেশন এ রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর বিরুদ্ধে বিএমএস সহ প্রতিরক্ষা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কেন্দ্রীয় ফেডারেশনগুলো অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটের ডাক দেয়। যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে গোটা প্রতিরক্ষা শিল্পে ধর্মঘটকে বে আইনি ঘোষণা করে। শ্রম কোডে ধর্মঘটের যে সংজ্ঞা রয়েছে, তার সীমাকেও অতিক্রম করে কারখানার চত্ত্বরে যে কোন ধরনের শান্তিপূর্ণ অবস্থান, স্লোগান দেওয়া, এমনকি ওভারটাইম করতে অস্বীকার করাটাকেও ধর্মঘট হিসাবে গণ্য করার নিদান দিল। কড়া হাতে এই ধর্মঘটকে ভাঙতে পুলিশ প্রশাসন ও কারখানার কর্তৃপক্ষকে ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে অভিযুক্ত কর্মীবৃন্দকে মুহূর্তের মধ্যে ছাঁটাই, বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করার অধিকার দেওয়া হল। আর, আধিকারিকদের বিরুদ্ধে যাতে আদালতে মামলা না করা যায়, তার জন্য অধ্যাদেশ দিল সুরক্ষা বর্ম। যে কোন কর্মী যদি ধর্মঘটের উস্কানি দেয়, তার ও হবে একই পরিনতি। এই অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে বাম কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো যখন প্রতিরক্ষা শিল্পের গেটে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখাতে যায়, তখন দেখা গেল, ভিডিও হাতে গোটা সমাবেশের ছবি তোলা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, কোন কোন কর্মী এই সমাবেশে অংশ নিচ্ছে, তার প্রমাণ রাখা। এই অধ্যাদেশ পরবর্তীতে আইনে পরিণত হয়, সংসদে মাত্র তিন মিনিট "আলোচনা" করে।
এটা একটা মাত্র উদাহরণ। অতীতে আমরা দেখেছি রেল ধর্মঘটকে ভাঙতে ইন্দিরা সরকারের ভূমিকা, তামিলনাড়ুতে ৫,০০০ ধর্মঘটী রাজ্য সরকারি কর্মীকে জয়ললিতা কিভাবে ছাঁটাই করে, কিছুদিন আগে, তেলেঙ্গানার রাষ্ট্রীয় পরিবহন কর্মীদের উপর নামানো রাজ্য সরকারের হিংস্র দমন, উত্তরপ্রদেশে আন্দোলনরত রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কর্মীদের উপর এসমা প্রয়োগ— এমন রাশি রাশি উদাহরণ রয়েছে।
ভারতে নয়া শিল্পনীতি রূপায়িত হওয়ার আগে সংগঠিত শিল্পের ইউনিয়নগুলো এক শান্তিপূর্ণ পরিমন্ডলে ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের সুযোগ ভোগ করে আসছিল। মোটামুটি নিয়মিত ব্যবধানে, জয়েন্ট কন্সাল্টেটিভ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় দপ্তর স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে কর্মীদের বেতনক্রম, অন্যান্য আর্থিক সুযোগ সুবিধার নিষ্পত্তি করতো। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তখন বিশেষ সংঘর্ষের রাস্তায় যেতে হতো না। সংগঠিত শিল্পের এই সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন তখন বিশেষ সুবিধা ভোগ করতো আর, দেশের বিস্তীর্ণ অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের দুঃখ, যন্ত্রণার সঙ্গে ছিল বহু যোজন দুরত্ব । দেশের শ্রম আইনের আওতায় এখনও পর্যন্ত রয়েছে হাতে গোনা মুষ্ঠিমেয় সংগঠিত শিল্পের এই শ্রমিকশ্রেণী। শক্তিশালী ইউনিয়ন ও দরকষাকষির ক্ষমতা থাকায় অর্থনীতির মূল মূল ক্ষেত্রে এদের আঘাত করার ক্ষমতাও ছিল বেশি। বামপন্থী নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের পেশাগত, শিল্প ও সংস্থার গন্ডির বাইরে বেরিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর বৃহত্তর স্বার্থে সাধারণত পথে নামতে দেখা যেত না।
নব্য উদারবাদ যেদিন থেকে কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের কাছে অর্থনীতির প্রধান অভিজ্ঞান হয়ে উঠল, সেদিন থেকে নেমে এল বিরাট এক জলবিভাজিকা। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থার থেকে রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে নেওয়া, বিলগ্নিকরণ বেসরকারিকরণের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া, আর সেই তালে তালে এতোদিনকার সুরক্ষিত শ্রমব্যবস্থার বিরাট সৌধ যেন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পরতে শুরু করল। সংগঠিত শ্রমিক ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে যে বিরাট এক ব্যবধান গড়ে উঠেছিল সযত্নে, সেই সীমারেখা উবে যেতে শুরু করল। সংগঠিত ক্ষেত্রের অভ্যন্তরে হুহু করে বৃদ্ধি পেতে লাগল ইনফর্মাল, কন্ট্রাক্ট শ্রমিক। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সাবেক ইউনিয়নগুলো নতুন এই শক্তিকে তখনও স্থায়ী শ্রমিকদের কাছে টেনে আনার, তাঁদের দাবি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার কর্তব্যকর্ম থেকে নিজেদের সরিয়েই রাখে।
আজ গোটা দেশ জুড়ে ইনফর্মাল শ্রমিকদের যে বিপুল প্রাধান্য, দেশের জিডিপি তে এই ইনফর্মাল সেক্টর যে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলেছে (প্রায় ৬০ শতাংশ), সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সেখান থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর বাস্তব এটাই, নতুন শ্রম কোডের সঙ্গে এই অংশটার সম্পর্ক নেই বললেই চলে। সামাজিক সুরক্ষা কোড, বা অকুপেশনাল সেফটি হেলথ ওয়ার্কিং কন্ডিশন সংক্রান্ত কোড র সঙ্গে নতুন গিগ শ্রমিক বা বিপুল বিশাল ইনফর্মাল, অসংগঠিত শ্রমিকদের বেশ কিছু দিক যুক্ত থাকলেও তা তাঁদের জানা বোঝার স্তর থেকে অনেক অনেক দূরে। ফলে, শ্রম কোড বাতিলের স্লোগান দেশের শ্রমজীবী মানুষদের সংখ্যাধিক্য অংশের নিজস্ব দাবি হয়ে এখনও আত্মপ্রকাশ করেনি। এটাই বর্তমান শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে নিহিত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। বেশ দীর্ঘ "শান্তিপূর্ণ" পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণীর সবচেয়ে সংগঠিত অংশটির যে বৃদ্ধি বিকাশ হয়েছিল, নব্য উদারবাদ সেই পর্বের অবসান ঘটায়। কিন্তু, শাসকশ্রেণীর নতুন এই আক্রমণাত্মক অবস্থানের বিরুদ্ধে বিকল্প আন্দোলন ও সংগঠনের রূপ, নতুন কর্মসূচি উদ্ভাবন করতে পারলো না ভারতের শ্রমিক আন্দোলন। সংগঠিত সেক্টরের ইউনিয়নগুলো এমনকি অন্য সংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নামিয়ে আনা হামলার (যেমন, প্রতিরক্ষা শিল্পের ক্ষেত্রে) পাশে না দাঁড়িয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রের উপর নামানো আক্রমণকে ঠেকাতে রক্ষণাত্মক সংগ্রামেই লিপ্ত থাকল। যদি দেশের সমস্ত সংগঠিত ক্ষেত্র একযোগে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এই হামলার বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানতো, যদি এই লড়াইকে উন্নত করা যেত রাজনৈতিক স্তরে, তবে গোটা পরিস্থিতি মোড় নিত অন্য দিকে।
ভারতে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক প্রায় সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দল। এ প্রশ্নে এক অভিন্ন ঐক্যমত্য গড়ে উঠেছে নিজেদের মধ্যে। পার্থক্য এইখানে, কতটা "মহানুভবতার" জামা পরিয়ে, সহনসীমার মধ্যে রেখে এই আর্থিক নীতিকে রূপায়িত করা যায়। আর, এই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় চলা ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রগুলো তাই ওই নীতির কিছু প্রকাশভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও নির্ণায়ক লড়াই সংগঠিত করতে পারবে না। যতক্ষণ না ভারতের শ্রমিক শ্রেণী স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শ্রেণী হিসাবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন, আত্মআবদ্ধ শ্রেণী থেকে সমস্ত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠছেন, ততদিন ভারতের অত্যন্ত চতুর, সংগঠিত শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্ণায়ক লড়াই করা যাবে না। আর, এই কাজটা করতে হবে বামপন্থীদেরই।
প্রথাগত পথ ও আনুষ্ঠানিক সংগ্রামের রূপ পদ্ধতি ছেড়ে সৃজনশীলভাবে আন্দোলনের নবায়ন করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তেছে বামপন্থীদের উপরই। ব্যাপক অসংগঠিত অংশকে নিজেদের পাশে টেনে, নতুন উদ্ভব ঘটা ক্রম প্রসারমান গিগ, প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল শ্রমিকদের পাশাপাশি অগণন স্কীম কর্মীদের সংগঠিত করেই আগামীদিনে এগিয়ে যেতে হবে নতুন প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে।